Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

নিম্ন-মধ্যবিত্ত উপেক্ষিত, বাজেটে বিত্তবানের স্বার্থ

Icon

হামিদ সরকার

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২২, ১২:০৪

নিম্ন-মধ্যবিত্ত উপেক্ষিত, বাজেটে বিত্তবানের স্বার্থ

প্রতীকী ছবি

২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বিশেষ কিছু মানুষ ও শ্রেণিকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে। যাদের টাকা-পয়সা আছে, উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী, যারা টাকা পাচার করে, এই শ্রেণির জয় হয়েছে।

গরিবের জন্য বাজেটে তেমন কিছু নেই। সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত হয়েছে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী মধ্যবিত্ত সমাজ। বিদেশে পাচারকৃত টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তা নৈতিকতা পরিপন্থী এবং সৎ করদাতাদের জন্য চপেটাঘাত। যে অর্থ তারা বিদেশে পাচার করেছে, সুবোধ বালকের মতো ৭ শতাংশে কর দিয়ে সেটা ফেরত আনবে এটা চিন্তা করাই বোকামি। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে সাড়ে ৭ শতাংশ ঊর্ধ্বমুখী প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং ৫ দশমিক ৬ শতাংশে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা অবাস্তব। সাধারণ মানুষের আয় কমে যাওয়ার পরও করমুক্ত আয়ের সীমা গত তিন বছর ধরে একই অবস্থানে রাখা হয়েছে। সুদ পরিশোধেই যাবে ৮০ হাজার কোটি টাকার বেশি।  

সার্বিক পর্যালোচনায়, কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তনের স্লোগান দিয়ে ৯ জুন সংসদে নতুন অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বার্ষিক উন্নয়ন খাতে বাজেটে বরাদ্দ হলো ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। চার লাখ ১৮ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকার এই পরিচালন ব্যয় চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১২ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি। আর এই টাকার প্রায় অর্ধেক, ১ লাখ ৮৫ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা খরচ হবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, পেনশন ও সুদ মেটাতে। বাজেটে সুদ পরিশোধ বাবদ খরচ হবে ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৩ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ। আর বিদেশি ঋণের সুদ ৭ হাজার ২শ কোটি টাকা। ফলে ঋণনির্ভর হওয়াতে ব্যাংকিং খাত নিয়ে সতর্ক অবস্থানে থাকা জরুরি। আর ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের মূল বাজেটে সুদ পরিশোধ বাবদ ৬৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে হয়েছে ৭১ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭০ হাজার ৬০৬ কোটি টাকার সুদ পরিশোধ করেছিল সরকার।

খরচের ক্ষেত্রে আরো দেখা যায়, প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য ৭৪ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা রাজস্ব বাজেটের ১৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ। যেখানে ২০২১-২২ অর্থবছরের মূল বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ ছিল ৬৯ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা আরো বেড়ে ৭১ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকায় উন্নীত হয়।

আর ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের জন্য বেতন-ভাতার জন্য ৫৮ হাজার ৮৯১ কোটি টাকা খরচ করেছিল সরকার। এছাড়া নতুন বাজেটে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন বাবদ ব্যয় হবে ৩১ হাজার ৩৭ কোটি টাকা, যা বাজেটের ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। যেখানে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের মূল বাজেটে এ খাতের জন্য ২৮ হাজার ২০৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল; সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে ২০২০-২১ অর্থবছরে পেনশন বাবদ ১৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল সরকারের। অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হয়নি। এই সীমা আগের মতোই তিন লাখ টাকা পর্যন্ত রাখা হয়েছে। 

মূল্যস্ফীতির অনুমিত ভুল : মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের জন্য প্রধান সমস্যা। প্রস্তাবিত বাজেটের বিশ্লেষণে প্রকাশ পেয়েছে যে, মূল্যস্ফীতি ও বৈশ্বিক অর্থনীতির নানা চাপ রয়েছে। মূল্যস্ফীতির যে হিসাব করা হয়, তাতে গলদ আছে। মূল্যস্ফীতি নির্ধারণের অনুমিত ভুল। বর্তমান চড়া মূল্যের বাজারে অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে রাখার যে প্রাক্কলন করেছেন, তা বাস্তবতার সাথে কোনো মিল নেই। যেখানে বর্তমানে ৬ দশমিক ২ শতাংশ মূল্যস্ফীতির হার বর্তমান রয়েছে। বিশ্ব এই সংকটকালে কীভাবে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে আটকে রাখবেন অর্থমন্ত্রী বোধগম্য হচ্ছে না দেশের অর্থনীতিবিদদের। তাহলে প্রশ্ন জাগে, অর্থমন্ত্রীর হাতে কি জাদুর কাঠি আছে, যার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনবেন। বাজেটে মূল্যস্ফীতি কথাটি অনেকবার এলেও, এটি নিয়ে অর্থমন্ত্রীর পদক্ষেপ পর্যাপ্ত নয়। কর কাঠামোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে কর প্রত্যাহারের প্রস্তাবনা যথেষ্ট নয়। অনেক পণ্যেই কর রয়ে গেছে। বাজেটে গম ছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যে কর ছাড় নেই। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে সত্যিকারের মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের উপরে। আগামী বছর তা ৫ দশমিক ৬০ শতাংশে নামিয়ে ফেলা যাবে- এমনটি বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত আন্তঃব্যাংক লেনদেনের চেয়ে কার্ব মার্কেটে ডলারের দরের পার্থক্য ৮ থেকে ১০ টাকা রয়ে গেছে। এই পার্থক্য কমাতে না পারলে ডলার-সংকট কাটবে না। ডলার-সংকট না কাটলে আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এবং মূল্যস্ফীতি ও বাণিজ্য ঘাটতি কমানো যাবে না।

অবাস্তব প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা : বাজেটে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে, সেটা বাস্তবসম্মত নয়। করোনাপরবর্তী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব ও বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও বলেছে যে, প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি হবে না। এ দিকে ৭ জুন বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭ শতাংশ হতে পারে। তবে বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়তে পারে। চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি খানিকটা বাড়বে। দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি এবং সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ তেলসমৃদ্ধ আরব দেশগুলোর অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ায় সেখান থেকে রেমিট্যান্স আসা বেড়ে যাওয়াই এর কারণ বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক।

বাজেট ঘাটতি ঋণনির্ভর : প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে বড় অঙ্কের টাকা ব্যাংক থেকে ধার নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। ঘাটতি মেটাতেই সরকারকে দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে ধার করতে হবে। অর্থমন্ত্রী পরিকল্পনা করেছেন, বৈদেশিক উৎস থেকে মোট এক লাখ ১২ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা ধার নেবেন। সেখান থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকা আগের ধারের কিস্তি পরিশোধে খরচ করবেন। ফলে সরকারের নিট বৈদেশিক ধারের আকার হবে ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। আর ঘাটতির বাকি এক লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা নেওয়া হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ধার হিসেবে। এর মধ্যে ব্যাংক থেকে ধার নেওয়া হবে এক লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা, ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে নেওয়া হবে ৪০ হাজার ১ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়া হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৫ হাজার ১ কোটি টাকা অন্যান্য উৎস থেকে নেওয়ার পরিকল্পনার ছক কষছেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। সরকার এই খাত থেকে বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাবে। সর্বশেষ মুদ্রানীতিতে বেসরকারি ঋণ যা নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা অর্জিত হয়নি। সে ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কম হলে প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। কারণ প্রবৃদ্ধি বাড়াতে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই।

অর্থপাচারকারীদের সুযোগ : বিদেশে পাচার করা টাকা কর দিয়ে দেশে আনার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করা হয়। এটা অনৈতিক। এটা থেকে কোনো অর্থ আসবে না। কারণ যারা দেশের টাকা বাইরে পাচার করে, তারা দেশে ফিরে আসার জন্য টাকা পাচার করে না। ৭ শতাংশ কর দিয়ে দেশে টাকা ফিরিয়ে এনে তারা ধরা দেবে না। কালো টাকা সাদা করার জন্য গত ৫০ বছরে দেশে ১৭ বার এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তাতে মাত্র ১৪ হাজার কোটি টাকা সাদা করেছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে সেটাও বিদেশ থেকে কেউ ফিরিয়ে আনবে না।

বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ কমেছে : বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ কমেছে। এই খাতে সরকারি পেনশনকে যুক্ত করার কারণে বরাদ্দটা বড় দেখায়। এটাকে যদি এই খাত থেকে আলাদা করা হয়, তাহলে প্রকৃতপক্ষে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ কমেছে। যেখানে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছর এই খাতে বরাদ্দ ছিল ১৪.৯ শতাংশ, সেটা প্রস্তাবিত বাজেটে হয়েছে ১২.৬২ শতাংশ। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ছে না। বাস্তবায়ন হারও এই মন্ত্রণালয়ের কম। বরাদ্দও ক্রমেই কমছে। এই মুহূর্তে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা দরকার। কোভিডের কারণে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, শিক্ষা খাতে তা কাটিয়ে উঠতে হলে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দকে প্রথমবারের মতো জিডিপির ২ শতাংশের নিচে নেমে ফেলা হয়েছে। এটা এবার ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এটা লুকানোর জন্য শিক্ষার সাথে প্রযুক্তি যোগ করে বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে। অথচ ইউনেসকো শিক্ষায় জিডিপির বরাদ্দ ৬ শতাংশের উপরে নেওয়ার কথা বলেছে।

অর্থনীতিবিদরা কে কীভাবে দেখছেন : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পাচারের টাকা দেশে আনার সুযোগ দেওয়ায় টাকা পাচার আরো বাড়বে। আগে কেউ টাকা পাচার করার আগে চিন্তা-ভাবনা করত। এখন মনে করবে, টাকা তো ইচ্ছে করলেই ফেরত আনা যাবে। এর মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের উৎসাহ দেওয়া হলো। আর সৎ করদাতাদের বঞ্চিত করা হলো। তার মতে, বাজেটে সাড়ে ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে, সেটা বাস্তবসম্মত নয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও বলেছে যে, প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি হবে না।

বাজেটে ঢালাওভাবে সব কোম্পানির জন্য উৎসে কর বাড়ানো ঠিক হয়নি বলে মন্তব্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও উন্নয়ন সমন্বয়ের সভাপতি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আতিউর রহমানের। তার মতে, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের উপর কর বৃদ্ধি এবং পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ রাখার যে প্রস্তাবগুলো বাজেটে আছে, সেগুলো অবশ্যই পুনর্বিবেচনা করা উচিত। তিনি আরো বলেন, এছাড়া এ মুহূর্তে জরুরি নয়, এমন ব্যয় আরো সংকুচিত করে সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বরাদ্দ আরো বাড়ানোর পক্ষে মত দেন তিনি।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫