Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

স্ট্যাগফ্লেশনের ঝুঁকি

৫ ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ বিশ্বব্যাংকের

Icon

অরুন্ধতী বসু

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২২, ১৪:০৬

৫ ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ বিশ্বব্যাংকের

বিশ্বব্যাংক। ফাইল ছবি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো বিশ্বব্যাপী গভীর মন্দা সৃষ্টি হয় কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবে। মহামারি সংকট শুরুর দুই বছরেরও বেশি সময় অতিক্রম করে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আবারও বিপদে বিশ্ব অর্থনীতি। এবার অর্থনীতি একই সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং মন্থর প্রবৃদ্ধির সম্মুখীন। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস। 

গত সপ্তাহে গ্লোবাল ইকোনমিক্স প্রসপেক্ট প্রকাশ করেছে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপ। প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক কর্ণধার বলেছেন, বৈশ্বিক মন্দা এড়ানো সম্ভব হলেও, ‘স্ট্যাগফ্লেশনের’ চাপ কয়েক বছর বহন করতে হতে পারে অর্থনীতিকে। স্ট্যাগফ্লেশন এমন এক অর্থনৈতিক অবস্থা, যেখানে কোনো অর্থনীতি একই সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, নিম্ন প্রবৃদ্ধি ও উচ্চ বেকারত্বের চক্রে আটকা পড়ে। ম্যালপাসের মতে, পণ্য সরবরাহ বৃদ্ধি করা না হলে, নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলো অর্থনীতিতে বিপাকে পড়বে সবচেয়ে বেশি।

ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও উচ্চ সুদহারের প্রকোপে চলতি বছর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এমন পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংকও।

প্রতিবেদনে বলা হয়,  ২০২২ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি খুব শ্লথ হবে। এবার প্রবৃদ্ধি হবে ২ দশমিক ৯ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। জানুয়ারিতে এ বছর ৪ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক; কিন্তু বৈশ্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানুয়ারির তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ কমিয়েছে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, প্রয়োজনীয় সুদহার স্বাভাবিক অবস্থায় নিতে কাজ করছেন নীতিনির্ধারকেরা। সেই সঙ্গে ক্রমবর্ধমান জ্বালানি ও খাদ্যমূল্য- সার্বিক পরিস্থিতি নিম্ন প্রবৃদ্ধির জন্য দায়ী। উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোতে এরই মধ্যে আয় বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমে রাস টেনে ধরেছে কোভিড-১৯। এখন ইউক্রেন যুদ্ধ অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্য চ্যালেঞ্জ আরও জটিল করে তুলেছে। চলতি বছর তারা ৩ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হবে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। এ হার ২০২১ সালের হারের অর্ধেক এবং ২০১১ ও ২০১৯ সালের মধ্যকার গড় প্রবৃদ্ধির তুলনায় অনেক কম। 

মধ্য আয়ের দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি হ্রাসেরও পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এ হার জানুয়ারির পূর্বাভাসের চেয়ে কমিয়েছে ১ দশমিক ৩ শতাংশ পয়েন্ট। ২০২৩ সালে প্রায় ৪০ শতাংশ উন্নয়নশীল দেশ অর্থনীতিতে মাথাপিছু প্রকৃত আয় প্রাক-কোভিড-১৯ স্তরের নিচে থাকবে। অনেক দেশের জন্যই মন্দা এড়ানো কঠিন হবে। বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোতে সার ও বিদ্যুৎ গ্রিড ব্যবহারে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্বব্যাপী বড় পরিসরে উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। গড় হারের উপরে মূল্যস্ফীতি এবং গড় হারের নিম্নে প্রবৃদ্ধির প্রভাব আগামী কয়েক বছর বিশ্ব অর্থনীতিতে থাকবে। ১৯৭০ সালের পর এমনটি আর দেখা যায়নি। 

২০২১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যবর্তী সময়ে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির গতি ২ দশমিক ৭ শতাংশ পয়েন্ট কমবে বলে পূর্বাভাসে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক, যা ১৯৭৬-১৯৭৯ সময়ের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি কম। বিশ্বের বেশিরভাগ অংশে দুর্বল বিনিয়োগের কারণে পুরো দশকজুড়েই প্রবৃদ্ধির হার নিম্ন থাকবে, আশঙ্কা বিশ্বব্যাংকের। অনেক দেশে বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। পণ্য সরবরাহও ধীরগতিতে বাাড়ানো হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। 

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের বরাতে প্রজেক্ট সিন্ডিকেট জানায়, এ পরিস্থিতিতে মূল্য বৃদ্ধির হার প্রত্যাশিত সময়ের তুলনায় বেশি সময় ধরে থাকার ঝুঁকি থাকছে। উপরন্তু উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোয় জনঋণের বোঝা রেকর্ড মাত্রায় পৌঁছেছে। এসব ঋণের বেশিরভাগেরই প্রাপক বেসরকারি ঋণদাতা। আর এগুলোর বেশিরভাগই পরিবর্তনশীল সুদহার সংশ্লিষ্ট। আর সুদহার যে কোনো সময়ই হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে। 

ঋণ সংকট আগে নিম্ন আয়ের অর্থনীতিতে সীমাবদ্ধ ছিল; কিন্তু এখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কঠিন হওয়া এবং মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে মধ্য আয়ের অর্থনীতির দেশগুলোতে।

যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য উন্নত দেশগুলোর সুদহার বৃদ্ধি বিশ্বব্যাপী ঋণ গ্রহণের খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটি উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য মাথাব্যথার আরেকটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া ঋণের মাত্রা না কমলেও মহামারির সংকট মোকাবেলায় ২০২০ সালে প্রদত্ত বেশিরভাগ আর্থিক সহায়তা আগামী দুই বছর দেওয়া হবে। ম্যালপাসের মতে, সুদহার বাড়ানো হলে এর বিকল্প বৈষম্য কমিয়ে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে উপার্জন বাড়ানোর ব্যবস্থায় গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এতে সরবরাহ শৃঙ্খল (সাপ্লাই চেইন), ক্ষুদ্র ব্যবসা ও মূলধন-বরাদ্দ প্রক্রিয়া শক্তিশালী হবে। 

বর্তমান পরিস্থিতি সত্তরের দশকের তুলনায় সম্পূর্ণ আলাদা। সত্তরের দশকে মার্কিন ডলারের মান দুর্বল ছিল; কিন্তু এখন ডলার রয়েছে শক্তিশালী অবস্থানে। ১৯৭৩-৭৪ এবং ১৯৭৯-৮০ সালে জ্বালানি তেলের দাম যথাক্রমে চারগুণ ও দ্বিগুণ বাড়ে। আর বর্তমানে মূল্যস্ফীতি সমন্বয় শর্তে তেলের দাম বেড়েছে ১৯৮০ সালের মতোই। এতে এখন শীর্ষ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যালেন্স শিট শক্তিশালী হয়ে উঠলেও, সত্তরের দশকে এমন পরিস্থিতি ঝুঁকির কারণ ছিল তাদের জন্য।  

মজুরি ও শ্রমবাজার সংশ্লিষ্ট কয়েকটি কাঠামোগত দৃঢ়তার কারণে সত্তরের দশকের তুলনায় আধুনিক বিশ্বের অর্থনীতিগুলো বেশি নমনীয়। আর স্ট্যাগফ্লেশন সমস্যা এড়াতে ভালো অবস্থানে রয়েছেন নীতিনির্ধারকরা। মুদ্রা-নীতি কাঠামো এখন আরও বিশ্বাসযোগ্য, উন্নত এবং অনেক উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো একইভাবে স্পষ্ট মূল্য-স্থিতিশীলতার নীতিমালার অধীনে কাজ করে। 

স্ট্যাগফ্লেশনের ঝুঁকি কমাতে বিশ্বব্যাপী নীতিনির্ধারকদের লক্ষ্যযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন হবে।  বৈশ্বিক সংকটের এই অভূতপূর্ব যুগে নীতিনির্ধারকদের পাঁচটি ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে হবে, বলছেন ডেভিড ম্যালপাস।

প্রথম ক্ষেত্রটি হচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতির পরিমাণ কমানোর পদক্ষেপ গ্রহণ। এর জন্য যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় জরুরিভিত্তিতে খাদ্য, চিকিৎসা ও আর্থিক সহায়তা নিশ্চিতে উদ্যোগ নিতে হবে। সেই সঙ্গে শরণার্থী এবং অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতদের আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিতসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। 

দ্বিতীয়ত নীতিনির্ধারকদের জ্বালানি ও খাদ্যমূল্য বৃদ্ধিতে লাগাম টানার ব্যবস্থা করতে হবে। এটি প্রধান খাদ্য ও জ্বালানি পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। তাই ভবিষ্যতে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিতের ঘোষণাও পণ্যগুলোর দাম ও মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে। সব দেশের উচিত সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীকে শক্তিশালী করা। সেই সঙ্গে রপ্তানি ও আমদানি বিধিনিষেধ এড়ানো, যা দাম বৃদ্ধি করে।

তৃতীয় ক্ষেত্র, ঋণ-মুক্তির প্রচেষ্টা। এই প্রচেষ্টা জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। মহামারিপূর্ববর্তী সময়েও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে ঋণ বিষয়ক দুর্বলতা তীব্র ছিল। ঋণ সংকট মধ্য আয়ের দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ায় উল্লেখযোগ্য ত্রাণের অভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে ঝুঁকি বাড়বে।

চতুর্থত, কর্মকর্তাদের অবশ্যই স্বাস্থ্য খাতে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। সেই সঙ্গে কোভিড-১৯ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কোভিড-১৯ টিকা সরবরাহ নিশ্চিতসহ স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে টিকাদানের প্রচেষ্টা সম্প্রসারণ করার বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে।

পঞ্চম ক্ষেত্রটি হচ্ছে, স্বল্প কার্বন জ্বালানির উৎসে রূপান্তর আনা। জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমাতে বিদ্যুৎ গ্রিড, পরিষ্কার জ্বালানির উৎস এবং বৃহত্তর জ্বালানি দক্ষতায় আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন। জাতীয় নীতিনির্ধারকদের উচিত জলবায়ু নিয়ন্ত্রক কাঠামো তৈরি, প্রণোদনা কাঠামো সমন্বয় এবং ভূমি-ব্যবহার বিধিগুলোকে শক্তিশালী করা।

দীর্ঘমেয়াদি সমৃদ্ধি পুনরুদ্ধারের বিষয়টি নির্ভর করে দ্রুত প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধার এবং আরও স্থিতিশীল, নিয়ম-ভিত্তিক নীতি পরিবেশের উপর। যুদ্ধ থেমে গেলে ইউক্রেনের অর্থনীতির পুনর্গঠনসহ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা দ্বিগুণ হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস।

তবে বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের জন্য নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই অন্যান্য হুমকি প্রশমনে পদক্ষেপ নিতে হবে। এই হুমকিগুলোর মধ্যে খাদ্য ও জ্বালানি মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ক্রমাগত স্থবিরতাজনিত চাপ, ক্রমবর্ধমান বিপজ্জনক ঋণের বোঝা বৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও অস্থিতিশীলতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উদ্ভূত অগণিত ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫