Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দে শুভঙ্করের ফাঁকি

Icon

এম ডি হোসাইন

প্রকাশ: ২১ জুন ২০২২, ১১:৪০

সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দে শুভঙ্করের ফাঁকি

প্রতীকী ছবি

সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে প্রতিবারের বাজেটে বড় আকারের বরাদ্দ দেখানো হচ্ছে। নতুন বাজেটে এ খাতের সঙ্গে সামঞ্জস্য নেই এমন কমপক্ষে ১৩টি খাত রয়েছে। আবার যেসব খাত সামাজিক নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেগুলোর মধ্যে ৯ খাতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক নিরাপত্তায় কম বরাদ্দের লজ্জা থেকে বাঁচতে বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা থেকে সরকার প্রতিবছর এ খাতে অতিরঞ্জন করে যাচ্ছে।

২০২১-২২ অর্থবছর থেকে ২০ লাখ ৮ হাজার প্রতিবন্ধী ব্যক্তি মাসে ৭৫০ টাকা হারে ভাতা পেয়ে আসছেন। তাদের সংখ্যা আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩ লাখ ৫৭ হাজার বাড়িয়ে ২৩ লাখ ৬৫ হাজার করা হচ্ছে। জনপ্রতি মাসিক ভাতাও ১০০ টাকা বাড়িয়ে করা হচ্ছে ৮৫০ টাকা। এ ছাড়া মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির আওতায় চলতি অর্থবছরে উপকারভোগী রয়েছেন ১০ লাখ ৪৫ হাজার। আগামী অর্থবছরে উপকারভোগীর সংখ্যা ২ লাখ ৯ হাজার বেড়ে দাঁড়াবে ১২ লাখ ৫৪ হাজার। এ খাতে নতুন অর্থবছরে বরাদ্দ হয়েছে ১ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা।

এ ছাড়া আগামী অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের কর্মসূচির সংখ্যা ১২৩টি থেকে কমিয়ে ১১৫টি করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। নতুন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। এই বরাদ্দ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৩ দশমিক ১১ শতাংশ। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক বজলুল হক খন্দকার বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোকে ধরা হলে বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৫ থেকে ১ দশমিক ৭ শতাংশের বেশি হবে না। আসলে সরকারের প্রবণতা হচ্ছে এ খাতকে বড় করে দেখানো। আশা করেছিলাম, এবার কিছুটা হলেও সংশোধন হবে। সরকার এ খাতে যে বরাদ্দের কথা বলে থাকে, সেটাও বিবেচনায় নিলে দেখা যাচ্ছে জিডিপির তুলনায় বরাদ্দ কমে গেছে।

এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে দরিদ্র বয়স্ক, বিধবা, স্বামী নিগৃহীত ও অসচ্ছল প্রতিবন্ধীদের ভাতা দিয়ে সহায়তা করা হয়। এ ভাতার পরিমাণ বাড়েনি। অন্যদিকে সরকারের খোলা বাজারে (ওএমএস) চাল ও আটা বিক্রি বাবদ বরাদ্দ কমানো হয়েছে। কর্মসৃজন কার্যক্রমেও বরাদ্দ কমানো হয়েছে। 

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বরাদ্দ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১১৫টি কর্মসূচিতে এক লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা প্রস্তাবিত বাজেটের ১৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদন জিডিপির ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল এক লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা  বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা জিডিপির ৩ দশমিক ১১ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে ৭ লাখ ৫৩ হাজার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী ও তাদের পরিবারের পেনশন বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৮ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। চার ভাগের এক ভাগ এ খাতে ব্যয় হবে। চলতি বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ২৬ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। 

সঞ্চয়পত্রের সুদের হারে সামাজিক নিরাপত্তা প্রিমিয়াম হিসেবে আগামী অর্থবছরের বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৭ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা। এ থেকে প্রায় ২২ লাখ সঞ্চয়পত্রের গ্রাহক উপকৃত হবেন। বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে এখানে বরাদ্দ ছিল ৬ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে যা বাড়িয়ে ৭ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা করা হয়েছে। আগামীতে বরাদ্দ আরও বাড়ানো লাগতে পারে। কারণ চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে বেশি ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। গত কয়েক বছর ধরে সঞ্চয়পত্রের সুদহারে সামাজিক নিরাপত্তা প্রিমিয়াম হিসেবে বাড়তি একটা অংশ যোগ করে মোট সুদহার নির্ধারণ করে সরকার। সামাজিক প্রিমিয়ামের মুনাফার অংশ সামাজিক নিরাপত্তার বরাদ্দের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। বাজেটের প্রাক্কলনের চেয়ে এ খাতে ব্যয় বেশি হচ্ছে। 

এ দিকে খাদ্য নিরাপত্তা ও কর্মসৃজন কর্মসূচিতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৫ হাজার ৪০৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা। বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ আছে ১৫ হাজার ৭৬৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এ খাতে ৩৫৯ কোটি টাকা বরাদ্দ কমেছে।  

এ বিষয়ে পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, বাজেট বক্তৃতায় মূল্যস্ফীতি ও তার প্রভাব সম্পর্কে যেভাবে বলা হয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বরাদ্দে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। পেনশন এবং সঞ্চয়পত্রের সুদ সামাজিক নিরাপত্তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্র্ণ নয়। এমনকি কৃষি খাতের ভর্তুকিও এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কৃষি ভর্তুকির সুবিধা ধনী, দরিদ্র সব শ্রেণির কৃষকই পায়। অন্যদিকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, ওএমএসসহ সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তায় বরাদ্দ বিদায়ী অর্থবছরের তুলনায় ৬ শতাংশ কমানো হয়েছে। এখনকার সময়ে এটি খুবই বিপরীতমুখী অবস্থান। এ সময়ে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার ছিল। কারণ উচ্চ মূল্যষ্ফীতির কারণে বিশাল জনগোষ্ঠী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।  

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘প্রতিবছর সামাজিক সুরক্ষার আওতা ও বাজেট বরাদ্দ উভয় বৃদ্ধি করে যাচ্ছি। এ খাতে বাজেট বরাদ্দ ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৮ গুণ বেড়েছে। দরিদ্র ও অসহায় মানুষকে সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আনার জন্য দুর্যোগপ্রবণ এলাকা, দরিদ্রতম এলাকা এবং জনসংখ্যার ঘনত্বের অনুপাতের মতো বিষয়গুলো নেওয়া হচ্ছে বিবেচনায়। দুস্থ-প্রবীণ ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষায় বয়স্ক ভাতা দেওয়া হচ্ছে এবং বিধবা ও স্বামী নিগৃহীত ভাতার ক্ষেত্রে প্রবীণ নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। বর্তমানে ৫৭ লাখ ১ হাজার জন বয়স্ক ব্যক্তি মাসিক ৫০০ টাকা হারে ভাতা পাচ্ছেন। এ খাতে আগামী অর্থবছরের জন্যও ৩ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।

অর্থমন্ত্রী জানান, “প্রতিবছর সামাজিক সুরক্ষার আওতা ও বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করে যাচ্ছি। শহর এলাকায় ‘শহর সমাজসেবা কার্যক্রম’ এবং ‘অ্যাসিডদগ্ধ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পুনর্বাসন কার্যক্রম’ নামে মোট চারটি সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।”

অর্থ বিভাগ আগামী অর্থবছরের জন্য যে ১১৫টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির তালিকা তৈরি করেছে, তাতে দেখা যায় অবসরভোগী সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন বাবদ ২৮ হাজার ৩৭ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ ৭ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা, করোনার কারণে ব্যাংকের সুদ মওকুফ ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য সুদ ভর্তুকি বাবদ ৫ হাজার কোটি টাকা এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বৃত্তির জন্য ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এগুলোকেও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বলছে সরকার।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, অবসরপ্রাপ্তদের পেনশন সামাজিক সুরক্ষার আওতাভুক্ত করার পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি আছে। অনেকে বলছেন এটা সামাজিক সুরক্ষার মধ্যে পড়ে না। কারণ সরকারি চাকরিদের অবস্থা অন্যদের তুলনায় ভালো। আবার বয়স্ক অবসরপ্রাপ্ত মানুষদের জীবনযাপনের জন্য বিকল্প কিছু নেই। অন্যদিকে গ্রামের বয়স্ক নাগরিকদের জন্য বয়স্ক ভাতা থাকলেও, শহরের বয়স্ক নাগরিকদের জন্য সরকারের বিশেষ কোনো কর্মসূচি নেই। এ জন্য সঞ্চয়পত্রের সুদহারে সামাজিক নিরাপত্তা বাবদ একটা প্রিমিয়াম যোগ করা হয়েছে। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫