রপ্তানি বাণিজ্যে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া নিয়ে শঙ্কা

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮:৪৭

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে তোলা ছবি। ফাইল ছবি
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস রপ্তানি খাত। দেশের প্রধান বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র। সাম্প্রতিককালে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মৌলিক মানবাধিকার, সুশাসন ও শ্রম অধিকার ইস্যুতে বিদেশি রাষ্ট্রগুলো বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। এসব দেশের ভোক্তাদের বিভিন্ন সংগঠন এবং ঢাকায় দায়িত্বরত কূটনীতিকরা প্রায়ই মানবাধিকার ও সুশাসন নিয়ে কথা বলছেন। তাদের সাথে সাথে তাদের দেশের ব্র্যান্ড এবং ক্রেতারাও এ বিষয়ে সরব। অন্যদিকে রপ্তানি বাণিজ্যে বাংলাদেশের প্রতিযোগী বিভিন্ন দেশ প্রধান বাজারকেন্দ্রিক দেশ ও অঞ্চলের সাথে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করছে। এই দিকেও বাংলাদেশ এখনো সুবিধে করতে পারছে না। সব মিলিয়ে রপ্তানি বাণিজ্যে বাংলাদেশ চ্যালেঞ্জের মুখে। পড়েছে।
জানা গেছে, ভিয়েতনাম ইইউর সাথে এফটিএ করেছে। এর যার মাধ্যমে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে পূর্ণ শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে দেশটি। যুক্তরাজ্যের সাথে ভারতের এফটিএ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। বাংলাদেশ এই দিক থেকে শক্ত অবস্থানে পৌঁছাতে পারেনি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, সুশাসন, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতাসহ বিভিন্ন প্রশ্নে জিএসপি সুবিধা স্থগিত বা বাতিল হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রানা প্লাজা ধসের পর যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি স্থগিত করে। শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের সময়েও দেশটির জিএসপি বাতিল করা হয়। ফলে মৌলিক মানবাধিকারের বিষয়গুলোতে সরকারকে গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। একইসাথে ভূরাজনৈতিক কৌশলও এর সাথে জড়িত। এসব বিবেচনায় ইউরোপ ও আমেরিকার সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সরকারকে সতর্ক নজর রাখতে হবে।
সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির এক সংলাপে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. রেহমান সোবহান মানবাধিকার এবং শ্রম অধিকার বিষয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের বর্তমান পর্যায়ে কমপ্লায়েন্স (যথার্থ মান পরিপালনে সম্মতি) প্রশ্নে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। ইইউর নতুন জিএসপি পর্যালোচনা এবং যুক্তরাষ্ট্রে স্থগিত জিএসপি ফেরত পাওয়া বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানের শ্রম অধিকার নিশ্চিত করাসহ অন্যান্য শর্ত পরিপালন করতে হবে। সরকারের দায়িত্বই এখানে মুখ্য।
জিএসপি প্লাস: অর্থনৈতিক অগ্রগতি হওয়ায় উত্তরণের প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হবে। ইইউ জোটের ২৭টি দেশে ২০২৯ সাল পর্যন্ত এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ)-এর অধীন যুদ্ধাস্ত্র ছাড়া সব পণ্যে শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত থাকবে। ইবিএ হলো সবচেয়ে সহজ শর্তে শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা, যা এলডিসিগুলো পেয়ে থাকে।
‘জিএসপি প্লাস’ নামে ইইউর আরেকটি শুল্ক্কমুক্ত সুবিধার স্কিম রয়েছে, যা পেতে ৩২টি কনভেনশন অনুমোদন করার শর্ত রয়েছে। গত জুন পর্যন্ত ২০টি কনভেনশন অনুমোদন করেছে বাংলাদেশ। বাকি ১২টিও অনুমোদন করতে হবে- যার মধ্যে রয়েছে বেসামরিক এবং রাজনৈতিক অধিকার, নির্যাতন এবং অন্যান্য নৃশংসতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, নারীর বিরুদ্ধে সব ধরনের বৈষম্য দূর করা ইত্যাদি।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষক এবং গবেষণা সংস্থা র্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সুশাসন ও মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারের পাশাপাশি পরিবেশ সামাজিক ও সুশাসন (ইএসজি) কমপ্লায়েন্সের শর্ত যদি জুড়ে দেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়বে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ যদি ইইউতে ‘জিএসপি প্লাস’ সুবিধা পায়, তা রক্ষা করার জন্য জোর প্রস্তুতি থাকতে হবে। মানবাধিকার, শ্রম অধিকার কিংবা অন্যান্য যেকোনো ইস্যুতে সন্তোষজনক অগ্রগতি মনে না করলেও যেকোনো সময় শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা প্রত্যাহারের এখতিয়ার রয়েছে ইইউর।
জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, শ্রম অধিকার প্রশ্নে এখনো সন্তোষজনক অগ্রগতি হয়নি। ট্রেড ইউনিয়ন গঠন এবং কার্যক্রম পরিচালনা এখনো অবাধ নয়। এসব বিষয়ে মালিক ও শ্রমিকদেরও আরো দায়িত্বশীল হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
কার্বন কর: ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ৫৫ শতাংশ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্যে কমিয়ে আনার লক্ষ্যে একটি রূপরেখা তৈরি করেছে ইইউ। ২০১৯ সালে নেওয়া সমন্বিত এ রূপরেখার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ইইউ গ্রিন ডিল’। এর আওতায় কয়েকটি খাতের পণ্যের ওপর কার্বন কর আরোপ করার কাজ চলছে। ২০২৬ সালে আমদানি পর্যায়ে এ শুল্ক আরোপ করা হবে। আটটি আমদানি পণ্যের ওপর এ কর আরোপ করা হতে পারে। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা প্রাথমিক তালিকায় রাখা হয়নি। তবে ঝুঁকি তালিকায় রয়েছে। নিকট-ভবিষ্যতে বাংলাদেশের এই তিন পণ্যে কার্বন কর আরোপ হতে পারে। এ কর আরোপ হলে কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে বাংলাদেশকে।
ড. আব্দুর রাজ্জাক এ বিষয়ে বলেন, ইইউর কার্বন কর আরোপের আগেই বাংলাদেশে কার্বন কর আরোপ এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন। এর বাইরে অন্যান্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে। গত জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নেওয়া কয়েকটি ক্রেতা ব্র্যান্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়, পরিবেশসম্মত উৎপাদন ব্যবস্থা নেই এমন কারখানা থেকে পণ্য নেবেন না তারা।
কিছু সুবিধা আর থাকবে না: এলডিসি থেকে উত্তরণের পর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বাংলাদেশ। এলডিসি হিসেবে পাওয়া শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা আর থাকবে না। রপ্তানি উৎসাহিত করা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিতে নগদ সহায়তাও দেওয়া যাবে না। বর্তমানে তিন ধরনের কাঠামোতে ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা দেওয়া হয় তৈরি পোশাক রপ্তানিতে। আটটি পণ্যে ২০ শতাংশসহ ৩৮টি পণ্যে বিভিন্ন হারে নগদ সহায়তা রয়েছে। এসব বিধিবিধান পরিপালনের কারণে রপ্তানি সক্ষমতা কমতে পারে।
এলডিসি থেকে উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি, পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও তদারকিতে উচ্চ পর্যায়ের একটি জাতীয় কমিটি গঠন করেছে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস এই কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ এবং সরকারি-বেসরকারি গবেষণা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা রয়েছেন কমিটিতে। গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে সম্ভাব্য ক্ষতি এড়াতে বিভিন্ন দেশের সাথে এফটিএ এবং অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) করার বিষয়ে জোর তাগাদা দেওয়া হয়েছে। কর অব্যাহতি এবং আমদানি পর্যায়ে কর ছাড়ের মতো বিষয়গুলোতে কাজ শুরু করতে রাজস্ব প্রশাসনকে পরামর্শ দেওয়া হয়।
রপ্তানিকারকদের মতামত: পোশাক খাতে বৈশ্বিক এসব প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সবকটি সংশ্লিষ্ট কনভেনশন অনুস্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। ইইউর শর্ত মতো আন্তর্জাতিক ১২ কনভেনশনের বিষয়েও একটা সমাধানে আসা যায়। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসলেই কিছুটা উদ্বেগে আছেন তাঁরা। পণ্যের মানোন্নয়ন এবং মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার চেষ্টার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
পোশাক খাতের অপর সংগঠন বিকেএমইএর সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, বাংলাদেশের চেয়ে আরো নিচু মানের মানবাধিকার এবং সামরিক শাসনের দেশকে জিএসপি প্লাস সুবিধা দিয়েছে ইইউ। পাকিস্তানের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সুশাসন, গণতন্ত্র এবং সামরিক শাসনের সংকটের পরও যদি তারা জিএসপি প্লাস সুবিধা পায় তাহলে বাংলাদেশের না পাওয়ার অর্থ হবে রাজনৈতিক। তিনি বলেন, এই রাজনৈতিক কারণেই আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে ইইউ।
কার্বন কর সম্পর্কে তিনি বলেন, সর্বাধুনিক মানের পরিবেশসম্মত কারখানা এখন বাংলাদেশেই বেশি। এ নিয়ে চিন্তা করার কোনো কারণ নেই।