পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তিতে ভালো কোম্পানিগুলোর অনীহা!

এম এইচ রশিদ
প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২২, ১০:০০

ডিএসই ও সিএসইয়ের লোগো। ফাইল ছবি
পুঁজিবাজারের ভালো কোম্পানির অংশগ্রহণ কম। জোর করেও এখানে বড় এবং ভালো কোম্পানিগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা যাচ্ছে না। ভালো কোম্পানির উদ্যোক্তা বা নিয়ন্ত্রকরা মনে করেন শেয়ারবাজারে অন্তর্ভুক্তিতে তাদের একক আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ কমে যাবে। বন্ধ হয়ে যাবে দুর্নীতি করার অবাধ সুযোগও।
এই আতঙ্ক থেকে দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সরকারি কোম্পানিগুলোকে বাজারে তালিকাভুক্ত করা যায়নি। আইনগত জটিলতা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অযাচিত দাবি- দাওয়ার কারণেও ভালো কোম্পানিগুলো বাজারে আসতে ভয় পায়।
দেশে যে পরিমাণ কোম্পানি আছে তার তুলনায় পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা অনেক কম। জবাবদিহীতার বাইরে থাকার জন্য অনেক কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসতে চায় না। অথচ বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) আইনে বলা হয়েছে- কোনো দেশি কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ৫০ কোটি বা এর বেশি হলে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া বাধ্যতামূলক।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বে সবচেয়ে বেশি তালিকাভুক্ত কোম্পানি আছে ভারতে। দেশটির প্রায় ৫ হাজার ৬৫টি কোম্পানি দেশের বিভিন্ন শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে। এর পরের অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ৪ হাজার ৩৯৭টি। এ ছাড়া জাপানে ৩ হাজার ৬৫২টি, চীনে ৩ হাজার ৫৮৪টি, কানাডায় ৩ হাজার ৩৩০টি, স্পেনে ২ হাজার ৯৭৯টি, দক্ষিণ কোরিয়ায় ২ হাজার ১৮৬টি, হংকংয়ে ২ হাজার ১৬১টি, অস্ট্রেলিয়ায় ২ হাজার ৪টি তালিকাভুক্ত কোম্পানি রয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা অনেক কম, মাত্র ৬৮৯টি। অথচ রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজের (আরজেএসসি) তথ্য অনুযায়ী দেশে নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা বর্তমানে দেড় লাখের বেশি। এর মধ্যে ৫০ কোটি টাকার বেশি মূলধনের কোম্পানির সংখ্যা প্রায় এক হাজার। অথচ ঢাকা স্টক এক্সেচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানি মাত্র ৩৫৮টি।
এ বিষয়ে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকারি কোম্পানিগুলো আসতে চায় না কারণ তারা খুব আরামে আছে। এসব কোম্পানি বেসরকারি খাতে গেলে অনেক সুযোগ কমে যাবে।
শেয়ারবাজারে ভালো কোম্পানির শেয়ারের মূল্য তলানিতে থাকলেও কারসাজির মাধ্যমে খারাপ কোম্পানির শেয়ারের মূল্য বাড়ানো হয়। আবার হঠাৎ করে বড় ধরনের দরপতন হয়। এসব কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের অনাস্থা বিরাজ করে। ১৯৯৬ ও ২০১০ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সময় যারা বাজারে কারসাজির মাধ্যমে ফায়দা লুটেছিল, তাদের কোনো শাস্তি হয়নি।
এমন বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে কোনো বিনিয়োগকারী তার উদ্বৃত্ত অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে ঝুঁকির মধ্যে পড়তে চাইবেন না, এটাই স্বাভাবিক। তাই বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানোর জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা একান্ত জরুরি। দেশের শীর্ষস্থানীয় উদ্যোক্তারা মনে করেন, তাদের কোম্পানিকে স্টক মার্কেটে তালিকাভুক্ত করে শেয়ার যদি বাজারে আনা হয়, তা হলে কোম্পানির ওপর তাদের কর্তৃত্ব অনেকটাই শিথিল হয়ে পড়তে পারে। একইসঙ্গে প্রতিবছরই শেয়ার হোল্ডারদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। কেউই তার কর্তৃত্ব শিথিল বা হারাতে চায় না।
সরকারি কোম্পানিগুলোকে বাজারে তালিকাভুক্ত করার চেষ্টা চলছে অনেক আগে থেকেই। এ ব্যাপারে প্রথম সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২০০৫ সালের মাঝামাঝিতে বিএনপি আমলের প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে। ৬৬টি কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠান তখন চিহ্নিত করা হয়। এর পর ২০০৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে পাওয়ার গ্রিড, ডেসকো, তিতাস গ্যাসসহ পাঁচটি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়।
২০১০ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ আমলের অর্থমন্ত্রী প্রয়াত আবুল মাল আবদুল মুহিত তালিকাভুক্ত হওয়ার যোগ্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬৬ থেকে ২৬টিতে নামিয়ে আনেন। কোম্পানিগুলোকে ছয় মাসের মধ্যে শেয়ার ছাড়ার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি এ বিষয়ে বলেন, খুব আশাবাদী ছিলাম প্রতিষ্ঠানগুলো শেয়ারবাজারে আসবে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। পর্ষদ নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নেয় বলে কাজটা হয়নি।
বিএসইসির আইন অনুসারে কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ৫০ কোটি টাকা অতিক্রম করলেই ওই কোম্পানিকে পরবর্তী এক বছরের মধ্যে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতে হয়। কোনো কোম্পানি ৫০ কোটি টাকার বেশি পরিশোধিত মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করলে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরুর তিন বছরের মধ্যে তালিকাভুক্তির বিধান রয়েছে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির বাধ্যবাধকতা আরোপের পর একযুগ পার হলেও বেশিরভাগ কোম্পানিই তা মানছে না। শেয়ারবাজারে নিবন্ধিত হলে কোম্পানিকে বিশেষ করছাড়ও দেওয়া হয়।
শেয়ারবাজারের গভীরতা বৃদ্ধির জন্য বড় মূলধনী কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করা জরুরি। আর বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বাজার মূলধন অনেক বেশি। তাই এসব কোম্পানি বাজারে এলে বাজারের গভীরতা বৃদ্ধি পায়; কিন্তু দেশের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে বাজারে আনার জন্য সরকার দীর্ঘদিন ধরে উৎসাহ দিলেও কোম্পানিগুলো বাজারে আসতে চাচ্ছে না। আবার কোনো কোনো কোম্পানি বাজারে এলেও মূলধন বৃদ্ধি করে না। কেবল কর মওকুফ সুবিধা পাওয়ার জন্যই তারা বাজারে আসে। এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে- কোম্পানিগুলো ক্যাশ ডিভিডেন্ড হিসেবে ঘোষণা করা অর্থের একটি বড় অংশ মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে অন্য দেশে পাঠিয়ে দেয়।
ভালো কোম্পানিকে বাজারে তালিকাভুক্ত করার বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বিদেশি ও দেশের বেসরকারি কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে এলে তাদের জবাবদিহিতা বেড়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে তাদের সঙ্গে নোগোশিয়েট করে আনতে হবে; তাদের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিলে চলবে না।
এদিকে তালিকাভুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে আইনগত নানা জটিলতাও রয়েছে। অনেক আইন আছে, যেগুলো বিনিয়োগবান্ধব নয়। এসব জটিল আইনের কারণে অনেকে নিরুৎসাহিত হয়ে থাকেন। আবার পুঁজিবাজারে নিবন্ধনের প্রক্রিয়ায় কর্মকর্তাদের কিছু অসাধু কার্যক্রমের অভিযোগ অনেক পুরনো। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাদাভাবে দেনদরবার না করলে ফাইল নড়চড় হয় না। এতে বাড়তি ব্যয়ের ঝুঁকিতে পড়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো। কেননা কেউই বিপাকে পড়তে চান না।