
প্রতীকী ছবি।
গত ১১ অক্টোবর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ‘সিএনএন’-এর সাথে এক সাক্ষাতে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত ১১ অক্টোবর সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে আঁতাত করে জ্বালানি তেলের উৎপাদন কমিয়ে দিয়ে দাম বাড়ানোর চেষ্টার জন্য সৌদি আরবকে মূল্য দিতে হবে। সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ককে নিয়ে নতুন করে ভাববার সময় এসেছে।
জ্বালানিবিষয়ক পত্রিকা ‘অয়েল প্রাইস’-এর এক প্রতিবেদনে মনে করিয়ে দিচ্ছে- ৫ অক্টোবর জ্বালানি তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর জোট ‘ওপেক’ এবং তার সঙ্গে রাশিয়া মিলে তেলের উৎপাদন দৈনিক ২০ লাখ ব্যারেল কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ২০২০ সালের মে মাসে করোনা মহামারীর লকডাউনের কারণে ৯৭ লাখ ব্যারেল উৎপাদন কমানোর পর থেকে এটা ছিল সর্বোচ্চ কর্তন।
বাজারের সবাই ১০ লাখ ব্যারেল কমানো আশা করলেও এর দ্বিগুণ কমানোর সিদ্ধান্ত এসেছে। ওপেক ও রাশিয়া মিলে এই জোট ‘ওপেক প্লাস’ নামে পরিচিত। যদিও রাশিয়া ও ওপেক- উভয়েই বলছে, ‘টেকনিক্যাল’ কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অপরদিকে ওয়াশিংটন মনে করছে, এই সিদ্ধান্তটা পুরোপুরিভাবে রাজনৈতিক।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন রাশিয়ার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের জন্য সৌদি আরবের সমালোচনা করেছেন এবং তেলের উৎপাদন বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে অদূরদর্শিতা বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, সৌদির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তারা কংগ্রেসের সঙ্গে কথা বলছেন। মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির প্রধান বব মেনেনডেজ ১০ অক্টোবর এক বিবৃতিতে সৌদি আরবের সঙ্গে সব সহযোগিতা বন্ধ করাসহ দেশটাতে অস্ত্র বিক্রি বন্ধেরও আহ্বান জানান। তবে প্রেসিডেন্ট বাইডেন নির্দিষ্ট করে বলতে রাজি হননি যে, তিনি সৌদি আরবের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেবেন।
এর আগে মার্কিন কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাটদের নেতা চাক শুমার বলেন, কংগ্রেস সৌদি আরবের বিরুদ্ধে সব রকমের আইনি ব্যবস্থা নিয়েই ভাবছে; যার মাঝে ‘নোপেক’ বিলও রয়েছে। ‘নোপেক’ হলো একটা আইনের খসড়া, যার মাধ্যমে তেলের বাজারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ‘অপরাধে’ ওপেক সদস্য দেশগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। এহেন ব্যবস্থা নেওয়া হলে সৌদি রাজপরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকা তেল কোম্পানি ‘আরামকো’র শেয়ার কেনাবেচা বাতিল হয়ে যেতে পারে।
সৌদি জ্বালানিমন্ত্রী প্রিন্স আব্দুলআজিজ বিন সালমান ‘সৌদি টিভি’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, তার দেশ সর্বপ্রথমে তার নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করবে। পশ্চিমা দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মুদ্রাস্ফীতি রোধে সুদের হার বাড়িয়েই যাচ্ছে। এর ফলে বিশ্বব্যাপী মন্দার সৃষ্টি হতে পারে। এতে জ্বালানির চাহিদা অনেক কমে যাবে এবং তেলের বাজারে ব্যাপক দরপতন হবে।
মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক দ্য আটলান্টিক কাউন্সিলের সিনিয়র ফেলো এলেন ওয়াল্ড বলেন, মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার বৃদ্ধির সঙ্গে সমন্বয় করেই ওপেক হয়তো তেলের উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যাতে চাহিদা পড়ে গেলে হঠাৎ করে উৎপাদন কমাতে না হয়। ওপেক দেশগুলোর অর্থনীতি তেল বিক্রির ওপরে পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল।
তেলের দরপতন এই দেশগুলোর অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। ২০০৮ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ওপেক দেশগুলো ব্যাপক সমস্যায় পড়েছিল। সৌদি আরব তাদের সরকারের বাজেট ঠিক করে তেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ৭৯ ডলার হিসেবে। এর নিচে মূল্য পড়ে গেলে বাজেটে ঘাটতি তৈরি হবে। সাত মাস আগে ১৩৯ ডলারে মূল্য উঠে গেলেও গত মাসেই সেটা ৮৫ ডলারে নেমে গিয়েছিল; যা কিনা ওপেক দেশগুলোর জন্যে একটা সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করেছে।
বাজার বিশ্লেষক সায়মন ওয়াটকিন্স ‘অয়েল প্রাইস’-এর এক লেখায় বলেন, মার্কিন অনুরোধ সত্ত্বেও সৌদি আরব যে তেলের উৎপাদন কমাবে, সেটা জানাই ছিল। তেলের উৎপাদন কমানো হলে এর তিনটা ফল হবে। প্রথমত- মূল্যস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পাবে। বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার বাড়াতে থাকবে।
দ্বিতীয়ত- রাশিয়ার এতে রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে; যা তারা ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহার করবে এবং তৃতীয়ত- আসন্ন মার্কিন মধ্যবর্তী নির্বাচনে বাইডেনের ডেমোক্র্যাটিক পার্টি খারাপ ফল করবে। এতে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা কমে যাবে। ঐতিহাসিকভাবেই ব্যারেল প্রতি ১০ ডলার মূল্যবৃদ্ধির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে গ্যালনপ্রতি জ্বালানি তেলের মূল্য ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রে জ্বালানির মূল্য গ্যালনপ্রতি ১ সেন্ট বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ হলো কনজিউমারদের পকেট থেকে এক বছরে ১ বিলিয়ন ডলারের খরচ করার সক্ষমতা কমে যাওয়া। আবার ঐতিহাসিকভাবেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দুই বছরের মাঝে অর্থনীতি যদি মন্দায় পতিত হয়, তা হলে প্রেসিডেন্টের পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শেষ হয়ে যায়। এ বছরের প্রথম ছয় মাসে মার্কিন অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে ছোট হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে সৌদি আরব বহুকাল ধরেই তেলের মূল্যকে নিয়ন্ত্রণ করেছে; যা ওয়াশিংটনের স্বার্থকেই রক্ষা করেছে। এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নেতৃত্বকে নিরাপত্তা দিয়েছে; কিন্তু বারাক ওবামার প্রশাসনের সময় থেকে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি করা এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তে সৌদি আরব নিরাপত্তাহীনতায় পড়েছে।
বিশেষ করে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের আক্রমণ থেকে সৌদি আরবের তেলের স্থাপনাগুলো রক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা না নেওয়ায় সৌদির সঙ্গে ওয়াশিংটনের এতকালের সখ্যে ভাটা পড়েছে। একই সূত্রে মানবাধিকার বিষয়ে ওয়াশিংটন থেকে সৌদির ওপরে চাপও বৃদ্ধি পেয়েছে। ওয়াশিংটনের স্বার্থকে উপেক্ষা করেই ওপেক প্লাসের তেলের উৎপাদন কমানো এই ভূরাজনৈতিক ধারাবাহিকতারই অংশ। তবে এটা আবারও প্রমাণ করে যে, মার্কিন নিয়ন্ত্রিত পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থা এখন কতটা দুর্বল হয়ে গেছে।