অর্থনীতির ক্রান্তিকালে দ্বিতীয় এলিজাবেথ যুগের অবসান

অরুন্ধতী বসু
প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৩:০৫

যুক্তরাজ্যের বর্তমান ব্যাংক নোটগুলোয় রানির প্রতিকৃতি রয়েছে। ছবি: সংগৃহীত
অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার ডামাডোলের মধ্যেই রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ যুগের অবসান হলো। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, মার্কিন ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের দরপতন এবং কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ মানের জীবনযাত্রায় যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির সংকট স্পষ্টভাবে তুলে ধরছে বিশ্বের কাছে। সমৃদ্ধি যেন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে দেশটির দিক থেকে, ক্রান্তিকাল উপস্থিত। এ পরিস্থিতিতে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুতে ঠিক মুহ্যমান থাকতে পারছে না দেশটি।
বেশ কিছু দিন ধরেই বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন রানি।
গত মঙ্গলবার, ৬ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের প্রথা ভেঙে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ পেতে স্কটল্যান্ডের বালমোরাল ক্যাসলে রানির কাছে যান লিজ ট্রাস। সাধারণত রানি লন্ডনে থাকেন, সেখানে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন হবু প্রধানমন্ত্রীরা। কিন্তু সম্প্রতি রানির হাঁটাচলায় সমস্যা হওয়ায় লিজ ট্রাসকে বালমোরালে যেতে হয়। প্রধানমন্ত্রী পদে অভিষিক্ত হওয়ার দুদিন পর গত ৮ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার রানির দেহাবসানের কয়েক ঘণ্টা আগে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বড় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানান লিজ ট্রাস। রানির মৃত্যুতে জাতীয় শোক ঘোষণা করেছে রিজ ট্রাস সরকার। শোক পালন করা হবে রানির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিন পর্যন্ত। বাকিংহাম প্রাসাদ এক ঘোষণায় জানিয়েছে, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে ১৯ সেপ্টেম্বর। সেদিন ব্রিটেনে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
সিএনএন বিজনেসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রানির মৃত্যুতে তার প্রতি সম্মান জানিয়ে যুক্তরাজ্যে বেশ কিছু দোকান ও খেলার স্থান বন্ধ রাখা হলেও ব্যবসা বাণিজ্য চলছে স্বাভাবিক গতিতেই। ইউরোপ ও এশিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রানির মৃত্যুর পরদিনও খোলা ছিল লন্ডনের আর্থিক বাজার। শোক যাপনকালেও পুঁজিবাজারে লেনদেন চালু রেখেছে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জ। শুধু শেষকৃত্যের দিনই বন্ধ রাখা হচ্ছে পুঁজিবাজার। রানির মৃত্যু কেন্দ্র করে শ্রমিক সংগঠনগুলো বিরতি দিয়েছে আন্দোলনে। ৯ সেপ্টেম্বর কমিউনিকেশন ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের শ্রমিক ধর্মঘট পালনের পরিকল্পনা ছিল। রানির প্রতি সম্মান জানিয়ে ওই ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়। ট্রান্সপোর্ট ইউনিয়নও তাদের কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করেছে। ব্রিটিশ একাডেমি অব ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন আর্টস সপ্তাহান্তে নির্ধারিত বার্ষিক প্রাক-এমি ইভেন্ট বাতিল করেছে। তবে লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ড থিয়েটারগুলো খোলা ছিল।
বেসরকারি ব্যাংক বেরেনবার্গের প্রধান অর্থনীতিবিদ হোলগার স্মিয়েডিংয়ের ভাষ্য, অর্থনীতিতে রানির মৃত্যুর প্রভাব খুবই নগণ্য। মানুষকে জ্বালানির উচ্চমূল্যের বোঝা থেকে রেহাই দিতে ইতোমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী। এ নিয়ে পরিকল্পনা ঘোষণা করার কয়েক ঘণ্টা পরই রানির মৃত্যুর খবর আসে। প্রথমত পরিবারের জ্বালানি ব্যয়ের সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন লিজ ট্রাস। এতে পারিবারিক জ্বালানি ব্যয় ২০২৪ সাল পর্যন্ত বার্ষিক ২ হাজার ৫০০ পাউন্ডের বেশি হবে না। স্বাভাবিকভাবেই এ জন্য সরকারকে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হবে।
বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, এ জন্য যুক্তরাজ্য সরকারকে ১৫ হাজার কোটি পাউন্ড ঋণ করতে হবে। তবে ভর্তুকির পরিমাণ নিয়ে মাথা ঘামাতে চান না প্রধানমন্ত্রী। ভর্তুকিকে এখনই অর্থের অঙ্কে পরিমাপ করতে চান না তিনি। বলেছেন, ‘এখন সময়টা অস্বাভাবিক, তাই ব্যবস্থাও নিতে হবে সে রকম।’
লিজ ট্রাসের এই পদক্ষেপের বড় দিক, শুধু পরিবার নয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও ভর্তুকি পাবে। তবে পরিবারের মতো তাদের দুই বছর ধরে এই ভর্তুকি দেওয়া হবে না, তারা ভর্তুকি পাবে ছয় মাসের জন্য। তবে অনেকের আশা ছিল, আরও কিছুটা সময়ের জন্য এই ভর্তুকি দেওয়া হবে। ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসের সবাই এই সহায়তা পাবেন আর উত্তর আয়ারল্যান্ডের জন্য দেওয়া হবে সমপরিমাণ সহায়তা।
ভর্তুকির পরিমাণ অনেক বেশি হলেও কিছু কিছু বিষয়ে উদ্বেগ থেকেই যাচ্ছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। তারা বলছেন, এই কর্মসূচির লক্ষ্যবস্তু সুনির্দিষ্ট নয়। অর্থাৎ যারা সবচেয়ে দুর্বল বা অরক্ষিত, তাদের অতিরিক্ত সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা নেই এতে। ফলে লাখ লাখ মানুষ এই শীতকালে জ্বালানি দারিদ্র্যের কবলে পড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আগের ব্যবস্থা অনুযায়ী, আগামী অক্টোবরে যুক্তরাজ্যে জ্বালানির মূল্যসীমা ৮০ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ার কথা ছিল। এতে সে দেশের পরিবারের বার্ষিক জ্বালানির ব্যয় দাঁড়াত ৩ হাজার ৫৪৯ পাউন্ড। এই বাস্তবতায় যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনের আশঙ্কা, সে দেশের কয়েক কোটি মানুষ শীতের সময় জ্বালানি দারিদ্র্যের কবলে পড়বে। এমনকি অনেক মানুষ সামগ্রিকভাবে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে। সে জন্য তিনি আগেই নতুন প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিশেষ জ্বালানি তহবিল গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিপুল অঙ্কের ভর্তুকি দিতে যাচ্ছেন।
যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ব্যাংক অব ইংল্যান্ড কীভাবে সরকারি ঋণের বিশাল বৃদ্ধিকে দেখছে তাও গুরুত্বপূর্ণ। বিনিয়োগকারীরাও যুক্তরাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে উদ্বিগ্ন। গত শুক্রবার ব্যাংক অব ইংল্যান্ড সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত এক সপ্তাহ স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির এ সংক্রান্ত বৈঠক হবে আগামী ২২ সেপ্টেম্বর। গত শুক্রবার প্রতি পাউন্ড বিক্রি হয় ১ ডলার ১৬ সেন্টে। গত সপ্তাহের শুরুতে ডলারের বিপরীতে পাউন্ড পৌঁছে ৩৭ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। পাউন্ডের দাম ১ ডলার ১৬ সেন্টে উন্নীত হওয়ার মধ্য দিয়ে দরপতনের ধারার গতি কিছুটা রোধ হয়।
তবে বৈশ্বিক সংকটে ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের দরপতন অব্যাহত থাকবে, জানিয়েছেন ফ্রান্সের বহুজাতিক ব্যাংকিং ও বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান সোসিয়েতে জেনারেলের অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক নীতির ম্যাক্রো স্ট্র্যাটেজিস্ট কিট জুকস। যুক্তরাজ্যের বর্তমান ব্যাংক নোটগুলোয় রানির প্রতিকৃতি রয়েছে। ব্যাংক অব ইংল্যান্ড বলেছে, নোটগুলোর ‘আইনি দরপত্র হতে চলেছে’। শোক যাপন শেষ হওয়ার পর এটি রাজা চার্লসের প্রতিকৃতিসহ নতুন নগদ মুদ্রণের পরিকল্পনা ঘোষণা করা হবে।