ফুলের রাজ্যে ব্যস্ততা, ২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির আশা

গোলাম মোস্তফা মুন্না, যশোর
প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১১:৫৯

গোলাপ মাথায় এক ফুল চাষি। ছবি : যশোর প্রতিনিধি
শীতের বিদায় ঘণ্টা বাজবে একদিন পরেই। দরজায় কড়া নেড়ে হাতছানি দিচ্ছে ঋতুরাজ বসন্ত। ইংরেজি ফেব্রুয়ারি মাসেই পড়েছে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিবস। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, পহেলা ফাল্গুন বা বসন্তবরণ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই তিনটি দিবসেই ফুল অতি প্রয়োজনীয়।
পহেলা ফাল্গুন বসন্তকে বরণ করে নিতে রঙিন ফুলের জুড়ি নেই। বিশ্ব ভালবাসা দিবসে প্রিয়জনকে দেয়া গোলাপের সুঘ্রাণে ভালবাসা বেড়ে যায় বহুগুণ। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষা শহীদদের স্মরণে দেয়া হয় পুস্পার্ঘ্য।
এ কারণে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে ফুলের রাজধানী খ্যাত যশোরের গদখালীজুড়ে উৎসবের আমেজ বয়ে চলে। ফলে তিন দিবস ঘিরে গদখালী ফুলের বাজার জমজমাট হয়ে উঠেছে। রীতিমতো ফুলের রাজ্যে চলছে ব্যস্ততা। এতে করে করোনার ক্ষতি পুষিয়ে লাভের স্বপ্ন দেখছে ফুলচাষিরা।
পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা যায়, মানভেদে গোলাপ বিক্রি হচ্ছে প্রতিপিস ১৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত। যা মাসখানেক আগেও বিক্রি হয়েছে ১ থেকে ৩ টাকা। জারবেরা প্রকারভেদে ৮ থেকে ১২ টাকা। রজনীগন্ধা ৮ টাকা, গ্লাডিওলাস ১৪ থেকে ১৭ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া গাঁদা ফুল বিক্রি হচ্ছে প্রতি হাজার পাঁচ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত। কামিনীপাতা তাড়ি ৪০০ টাকা। ফুলের এমন দামে বেজয় খুশি চাষিরা।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির তথ্যমতে, যশোরে ফুল চাষি রয়েছে প্রায় ছয় হাজার। তারা অন্তত ১৫শ’ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রকার ফুল চাষ করেন। ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী, পানিসারা, নাভারণ, নির্বাসখোলার বিভিন্ন মাঠে অন্তত ১১ ধরণের ফুল উৎপাদন করা হয়। বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, জিপসি, রডস্টিক, কলনডালা, চন্দ্র মল্লিকাসহ বিভিন্ন ধরনের ফুল শোভা পাচ্ছে। এসব ফুল উৎপাদন করে সারাদেশের মানুষের মন রাঙাচ্ছেন এখানকার চাষিরা। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলের ফুলচাষিরাই দেশের ৭০ভাগ ফুলের চাহিদা মেটায়।
সাম্প্রতিক সময়ে ঠান্ডার দেশের দামি টিউলিপ ফুল চাষ করে সবাইকে অবাক করে দিয়েছেন ফুলচাষি ইসমাইল হোসেন। তার পাঁচ শতক জমিতে ফুটেছে বিভিন্ন রঙের সাত প্রকারের টিউলিপ ফুল।
তিনি জানান, জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে তার জমিতে টিউলিপ ফুটেছে। ভালবাসা দিবসে এসব ফুল বিক্রি করা হবে। করোনা আর ঘুর্ণিঝড় আম্ফানের রেশ কাটিয়ে উঠে চাষিরা আশার আলো দেখছিলেন। তবে অসময়ের বৃষ্টিতে অনেক ফুল নষ্ট হয়ে গেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গদখালীর বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে শুধু ফুল আর ফুল। ফেব্রুয়ারির তিন দিবসকে ঘিরে ফুলচাষিরা বাড়তি পরিচর্যায় ব্যস্ত। চোখ ধাঁধানো গোলাপ বাগানে ফুলগুলোতে সাদা ক্যাপ পরিয়ে রাখা হয়েছে।
গদখালীর ফুলচাষি জাহিদুল ইসলাম জানান, তিনি প্রায় তিন বিঘা জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির ফুল চাষ করেন। এবার অন্য বছরের তুলনায় বেচাকেনা অনেক ভাল। ফুলের দামও ভাল পাওয়া যাচ্ছে। স্কুল-কলেজ খোলা থাকলে বেচাকেনা আরও বেশি হতো।
পানিসারা গ্রামের ফুল ব্যবসায়ী মনিরুজ্জামান জানান, ফুলের দাম বেশি। পাইকারী বাজারে চাহিদাও অনেক বেশি।
পটুয়াপাড়া গ্রামের ফুলচাষি রিজাউল ইসলাম চার বিঘা জমিতে গোলাপের চাষ করেছেন। তিনি বলেন, ফুল যাতে দেরিতে ফোটে সেজন্য গোলাপের কুঁড়িতে ক্যাপ পরিয়ে রাখা হয়। এজন্য বাড়তি তিন থেকে চার টাকা খরচ হয়। ভালবাসা দিবসকে টার্গেট করে সেই ফুল বিক্রি করতে পারলে বেশি দামে বিক্রি করা যায়।
হাড়িয়া নিমতলা এলাকার তরুণ ফুল চাষি রাসেল হোসেন জানান, তাদের দেড় বিঘা জমিতে গোলাপের চাষ রয়েছে। আগে থেকেই কুঁড়িতে ক্যাপ লাগিয়ে রাখার কারণে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই ফুল বিক্রি করা হচ্ছে। বর্তমানে গোলাপের দামও অনেক ভাল। তাদের অন্তত এইবার এক লাখ টাকা লাভ হবে।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সাবেক সভাপতি আব্দুর রহিম জানান, বিভিন্ন কারণে এবার ফেব্রুয়ারিতে ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে তিন দিবসে অন্তত ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হতে পারে। তবে অসময়ের বৃষ্টিতে অনেক ফুল নষ্ট হয়ে গেছে, গোলাপের পাঁপড়ি ঝরে পড়ছে। এজন্য চাহিদা অনুযায়ী ফুল সরবরাহে ত্রুটি হতে পারে। বাজারে এখন দামও অনেক ভাল। পহেলা ফাল্গুন ও ভালবাসা দিবস যত নিকটে আসবে ফুলের দামও তত বাড়বে।
ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ হাসান পলাশ জানান, গদখালীকে বলা হয় ফুলের রাজধানী। এই অঞ্চলের ফুল ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষের মনের খোরাক মেটাচ্ছে। এই অঞ্চলের ফুল চাষিরাই দেশের ৭০ভাগ ফুলের চাহিদা মেটায়। সরকারিভাবে ফুল চাষিদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করা হচ্ছে। নতুন নতুন জাতের ফুল চাষের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে টিউলিপ চাষে সফলতা এসেছে।