Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

ঘুরে দাঁড়াচ্ছে শ্রমবাজার

Icon

সেলিম আহমেদ

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২২, ১০:২৪

ঘুরে দাঁড়াচ্ছে শ্রমবাজার

প্রতীকী ছবি

করোনা মহামারির রেশ কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বৈদেশিক শ্রমবাজার। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে বইছে সুবাতাস। দীর্ঘ দিন থেকে যেসব দেশ বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিত না, তারাও শ্রমিক নিতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। এর মধ্যে চলতি বছরের প্রথম চার মাসে রেকর্ড পরিমাণ জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে। একই সময়ের আগের বছরের তুলনায় ১৩৫ দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি শ্রমিক দেশের বাইরে গেছেন।

পুরুষের সাথে নারী শ্রমিকের বিদেশযাত্রাও রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। শ্রমশক্তি রপ্তানির সুযোগ বাড়ায় রেমিট্যান্স আয় বাড়ারও প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর এ জন্য আগামী বাজেটেও রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়াতে প্রণোদনা ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। তবে অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বাজার ধরে রাখতে বেশ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। দক্ষ কর্মী পাঠানোর বিকল্প নেই। তাই দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে সরকারকে আরো উদ্যোগী হতে হবে।

এ প্রসঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, করোনা মহামারি কাটিয়ে বর্তমানে বিদেশে কর্মী গমনের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন দেশ থেকে কর্মী নিয়োগের চাহিদাপত্র আসছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের হার কোভিড-পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে এসেছে। এই প্রবাহ চলমান থাকলে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে। আমরা শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী শ্রমিকদের দক্ষ করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি। নানামুখী প্রশিক্ষণের উদ্যোগ চলমান।

বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক শহিদুল আলম বলেন, সরকার আশা করছে চলতি বছরে রেকর্ড পরিমাণ শ্রমিক বিদেশ গমনের সুযোগ পাবে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় পৃথিবীর সব দেশেই জনশক্তির চাহিদা বেড়েছে। সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে আসছে। 

তিনি আরো বলেন, চলতি বছরে যে পরিমাণ শ্রমিক বিদেশ পাঠানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, তার চেয়ে দ্বিগুণ পাঠানো সম্ভব হয়েছে। এখনো বিভিন্ন দেশের শ্রমিকদের চাহিদাপত্র আসছে। এটি সারা বছরই অব্যাহত থাকতে পারে।

শহিদুল আলম আরো বলেন, শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করা হচ্ছে। শ্রমিকদের দক্ষ বানাতে ইতিমধ্যে দেশের ৭০টি কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ চলছে। শুধু রাজধানীতেই ৩টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। বেশি আয়ের জন্য দক্ষ শ্রমিক গড়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ জন্য প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমিকরা উন্নত দেশগুলোতে গিয়ে খরচের তুলনায় বেশি আয় করতে পারবে। গ্রিস, ইতালি ও রোমানিয়ার মতো উন্নত দেশে নতুন করে শ্রমিক পাঠানোর সুযোগ তৈরি হচ্ছে। আর শ্রমিক নিয়োগে ঝামেলা, ঝঞ্ঝাট এবং ভোগান্তি অবসানে অনলাইন ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে।

জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার বলেন, জনশক্তি রপ্তানিতেও সুবাতাস বইছে। গত চার মাসে আগের বছরে একই সময়ের তুলনায় রেকর্ড পরিমাণ শ্রমিক দেশের বাইরে গেছেন। তিন বছর পর মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয়েছে; ফের শ্রমিক যাবে সেখানে। ডিসেম্বর মাসে চুক্তি হলেও এখন পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো শুরু হয়নি। বেশ কিছু জটিলতার কারণে শ্রমিক পাঠানো যাচ্ছে না। দেশের স্বার্থে দ্রুত জটিলতা কাটানোর দাবি জানান তিনি।

বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, গত চার মাসে (জানুয়ারি থেকে এপ্রিল) মোট ৪ লাখ ২৬ হাজার ৫৫৮ শ্রমিক বাইরের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ছেড়েছে, যা গত বছরে একই সময়ের তুলনায় ১ লাখ ৮১ হাজার ৪০ জন বেশি। অর্থাৎ আগের চেয়ে একই সময়ের তুলনায় ১৩৫ দশমিক ৬১ শতাংশ শ্রমিক দেশ ছেড়েছে। তাদের মধ্যে জানুয়ারিতে ১ লাখ ৯ হাজার ৬৯৮ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৯২ হাজার ৫৬৯ জন, মার্চে ১ লাখ ২০ হাজার ৩১৬ জন এবং এপ্রিলে ১ লাখ ৩ হাজার ৯৭৫ শ্রমিক বিদেশে গেছেন। গত চার মাসের শ্রমিক রপ্তানির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে ২০২২ সালে রেকর্ড পরিমাণ জনশক্তি রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে দেশের রিজার্ভ আরো সমৃদ্ধ হবে।

বিএমইটির তথ্যানুসারে, ২০২২ সালের চার মাসে মূলত বিশ্বের ২০টি দেশে শ্রমিক কাজে গেছে। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই গেছে ২ লাখ ৬৮ হাজার ৫৮৪ জন, যা মোট জনশক্তি রপ্তানির ৬১ শতাংশ। এছাড়া ওমানে ৫৬ হাজার ৮৩০, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৫১ হাজার ৫৩১ জন, সিঙ্গাপুরে ১৮ হাজার ৬০৬, জর্দানে ৬ হাজার ৬৫৪ এবং কাতারে ৬ হাজার ২৪১ জন গেছেন। করোনা পরিস্থিতিতে গত ২০২১ সালে মোট ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ শ্রমিক বিদেশে গিয়েছিল। গত ২০২০ সালে ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯ শ্রমিক বিদেশে গিয়েছিল। এছাড়াও কাতার, জর্ডান, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে আরো বেশি শ্রমিক পাঠাতে ইতিমধ্যেই জোর কূটনৈতিক চেষ্টা চালানো হয়েছে। এসব দেশগুলোও বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দীর্ঘ দিন থেকে বন্ধ থাকা মালেশিয়ার শ্রমবাজারও খোলার প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। মালেশিয়ার শ্রমবাজার খুললেই একসাথে কয়েক লাখ শ্রমিক কাজের সুযোগ পাবেন।

এ দিকে ২০২২ সালের প্রথম চার মাসেই নারী জনশক্তি রপ্তানি আগের মাসের তুলনায় বেড়েছে। সব মিলিয়ে গত চার মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে গেছেন ৪৩ হাজার ৬১০ নারী। মহামারি করোনার প্রভাব কেটে যাওয়ায় পুরুষের পাশাপাশি নারীদের চাহিদাও বেড়েছে। ডাটাবেজ তৈরি হওয়ায় শ্রমিক রপ্তানিতে হয়রানি ও প্রতারণার প্রবণতা কমে আসছে।

বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে গেছেন ৪৩ হাজার ৬১০ নারী। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে গেছেন ১০ হাজার ২৯০ জন, ফেব্রুয়ারিতে গেছেন ১০ হাজার ৬১২ জন। মার্চে এই সংখ্যা বেড়ে হয় ১১ হাজার ২১১ জন। সর্বশেষ এপ্রিল মাসে এই সংখ্যা আরেকটু বেড়ে হয়েছে ১১ হাজার ৪১৭ জন।

পুরুষের মতোই সৌদি আরবেই সবচেয়ে বেশি নারী শ্রমিক গেছে। গৃহকর্মী থেকে শুরু করে নানা খাতে দেশটিতে এই চার মাসে গেছেন ২৭ হাজার ৩১৯ নারী কর্মী, যা মোট নারী জনশক্তি রফতানির ৬২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নারীর গন্তব্য ছিল ওমান। এই দেশটিতে গেছেন ৭ হাজার ৯৭৫ নারী কর্মী, যা মোট নারী জনশক্তি রপ্তানির ১৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। আর তৃতীয় সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৪৯৮ বা প্রায় ১৫ শতাংশ নারী গেছেন জর্দানে। কাতারে ৭৯০ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৬৪৯ জন, লেবাননে ৮৮ জন, কুয়েতে ৩৭ জন, মরিশাসে ২৮ জন, সিঙ্গাপুরে ২৪ জন ও লন্ডনে গেছেন ১৩ নারী কর্মী। এর বাইরে মালয়েশিয়ায় ৮ জন, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৭ জন, জাপানে ৩ জন, ইতালিতে ২ জন এবং ১৬৯ নারী কর্মী কাজ নিয়ে গেছেন অন্যান্য দেশে। মূলত তৈরি পোশাক শিল্প, নার্সিং ও গৃহকর্মীর কাজগুলোর জন্য বাংলাদেশ থেকে নারী কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হয় বেশি।

একসময় বাহরাইন, লেবানন, জর্দান, হংকংয়ের মতো দেশে প্রচুর নারীকর্মী পাঠানো হতো। তবে সেসব দেশে জনশক্তি রপ্তানি একরকম বন্ধই হয়ে গেছে। গত চার মাসের হিসাবে দেখা গেছে, বাহরাইনে একজন নারী কর্মীও পাঠানো যায়নি। লেবাননে ৮৮ জন গেলেও লিবিয়া, ইরাক, ব্রুনেই, হংকং, সুদান ও সাইপ্রাসে একজন নারী কর্মীও যাননি।

প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালে অতিমারী করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর মুখ থুবড়ে পড়ে বাংলাদেশের শ্রমবাজার। অতিমারীর আগের বছর ২০১৯ সালে ৭ লাখ ১৫৯ কর্মী কাজ নিয়ে বিদেশে গিয়েছিলেন। করোনার ধাক্কায় ২০২০ সালে তা ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯ জনে নেমে আসে। তবে ২০২১ সালে ধীরে ধীরে তা আবার আলোর মুখ দেখতে শুরু করে, যা বছরজুড়েই গতিতে ছিল। মহামারির আগের সময়ের গতিতে ফিরেছে। বিএমইটির রেকর্ড অনুযায়ী, ১৯৭৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মোট ১ কোটি ৩০ লাখ বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজে গেছেন। ২০২২ সালে শ্রমিক রপ্তানির সব রেকর্ডই ছাড়িয়ে যাবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫