Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

উচ্চ মূল্যস্ফীতি যেভাবে মোকাবেলা করছে উন্নত বিশ্ব

Icon

অরুন্ধতী বসু

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:৪৫

উচ্চ মূল্যস্ফীতি যেভাবে মোকাবেলা করছে উন্নত বিশ্ব

প্রতীকী ছবি

মূল্যস্ফীতির ফাঁদে উন্নত বিশ্ব। করোনাভাইরাস সংক্রান্ত লকডাউন পর্ব শেষ হওয়ার পর বৈশ্বিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হচ্ছে দ্রুতগতিতে। ফলে চলতি বছরের শুরু থেকেই বিভিন্ন পণ্য ও সেবার দর বৃদ্ধিতে সেসব দেশেও বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়।

ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয়ে চড়ছে মূল্যস্ফীতির পারদ। বিশ্বের বড় বড় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে এখন এই নিয়ে মাথা ঘামাতে হচ্ছে। এমন চলতে থাকলে আগামীতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে মূল্যস্ফীতির হার। এ হার নিয়ন্ত্রণে উন্নত দেশগুলো নিয়েছে নানা পদক্ষেপ। 

সম্প্রতি এর আলোকে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানে প্রকাশ হয়েছে একটি প্রতিবেদন। এতে তুলে ধরা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও চীনা অর্থনীতির পরিস্থিতি। 

যুক্তরাষ্ট্র  

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের (ফেড) চেয়ারম্যান জেরোমি পাওয়েলকে বর্তমানে যদি কোনো শব্দ রাত জাগিয়ে রাখে, তা হলো ‘ক্ষণস্থায়ী’ বা ‘ট্রানজিটরি’। নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি মহামারির মন্দা কাটিয়ে উঠছে। অক্টোবরে বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতির দেশটিতে বেকারত্ব কমেছে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এ হার মহামারিকালে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। চাকরির বাজার এতই সরব যে, রেকর্ডসংখ্যক মানুষ এখন নতুন পদ অন্বেষণ করছেন, মজুরি বাড়ছে। 

সেইসঙ্গে রেকর্ড বাড়ছে পুঁজিবাজারের সূচক। মানুষ আবার খরচ করছে দেদারসে। সার্বিক পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতির অপচ্ছায়া রয়েছে সব কিছুতে। জ্বালানির দর ও চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সরবরাহ ঘাটতিতে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার পৌঁছেছে ৬ দশমিক ২ শতাংশে। ৩০ বছরেরও বেশি সময়ে এমনটি দেখা যায়নি। 

ফেড ও বাইডেন প্রশাসন বারবার বলছে, এ ঊর্ধ্বগতি ক্ষণস্থায়ী ও মহামারির প্রভাব কমার সঙ্গে তা হ্রাস পাবে। তবে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ছেই। এতে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তা সমাজ। দেশটিতে ভোক্তা আস্থা নভেম্বরে ১০ বছরে সর্বনিম্নে পৌঁছেছে। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম টানতে ফেডের মূল হাতিয়ার সুদহার বৃদ্ধি। হাতিয়ার হিসেব খুবই দুর্বল। পাওয়েল এ হাতিয়ার ব্যবহারে সাবধানতা অবলম্বন করছেন। 

সংকট স্পষ্ট যে, দ্রুত সুদহার বৃদ্ধিতে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার স্থগিত হয়ে যেতে পারে এবং প্রকৃতপক্ষেই দরবৃদ্ধি ক্ষণস্থায়ী হলে, তা প্রতি উৎপাদনশীল প্রমাণিত হতে পারে; কিন্তু উচ্চ সুদহার মূল্যস্ফীতি কমাতে ব্যর্থ হলে, পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। পণ্যমূল্যের সঙ্গে বাড়বে সুদহার। এতে মন্দা আরও ঘনীভূত হবে। 

যুক্তরাজ্য 

চলতি মাসে বৈঠকে করার কথা রয়েছে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের নীতিনির্ধারকদের। এসময় সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এটি হলে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডই হবে বড় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা সুদহার বাড়িয়েছে। অক্টোবরে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ২ শতাংশে, যা এক দশকে সর্বোচ্চ। এ উচ্চ মূল্যস্ফীতির গতি রুখতে নীতিনির্ধারকরা বেইস রেট দশমিক ১ থেকে বাড়িয়ে করেছেন দশমিক ২৫ শতাংশ। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে এ হার আরও বাড়িয়ে দশমিক ৫ শতাংশ করা হবে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। 

বিশ্বের অন্যতম উন্মুক্ত অর্থনীতির দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্যের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি নির্ভরশীল বাণিজ্যের ওপর। ব্রিটেন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সরবরাহ শৃঙ্খল (সাপ্লাই চেইন) সংকট ও জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধিতে। 

ইউরোপীয় ইউনিয়ন 

ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেও, অন্য পথে হাঁটছে ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক (ইসিবি)। তারা স্পষ্ট স্বরেই বলেছে, ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছ থেকে একই পদক্ষেপ আশা না করতে। এখন ইউরো অঞ্চলে মূল্যস্ফীতির হার ৪ দশমিক ১ শতাংশ, যা ১৩ বছরে সর্বোচ্চ। তবে এ অঞ্চলে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির হার একেক জায়গায় একেক রকম। ইউরো কারেন্সি ইউনিয়নের ১৯ সদস্যের জন্য সুদহার নির্ধারণ করে ইসিবি। দ্রুত কোনো পদক্ষেপে মহামারির প্রভাব থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার ক্ষতি হতে পারে বলে সম্প্রতি সতর্ক করেছেন ইসিবি প্রধান ক্রিস্টিনা লাগার্দে। 

ইউরো অঞ্চলে মূল্যস্ফীতি ক্ষণস্থায়ী- ইসিবির সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন অক্সফোর্ড ইকোনমিক্সের প্রধান জার্মান অর্থনীতিবিদ অলিভার রাকাউ। তার দলের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি বছর অঞ্চলটিতে মূল্যস্ফীতির গড় হার ২ দশমিক ৪ শতাংশ হওয়ার পর ২০২২ সালে তা ২ শতাংশ হবে। তিনি সুদহার বাড়ানোর পরিবর্তে মুদ্রানীতি শিথিল পরিকল্পনা (সম্পদ ক্রয় কর্মসূচি) সহজের পরামর্শ দেন। 

ফ্রান্স  

ফ্রান্সের সুদহার নির্ধারণ করে দেয় ইসিবি। ইউরো অঞ্চলের দেশগুলোয় মূল্যস্ফীতির গতি এক নয়। সেসব দেশগুলোর সরকার স্বতন্ত্রভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিচক্ষণতার সঙ্গে পদক্ষেপ নেয়। অক্টোবরে ফ্রান্সের বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ২ দশমিক ৬ শতাংশ, যা ২০০৮ সালের পর সর্বোচ্চ। জ্বালানির দর ২০ শতাংশ বৃদ্ধিই এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণ। 

ঊর্ধ্বমুখী দ্রব্যমূল্যের বাজার বিবেচনায় নিয়ে ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী জঁ ক্যাসটেক্স ‘ইনফ্লেশন কমপেনসেশন’ বা মূল্যস্ফীতি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। মূল্যস্ফীতি নিয়ে ব্যাংক অব ফ্রান্সের পূর্বাভাস হচ্ছে, এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি ক্ষণস্থায়ী। তবে আরও কয়েক প্রান্তিক থাকতে পারে উচ্চ মূল্যস্ফীতির দাপট। 

ফ্রান্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির গভর্নর ফ্রাঁসোয়া ভিলেরয় আগামী বছর ইসিবির সুদহার বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়ার কোনও কারণ দেখছেন না।

অস্ট্রেলিয়া 

কেন্দ্রীয় রিজার্ভ ব্যাংক অব অস্ট্রেলিয়া (আরবিএ) ‘অস্ট্রেলিয়ান একসেপশনালিজমের’ ওপর নির্ভর করে সুদহার বৃদ্ধির বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২৪ সালের আগ পর্যন্ত দেশটিতে সুদহার দশমিক ১ শতাংশই বহাল থাকবে। অস্ট্রেলিয়ায় মূল ভোক্তামূল্য সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দশমিক ৭ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়ে ঠেকেছে ২ দশমিক ১ শতাংশে। এর মধ্য দিয়ে ছয় বছরে প্রথমবারের মতো মূল্যস্ফীতি বাড়ল। আরবিএ মূল্যস্ফীতির পরিবর্তে মজুরির হারে দ্রুত বৃদ্ধি দেখতে ইচ্ছুক। 

তাই এখন আপাতত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করে আগামী বছর সুদহার বাড়ানো, না বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়ার পথে হাঁটতে চায় আরবিএ।

জাপান 

মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে জাপান উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যতিক্রম দেশ। অতি-সরল মুদ্রানীতির পথিকৃত হিসেবে ২০১৬ সাল থেকে দেশটিতে সুদহার ঋণাত্মক দশমিক ১ শতাংশে রয়েছে। বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ অর্থনীতি কয়েক দশকের স্ফীতিহ্রাস (ডিফ্লেশন) এবং স্থবিরতা অবসানে লড়াই করছে। তাই শিগগিরিই জাপানের মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ২ শতাংশে পৌঁছানোর সম্ভাবনা নেই। 

তবে সরকারি তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে ভোক্তামূল্য বিগত বছরগুলোর তুলনায় সামান্য বেড়েছে। এ বৃদ্ধি মূলত জ্বালানির উচ্চমূল্য দ্বারা চালিত হয়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এতে অন্তর্নিহিত মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধির সম্ভাবনা কম। 

রয়টার্সের সাম্প্রতিক জরিপে অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন, আগামী বছর শেষ হওয়ার আগেই ২৫ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১৩টিই অন্তত একবার সুদহার বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেবে। 

চীন 

অক্টোবরে চীনের বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে ১ দশমিক ৫ শতাংশ, যা সেপ্টেম্বরের চেয়ে দশমিক ৭ শতাংশ বেশি এবং ১৩ মাসে সর্বোচ্চ। খাদ্য ও জ্বালানির উচ্চমূল্যই এর জন্য দায়ী। সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক, ফ্যাক্টরি গেট বা কারখানা থেকে পাইকারদের কাছে পণ্য বিক্রয়মূল্য বেড়েছে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। 

বিশ্লেষকদের মতে, এর মূলে রয়েছে জ্বালানির উচ্চমূল্য। তবে পিপলস ব্যাংক চায়নার রয়েছে অন্য সংকট। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রকট আবাসন খাত সংক্রান্ত জটিলতা।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫