Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

বিদ্যুৎ নিয়ে ব্যবসা করে ‘চুনোপুঁটি’ থেকে ‘রাঘববোয়াল’ যারা

Icon

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:৪১

বিদ্যুৎ নিয়ে ব্যবসা করে ‘চুনোপুঁটি’ থেকে ‘রাঘববোয়াল’ যারা

সামিট, ইউনাইটেড, সিকদার, ওরিয়ন, কনফিডেন্স, বাংলাট্রাক ও ডরিন গ্রুপের লোগো। ছবি: সংগৃহীত

বিদ্যুৎ নিয়ে ব্যবসা করে চুনোপুঁটি থেকে রাঘববোয়ালে পরিণত হয়েছে দেশের ছয়টি কোম্পানি। কোম্পানিগুলো হলো, সামিট, ইউনাইটেড, সিকদার, ওরিয়ন, কনফিডেন্স, বাংলাট্রাক ও ডরিন গ্রুপ। তাদের বিদ্যুৎকেন্দ্র সামলাতে এই ছয় কোম্পানিকে ৪২১ কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগকে।

বিদ্যুৎকেন্দ্র চলুক আর না চলুক প্রত্যেক মাসে তাদেরকে এই টাকা দিতেই হবে বিদ্যুৎ বিভাগকে। এরমধ্যে বেশির ভাগ বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে ১৫ বছর মেয়াদী। অর্থাৎ আগামী ১৫ বছরেও এই ক্যাপাসিটি চার্জ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না বিদ্যুৎ বিভাগ। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তারা এতোই প্রভাব বিস্তার করছে অনেক সময় অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের দেখানো পথেই ছুটছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। 

বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারি খাতে সবার শীর্ষে রয়েছে সামিট গ্রুপ। কোম্পানির মালিকানাধীন ১৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা হচ্ছে দুই হাজার ২৫৫ মেগাওয়াট। বাংলাদেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৯ শতাংশ তার হাতে। শিগগিরই আরো এক হাজার মেগাওয়াট যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। দেশের পুঁজিবাজারে সামিট পাওয়ার, সামিট পোর্ট অ্যালায়েন্স ও খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (কেপিসিএল) নামে তিনটি কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে।

সামিট গ্রুপের মালিকানাধীন ১৮ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জের তথ্য পাওয়া গেছে। ১৩২৩ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সাত বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপরীতে প্রতিমাসে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে ১২৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকার উপরে। ওই সাত বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপরীতে গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে বিদ্যুৎ বিভাগ ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে এক হাজার ১৬১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।

এদিকে সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খানের নাম আবারো সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় উঠে এসেছে। ওই তালিকায় আজিজ খান রয়েছেন ৪২ নম্বরে। তাঁর সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ৯৫ টাকা ধরে হিসাব করলে বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। ফোর্বসের হিসাবে এবারই প্রথম আজিজ খান সিঙ্গাপুরের বিলিয়ন ডলারের (১ বিলিয়নে ১০০ কোটি) সম্পদশালী ব্যক্তিদের ক্লাবে ঢুকলেন। গত বছর তথা ২০২১ সালে তার সম্পদের পরিমাণ ছিল ৯৯ কোটি মার্কিন ডলার। ২০১৯ সালের পর থেকে তাঁর সম্পদের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। তাতেই তিনি এ বছর বিলিয়ন ডলারের ধনীর ক্লাবে স্থান করে নিয়েছেন।

তবে কয়েক বছর আগেও এতো বড় ব্যবসায়ী ছিলেন না তিনি। কিন্তু এখন সিঙ্গাপুরের মতো জায়গাতেও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর তালিকায় উঠে আসলেন আজিজ। সিঙ্গাপুরের সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল ভারতের বিদ্যুৎখাতেও বিনিয়োগ করেছে। কোরিয়া, নেপাল ও ভুটানে বিনিয়োগের আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। দেশের বাইরে কোম্পানি খোলা ও টাকা নিয়ে যাওয়া নিয়ে তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ রয়েছে। অনেক সময় ওভার ইনভয়েজ ও আন্ডার ইনভয়েজের মাধ্যমে টাকার পাচারের অভিযোগ রয়েছে সামিট গ্রুপের বিরুদ্ধে। বিদ্যুতের পাশাপাশি জ্বালানি খাতেও এখন একচেটিয়া দৌরাত্ম্য লক্ষ্যণীয়।

ফোর্বসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৬৩ বছর বয়সী আজিজ খান এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা। সামিটের অধীনে দেশে বিদ্যুৎ খাতের যত ব্যবসা বা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোর মালিকানায় বা হোল্ডিং কোম্পানি সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল। আর সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত। এ কারণে বাংলাদেশে ব্যবসা করলেও যেহেতু সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত, তাই এটির সম্পদের হিসাব করা হয় সিঙ্গাপুরে।

এদিকে, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাট্রাকের মালিকানায় রয়েছে ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রতি মাসে ১০৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা দিতে হচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে। গত ৯ মাসে বাংলাট্রাকের ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৬৫ কোটি ১৩ লাখ টাকা।

ইউনাইটেড গ্রুপের মালিকানাধীন সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে ১০৮ কোটি টাকা। বিগত ৯ মাসে কোম্পানিটি ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ পেয়েছে ৯৮৫ কোটি ১৫ লাখ টাকার উপরে।

ওরিয়ন গ্রুপ মালিকাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে চারটি। যার বিপরীতে প্রতিমাসে ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করছে ৩০ কোটি ৫০ লাখ টাকার উপরে। ৯ মাসের চার্জ এসেছে ২৭৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।

কনফিডেন্স গ্রুপের রয়েছে ৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বগুড়ায় দুটি এবং রংপুরে অবস্থিত একটি। প্রত্যেকটির উৎপাদন ক্ষমতা ১১৩ মেগাওয়াট করে। তেলভিত্তিক ওই তিন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাসিক ক্যাপাসিটি চার্জ ৩৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা।  ৩টির উৎপাদন ক্ষমতা এক হলেও চার্জের ব্যাপক তারতম্য লক্ষণীয়। রংপুরের বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য মাসে ১১ কোটি ৭৭ লাখ ৭১ হাজার ৪৩০ টাকা দেওয়া হলেও একই ক্ষমতার বগুড়া ইউনিট-২ এর বিপরীতে দেওয়া হচ্ছে ১৩ কোটি ২২ লাখ ২৯ হাজার ৩৮৮ টাকা।

সিকদার গ্রুপের মালিকাধীন রয়েছে ২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ দুই বিদ্যুৎ কেন্দ্র খুব একটা চালাতে দেখা না গেলেও প্রতিমাসে গুণতে হচ্ছে ১২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। গত ৯ মাসে ১১৫ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ হয়েছে।

ডরিন গ্রুপের মালিকানায় রয়েছে ৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এগুলো টাঙ্গাইল, ফেনী ও নরসিংদীতে অবস্থিত। প্রত্যেকটির উৎপাদন ক্ষমতা ২২ মেগাওয়াট করে। ডরিনকে প্রত্যেক মাসে ক্যাপাসিটি বাবদ দিতে হচ্ছে ৬ কোটি ২৬ লাখ টাকার উপরে। ঝিনাইদহ-২ আসন থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের দলীয় সংসদ সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকীর ওই কোম্পানিটি শেয়ারবাজারেও কারসাজির দায়ে অভিযুক্ত। এক দফায় জরিমানাও গুণতে হয়েছে।

এর বাইরে প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের দেশ এনার্জি, এনার্জিপ্যাক, ডরিন গ্রুপ, সিনহা গ্রুপ, রিজেন্ট গ্রুপ, আনলিমা গ্রুপ রয়েছে বিদ্যুৎ খাতে।

কোম্পানিগুলোর সাথে সম্পাদিত চুক্তিকে অসামঞ্জস্য বলে মন্তব্য করেছেন ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম। তিনি বলেছেন, চুক্তির স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যারা চুক্তি করেছেন তাদের সততা ও দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। যথাযথভাবে চুক্তি না হওয়া বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। এখন দফায় দফায় দাম বাড়িয়ে গ্রাহকদের উপর বোঝা চাপানো হচ্ছে। আদৌ এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা ছিল কিনা সেটাও ক্ষতিয়ে দেখা দরকার।

বিদ্যুৎ বিভাগের এক তথ্যে দেখা গেছে, গত ৯ মাসে ৬১টি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ১১ হাজার ৩৪৯ কোটি ৬৭ লাখ ১৬ হাজার টাকা। একই সময়ে ১২টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের বিপরীতে দিতে হয়েছে ৬৭৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, ১৬টি সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে দেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা।

অন্যদিকে ২০২০-২১ অর্থ বছরের হিসেবে দেখা গেছে ৬২টি আইপিপি ও এসআইপিপি ১১ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। ওই অর্থ বছরে ১৯টি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে চার্জ দিতে হয়েছে এক হাজার ২৭৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারি, বেসরকারি, ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুৎসহ সব মিলিয়ে ১৮ হাজার ৯৭৭ কোটি ২১ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের গবেষণা ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহম্মদ হোসাইন বলেন, ক্যাপাসিটি চার্জ সম্পর্কে অনেকের ধারণা পরিষ্কার নয়। বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের খরচ রয়েছে, সেই বিনিয়োগের সাথে ব্যাংক ঋণের অন্যান্য চার্জ যুক্ত হয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করা হয়। অনেক দেশেই এই চর্চা রয়েছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫