
ফাইল ছবি
পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতার অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে উত্তরাধিকার সূত্রে অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যাংকগুলো পায় বাংলাদেশ। সব ব্যাংক রাষ্ট্রীয়করণ করার পর নতুন করে যাত্রা শুরু করে। নতুন যাত্রায় সঙ্গী ছিল খেলাপি ঋণ। এরপর বেসরকারি ব্যাংকের যাত্রা শুরু ১৯৮৩ সাল থেকে। অল্প সময়ের মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকেও আঁচড় কাটে খেলাপি ঋণ। এরপর কয়েক দফায় দফায় নতুন নতুন বেসরকারি ব্যাংক হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে সব ব্যাংকই খেলাপির ছোবলে পড়ে।
খেলাপি ঋণ সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে, যার থেকে কোনোভাবে কেউ বাদ যায়নি। বলতে গেলে বাদ যাওয়ার চেষ্টাও করেনি। এই সংস্কৃতি বন্ধের কার্যকর পদক্ষেপও কোনো পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি। তবে সব সময় খেলাপি ঋণ লুকানোর নিত্য নতুন কৌশল আবিষ্কার করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে নানা নামে ঋণ খেলাপিদের সুবিধা দিয়েছে সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো।
ব্যাংকগুলো পাঠানোর তথ্যের ভিত্তিতে ত্রৈমাসিক ও বাৎসরিক ভিত্তিতে ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ নিয়ে প্রতিবেদন প্রস্তুত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসেবে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ এক হাজার ১৫০ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮.১২ শতাংশ।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা বা ৭.৬৬ শতাংশ। এর মানে গত বছরের ৯ মাসের হিসাবে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১২ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের এই ঊর্ধ্বগতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ)।
তবে সংস্থাটি বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসেবে যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ দেখানো হয়, প্রকৃতপক্ষে খেলাপি ঋণ আরও অনেক বেশি। সংস্থাটি হিসাব করে দেখিয়েছে, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকারও বেশি।
কেন খেলাপি ঋণ বাড়ছে এই বিষয়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসে’র (বিএবি) চেয়ারম্যান ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, বিভিন্ন কারণে ব্যবসায়ীরা খেলাপি হয়ে গেছেন, কেউ পণ্যমূল্য ওঠানামার কারণে ভালোভাবে ব্যবসা করতে পারছেন না; কিন্তু আগে নিয়মিত ঋণ শোধ দিতেন। আবার মালিক মারা যাওয়ার কারণেও ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যবসা করতে গেলে টাকা লাগে, খেলাপি হয়ে পড়ায় অনেককে ব্যাংক সময়মতো টাকা দেয়নি। আবার অনেক সময় বেশি মুনাফার আশায় চাহিদার বেশি টাকা দিয়েছে ব্যাংক। সামান্য কিছু টাকার কারণেই হয়তো অনেকে খেলাপি হয়ে পড়েছেন।
তিনি আরও বলেন, আরেকটি শ্রেণি আছে, যারা ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে বিদেশে চলে গেছেন। তারা আয়েশি জীবন কাটাচ্ছেন; কিন্তু ব্যাংক বিপদে পড়ে গেছে। তাদের কীভাবে ধরা যায়, এ নিয়ে কাজ হবে। আর যারা বিপদে পড়ে টাকা দিতে পারছে না, তাদের কোনোভাবে টেনে তোলা যায় কি-না- এ নিয়ে কাজ করতে হবে। তবে একতরফাভাবে ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে গেছে, বিষয়টা তেমন নয়। ব্যাংকও কিছু কিছু ক্ষেত্রে দায়ী।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির জন্য এককভাবে কোন কারণকে দায়ী করা যাবে না। এক সময় ছিল কাগজপত্র ছাড়াই বা জাল কাগজপত্র দাখিল করে নামে-বেনামে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। এই দুর্নীতির সঙ্গে ব্যাংকার এবং ব্যবসায়ীদের পারস্পারিক যোগসাজশ রয়েছে। আইন-কানুন পরিবর্তন এবং আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুসরণের ফলে নামে-বেনামে ঋণ নেওয়ার সুযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তবে দুর্নীতি বন্ধ হয়নি। এখন দুর্নীতি হচ্ছে রাজনৈতিক প্রভাবে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারে এবং ব্যাংকের মালিকদের দৌরাত্ম্যে।
খেলাপি ঋণের প্রভাব কোথায় এই প্রশ্নের জবাবে ব্যাংকার ও সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংকের টাকা মূলত জনগণের আমানত। এই আমানতের তুছরুপ হচ্ছে। যে পরিমাণ ঋণ খেলাপি হচ্ছে ওই পরিমাণ টাকা বেহাত হচ্ছে, ওই ঋণের বিপরীতে ব্যাংক কোন আয় করতে পারছে না, আবারও খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। এতে ঋণ কার্যক্রমে ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এই ব্যয় বৃদ্ধির ফলে আমানতের সুদ হার কমছে, ঋণের সুদ হার বাড়ছে এবং বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশও কমে যাচ্ছে। শুধু লাভবান হচ্ছেন দুর্নীতিবাজরা।
এ বিষয়ে ব্যাংকের এমডিদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান এবং মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা এখন খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া মানে আমরা যে টাকা বিনিয়োগ করেছি, তা আটকে যাওয়া। এর নানামুখী প্রভাব আছে। এ বিনিয়োগের জন্য ব্যাংককে কর দিতে হয়। সুদ স্থগিত থাকে। আবার এ জন্য ব্যাংককে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। ফলে ব্যাংকের মুনাফা কমতে থাকে। আবার এ টাকা ব্যবহারের মধ্যে না থাকায়, নতুন করে ঋণ দেওয়া যায় না। ফলে আমানতের ওপর চাপ পড়ে। এতে করে ব্যাংকের নিরাপত্তা সঞ্চিতিতে ঘাটতি হয়, মূলধনেও চাপ পড়ে। এটা একটা চক্রের মতো। পুরো ব্যাংকই খেলাপি ঋণের কারণে চাপে পড়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতার পর সব ব্যাংক জাতীয়করণ করা হলো। ১৯৮৩ সালে বেসরকারি ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়। তখন কোনো আইন-কানুনই ছিল না। এ সময়ে ঋণ খারাপ হওয়া শুরু করে। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু নীতিমালা তৈরি করল। তখন সরকারি ব্যাংকই বাজার নিয়ন্ত্রণ করত। অনভিজ্ঞতা, দীর্ঘমেয়াদি ঋণ, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাসহ নানা কারণেই খেলাপি ঋণ তৈরি হলো। তখন কেউ টাকা ফেরত না দিয়েও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতেন। ফলে টাকা ফেরত না দেওয়ার একটা সংস্কৃতি চালু হয়ে গেল। একসময় সরকারি ব্যাংকের তুলনায় বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ অনেক কম ছিল। সরকারি ব্যাংকের টাকা ফেরত না দিলে বেসরকারি ব্যাংকের টাকা কেন দিতে হবে, পরে এমন মনোভাব চলে এল। আবার অনেকেই নানান ছাড় নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের পরে টাকা শোধ করছেন। আবার যিনি নিয়মিত শোধ করছেন, তিনি কোনো ছাড় পাচ্ছেন না। ফলে ব্যবস্থাটা এমন দাঁড়িয়ে গেছে, নিয়মিত ঋণ শোধ করা ভালো গ্রাহকের জন্য এটা একধরনের শাস্তি। এ জন্য পদ্ধতিগত বড় পরিবর্তন আনতে হবে।
ঋণখেলাপিদের বড় ধরনের শাস্তি দিতে হবে, অথবা সামাজিকভাবে তাঁদের একঘরে করতে হবে। তাতে তাঁরা একটা বড় ধাক্কা খাবেন, সবাই সতর্ক হবেন। এ ধাক্কাটা দিতেই হবে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী মুনাফার প্রবণতার কারণেও যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই না করে ঋণ দেওয়া হয়েছে। এর ফলেও অনেক ঋণ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
ঋণ খেলাপি সংস্কৃতিতে চক্রকার মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। আবার যারা ঋণ খেলাপি তারাও রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে ব্যাপক প্রভাবশালী। তাই ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াটা হয়ে ওঠেনি কখনো; কিন্তু ঋণ খেলাপির মারাত্মক চক্রাকার প্রভাব থেকে বাঁচাতে বিভিন্ন সময় ছাড় দিতে নানা ধরনের কৌশলী নিয়ম-কানুন তৈরি করেছে সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই কৌশলী নীতিগুলোর মূল্য উদ্দেশ্যে ছিল কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কম দেখিয়ে ব্যাংকগুলোকে বাঁচানো এবং আন্তর্জাতিক আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে ব্যাংকগুলোকে সক্ষম রাখা। আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুসারে যেসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেশি, ওই সব ব্যাংক বিদেশি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে না।
দেশের ব্যাংকগুলোর জন্য সর্বপ্রথম ব্যাংক কোম্পানি আইন করা হয় ১৯৯১ সালে। ওই আইনের ফলে ২০০৩ সালে সর্বপ্রথম ঋণ অবলোপন সুবিধা চালু করা হয়। এর আগে কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল তার মোট ঋণের ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত। অবলোপন করার অর্থ হচ্ছে, খেলাপি ঋণ ব্যাংকের নিয়মিত হিসাব থেকে ছেঁটে ফেলা। ফলে রাতারাতি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ব্যাপকহারে কমে যায়; কিন্তু আদায় হয়নি এক পয়সাও। সর্বশেষ হিসাব অনুসারে ব্যাংকগুলো ৫০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে।
প্রভাবশালী ঋণ খেলাপিদের জন্য বড় ধরনের সুবিধা দেওয়া হয় ২০১৫ সালে। ওই বছরে ৫০০ কোটি টাকার বেশি খেলাপি আছে এমন গ্রাহকদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ১২ ও ১৮ বছরের জন্য খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ পান প্রভাবশালীরা। ওই সুযোগে দেশের ১১টি প্রভাবশালী গ্রুপ ১৯ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ পুনর্গঠন করে নেন। সুবিধা নিয়ে আবার তারা খেলাপি হয়ে গেছেন। আবার তারা নতুন সুবিধার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আবেদন করেছেন।
ঋণ খেলাপিদের জন্য গণছাড় দেওয়া হয় ২০১৯ সালে। এক বছরে ঋণ পরিশোধের জন্য এক্সিট সুবিধা দেওয়া হয়। এতে আগের সব সুদ মওকুফ করা হয়। আর ঋণের সুদহার ১২/১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ঋণ খেলাপিদের জন্য করা হয় ৯ শতাংশ। ঋণ পরিশোধের সময় দেওয়া হয় ১০ বছর। ওই সুবিধার আওতায় ৫৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ণ করা হয়। ওই বছরে শিথিল করা হয় খেলাপি ঋণের নীতিমালাও। এসব সুবিধার পরও খেলাপি ঋণ বাড়ছে। কালের পরিক্রমায় ব্যাংক সংখ্যা বেড়ে এখন ৬১। আর খেলাপি ঋণও লাখ কোটি টাকার বেশি।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, ঋণ শ্রেণীকরণ সুবিধার মেয়াদ না বাড়ালে অন্তত ৫০ শতাংশ ব্যবসায়ী খেলাপি হবেন। মহামারিকালীন মন্দা কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সহায়তা এখন আরও বেশি দরকার। তা না হলে, ব্যবসা বাণিজ্য ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কঠিন হয়ে পড়বে।