Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য করপোরেট দায়ী নয়

Icon

অরুন্ধতী বসু

প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৩:৫৩

উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য করপোরেট দায়ী নয়

গোটা বিশ্বকেই এখন মোকাবিলা করতে হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে। প্রতীকী ছবি

গোটা বিশ্বকেই এখন মোকাবিলা করতে হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে। এই তো, ২০২২ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে; এরপর খুব একটা কমেনি বলা চলে। এর আশপাশেই ঘোরাফেরা করছে।

মূল্যস্ফীতির দাপট কমাতে তৎপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ  (ফেড)। কিন্তু কিছুতেই রাশ টেনে ধরা যাচ্ছে না মূল্যস্ফীতির। আর মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ সব রকম পণ্যের দরবৃদ্ধি, ধারণা প্রায় সবার। 

পণ্যের ক্রমবর্ধমান দামের পেছনের মূল চালিকা শক্তি করপোরেট লোভ- এ যুক্তি দেন অনেকেই। তারা বলেন, কোম্পানিগুলোর পণ্যের দাম ও মুনাফা বাড়ানোর ক্ষমতা আগের দশকের তুলনায় বেশি। এর প্রভাবে মূল্যস্ফীতির হারও বাড়ছে। কিন্তু এই যুক্তির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন ইউরোপিয়ান সিস্টেম বোর্ডের অ্যাডভাইজরি সায়েন্টিফিক কমিটির ভাইস চেয়ার স্টিফেন জি চেচেটি এবং নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির লিওনার্ড এন স্টার্ন স্কুল অব বিজনেসের ক্লিনিক্যাল প্রফেসর ইমেরিটাস কারমিট এল সোয়েনহোলজ।

এই দুই বিশ্লেষক সিএনএনে লেখা এক নিবন্ধে বলছেন, গত কয়েক প্রান্তিকে পণ্যের ক্রমবর্ধমান দরে প্রতিফলন ঘটছে সংকটপূর্ণ শ্রমবাজার এবং মজুরি ও সুবিধাসহ শ্রমব্যয় বৃদ্ধির। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রমব্যয় ও উৎপাদন খরচ উঠিয়ে কিঞ্চিৎ মুনাফা অর্জনের কথা মাথায় রেখে পণ্যের দাম নির্ধারণ করে। চাহিদার সঙ্গে ওঠা-নামা করে প্রতিষ্ঠানগুলোর লাভ-লোকসানের খতিয়ান। বিক্রির অনুমোদন পেলে চাহিদা বিবেচনায় একটি প্রতিষ্ঠান মুনাফার উদ্দেশ্যে তাদের উৎপাদিত পণ্যটির দাম বাড়াবে। যখন এ প্রক্রিয়া শুধু একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা খাতে না হয়ে ক্রমাগত গোটা অর্থনীতি জুড়ে ঘটে তখনই উচ্চ মূল্যস্ফীতির আবির্ভাব হয়। 

কারও কারও যুক্তি, সাম্প্রতিক দশকগুলোয় মার্কিন অর্থনীতি সম্প্রসারণ করার জন্য কিছু প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান আরও সহজে মুনাফার অঙ্ক বাড়িয়েছে। এর ফলে করপোরেট ‘লোভস্ফীতি’ (গ্রিডফ্লেশন) হয়েছে। নিশ্চিতভাবেই বর্ধিত কেন্দ্রীকরণ এবং প্রতিযোগিতা কমার যথেষ্ট প্রমাণও রয়েছে। উপরন্তু ১৯৬০ সালের শুরু থেকে ২০১৯ সালের শেষ পর্যন্ত কর্মীদের ক্ষতিপূরণ প্রদানে ব্যবহৃত ব্যবসায়িক আয়ের অংশ প্রায় ১০ শতাংশীয় পয়েন্ট কমে হয়েছে ৫৭ শতাংশ। এতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফার অঙ্ক বেড়েছে। গুরুত্বপূর্ণভাবে, মূল্যস্ফীতি কম বা বেশি যা-ই হোক না কেন, শ্রমিকদের আয় এবং দৃঢ় মুনাফার ঘেরাটোপে এই দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন এসেছে। তদুপরি, লোভস্ফীতি থেকে এই সাম্প্রতিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে, এর প্রমাণ মেলে খুব কম ক্ষেত্রেই। মহামারির আগের দশকগুলোয় শ্রমব্যয় এবং মুনাফা উভয়ই মূল্যস্ফীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিল।

কিন্তু ২০২০-এর দশকটি একেবারেই ভিন্ন। আড়াই বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, শ্রমব্যয়ই প্রকৃত দোষী, মুনাফা নয়। মহামারি শুরুর পর থেকে শ্রমব্যয় বেড়েছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ দেওয়া যায়। দেশটিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্যের দাম বাড়ানোর প্রধান কারণ দুটি। প্রথমত সেখানকার বর্তমান শ্রমবাজার অত্যন্ত সংকটপূর্ণ। এখানে শ্রমিক ঘাটতি রয়েছে।  দেশটি ৩ দশমিক ৫ শতাংশ বেকারত্ব ও ৬ দশমিক ৬ শতাংশ কর্মখালির হারের সংমিশ্রণ। অভূতপূর্বভাবে প্রতি ব্যক্তির জন্য প্রায় দুটি কাজের দরজা উন্মুক্ত। ফলস্বরূপ, মজুরি এবং বেতন বার্ষিক ৫ দশমিক ৭ শতাংশ হারে বাড়ছে, যা বাড়ছে মহামারির আগের সময়ের তুলনায় দুই শতাংশীয় পয়েন্টেরও বেশি হারে।

দ্বিতীয়ত উৎপাদন কমে যাওয়ার পরও প্রতিষ্ঠানগুলো চলতি বছর দ্রুত নতুন কর্মী নিয়োগ করছে। তাই প্রতি ঘণ্টায় উৎপাদনের অনুপাতে উৎপাদনশীলতা কমছে। ফলে ইউনিটপ্রতি উৎপাদনে শ্রমব্যয় গত বছরের চেয়ে বেড়েছে ৯ শতাংশেরও বেশি, যা ৪০ বছরের মধ্যে আরেকটি রেকর্ড। কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ের সবচেয়ে বড় উপাদান শ্রম ক্ষতিপূরণ। শ্রমের ক্রমবর্ধমান খরচ মুনাফা কমিয়ে দেয়। এতে কোম্পানিগুলো পণ্যের দাম বাড়াতে উৎসাহী হয়। মহামারির আগের ৪০ বছর ধরে, প্রতি ঘণ্টায় উৎপাদনের হিসাব অনুযায়ী, শ্রম উৎপাদনশীলতা প্রতিবছর গড়ে ১ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। অর্থাৎ মাত্র ৩ দশমিক ৩ শতাংশ গড় মজুরি বৃদ্ধি ফেডারেল রিজার্ভের ২ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যের সঙ্গে সহজেই সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। যা-ই হোক, সাম্প্রতিক বার্ষিক মজুরি আগের তুলনায় তিন শতাংশীয় পয়েন্ট হারে বাড়ছে। শ্রমিক ঘাটতি উল্লেখযোগ্যভাবে না কমলে, শ্রমের মূল্যস্ফীতি কমার সম্ভাবনা নেই, এমনকি আরও বাড়তে পারে।

মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশে নামিয়ে আনার একমাত্র উপায় হলো অর্থনীতিকে ধীর করা এবং শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণ করা। এর জন্য, ফেডারেল রিজার্ভকে সুদহার বৃদ্ধি অব্যাহত রেখে মুদ্রানীতি আরও কঠোর করতে হবে। ‘গ্রিডফ্লেশন’ হিসেবে, প্রতিষ্ঠানগুলো সবসময়ই লোভী। তাই এ কারণেই মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে, বিষয়টি এমন নয়।  মুনাফা বাড়ানোর চেষ্টায় ব্রতী হওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে আক্রমণ করলে মূল্যস্ফীতি কমবে না। এজন্য তাদের উৎপাদিত পণ্যগুলোর চাহিদা কমাতে হবে। সেই সঙ্গে প্রয়োজন আরও কর্মীর।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫