Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

চিনি গেলো কোথায়

Icon

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২২, ০৯:৩৯

চিনি গেলো কোথায়

লাল চিনি। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের পুরো বাজারব্যবস্থাটাই অদ্ভুত। এখানে ব্যবসায়ীরা যা চান, যেন তা-ই হয়। তারা যখন খুশি যে কোনো পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কিংবা সংকটকে পুঁজি করে দাম বাড়িয়ে দিতে পারেন। 

দেশে ঘুষ-দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির অর্থনীতির আকার যেহেতু বিশাল; যেহেতু ১৭-১৮ কোটি লোকের দেশে ক্রেতার সংখ্যাও বিপুল বলে কোনো পণ্যই অবিক্রীত পড়ে থাকে না। ফলে ব্যবসায়ীরা যে কোনো পণ্যের দামই বাড়াক না কেন, সেটি বিক্রি হয়ে যায়। 

বিপদে পড়েন সৎ পথে উপার্জনকারী স্বল্প আয়ের মানুষেরা। তাদের আহা-উহু করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। উপরন্তু কোনো পণ্যের দাম বেড়ে গেলে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে তাদের জন্য আছে বিনামূল্যের উপদেশ। যেমন- ওটা কম খান, ওটা খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয় কিংবা ওটার বিকল্প খুঁজুন ইত্যাদি। 

কিন্তু যারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কিংবা প্রকৃত সংকটকে পুঁজি করে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে মাঝখান থেকে শত শত কোটি টাকা বাড়তি লাভ তুলে নেয়, সেই ব্যবসায়ীরা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। কালেভদ্রে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের হাঁকডাক শোনা যায় বটে, কার্যত বাজার তথা পুরো অর্থনীতিই যে কিছু ব্যবসায়ীরা নিয়ন্ত্রণ করেন; এমনকি তারা যে খোদ সরকারকেও পাত্তা দেন না, সেটি নানা সময়ে প্রমাণিত। 

উপরন্তু আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু চলে মূলত বড় ব্যবসায়ীদের চাঁদায়, অতএব তাদের স্বার্থে আঘাত লাগে বা তারা যা চান তার বাইরে গিয়ে রাষ্ট্র বা সরকার খুব বেশি করবে বা করতে পারবে, সেটাও রীতিমতো অসম্ভব।

এত কথা বলার কারণ চিনি। হঠাৎ করে বাজার থেকে এই অতিপ্রয়াজনীয় নিত্যপণ্যটি উধাও। পাড়া-মহল্লার দোকান তো দূরে থাক, রাজধানীর কারওয়ানবাজারের মতো বিশাল জায়গায় গিয়েও ক্রেতারা চিনি পাচ্ছেন না। 

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) বরাতে গত ১৯ জুন বণিকবার্তার একটি খবরে বল হয়, দেশে এখন বছরে ২০ লাখ টনের কাছাকাছি চিনির চাহিদা। অন্যদিকে দেশের রিফাইনারিগুলোর পরিশোধন ক্ষমতা বার্ষিক ৩০ লাখ টন। এ ছাড়া সরকারিভাবেও কিছু পরিমাণে চিনি উৎপাদন করা হয়। সব মিলিয়ে বাজারে চিনির সরবরাহ চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি।

চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসেই দেশের সমুদ্র ও স্থলবন্দর দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে আমদানি হয়েছে পৌনে ২৩ লাখ টনের বেশি চিনি। সেই হিসাবে প্রতিকেজি চিনি বর্তমানে যে দামে বিক্রি করা হয়, তার চেয়েও কম হওয়ার কথা। অথচ হচ্ছে উল্টো। বাজার চিনিশূন্য। যে কারণে অভিযোগের তীর বরাবরের মতোই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের দিকে।

দেশে ১৮ লাখ টন চিনির চাহিদা পূরণ করার জন্য ৯৮ শতাংশ কাঁচামাল ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মতো দেশ থেকে আমদানি করা হয়। সরকারের তথ্য বলছে, এলসি অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণ র-সুগার দেশে আছে। সেই হিসাবে বাজারে কোনো ঘাটতি থাকার কথা নয়। তবে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে চিনি রিফাইন করে বাজারে ছাড়া যাচ্ছে না বলেও জানা যাচ্ছে।

মিলমালিকরা বলছেন, গ্যাস সংকটের কারণে চিনি পরিশোধনকারী কারখানাগুলোতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। দৈনিক ৬ থেকে ৮ ঘণ্টার বেশি মিল চালানো যায় না। এতে কারও কারও উৎপাদন কমেছে এক-পঞ্চমাংশে। এ ছাড়া তাদের পরিবহনগুলোও গ্যাসের সমস্যায় ভুগছে। (আরটিভি, ২১ অক্টোবর ২০২২)।

তবে অভিযোগ হলো- আগামী তিন থেকে চার মাসের চাহিদা মেটানোর মতো পর্যাপ্ত পরিমাণে চিনি দেশে মজুদ থাকলেও গ্যাসসহ বৈশ্বিক সংকট মাথায় রেখে আরেক দফা দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে চিনি উৎপাদনকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। সরকার নির্ধারিত মূল্যে মিলগেট থেকে পাইকার এবং খুচরা পর্যায়ে চিনি বিক্রি হচ্ছে না। অতি প্রয়োজনে যারা নানা দোকান ঘুরে চিনি কিনতে পারছেন, তাদের প্রতিকেজি চিনি কিনতে হচ্ছে ১১৫ থেকে ১২৫ টাকায়। (জনকণ্ঠ, ২৫ অক্টোবর ২০২২)। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) রাজধানীর ১১টি স্থানে প্রতিকেজি চিনি ৫৫ টাকা দরে বিক্রি করছে; কিন্তু টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে কতজন চিনি কিনতে পারবেন? 

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের আবেদনের মুখে কেজিপ্রতি ছয় টাকা বাড়িয়ে খোলা চিনি ৯০ এবং প্যাকেটজাত চিনি ৯৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয় সরকার; কিন্তু এই দামেও ব্যবসায়ীরা সন্তুষ্ট নন। বলা হচ্ছে- এখন নতুন করে তারা দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছেন। মূলত সেই চেষ্টার অংশ হিসেবেই তারা গুদামে চিনি আটকে রাখছেন। কারওয়ানবাজারের মতো পাইকারি বাজারও চিনিশূন্য। 

কথা হয় কারওয়ানবাজারের এক মুদি দোকানির সঙ্গে। তার তথ্য অনুযায়ী তারা প্যাকেটজাত চিনি কিনতেন ৮৯ টাকায়, যেটির গায়ের দাম ৯৫ টাকা। তার পরও তারা ক্রেতাদের কাছে এই চিনির দাম রাখতেন ৯২-৯৩ টাকা; কিন্তু চিনি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন স্থানে সরাসরি চিনি বিক্রি করছে ৯৫ টাকা বা তারও বেশি দামে। অর্থাৎ দোকানদারদের কাছে ৮৯ টাকা কেজিতে বিক্রি না করে তারা যদি অন্য কোনো পদ্ধতিতে ৯৫ টাকা বা তারও বেশি দামে বিক্রি করতে পারেন, তাতে তারা একসঙ্গে বিরাট মুনাফা তুলে নিতে পারেন; কিন্তু প্রশ্ন হলো- কোম্পানির লোকেরাও কি সারাদেশের সর্বত্র আছেন? নেই।

তারা কিছু কিছু জায়গায় এই প্রক্রিয়ায় চিনি বিক্রি করছেন। বাকিটা গুদামজাত করে রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছে, যাতে সরকার তাদের সঙ্গে দেন-দরবার করে কেজিতে ৫-৭ টাকা বা তারও বেশি বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। মূলত তারা নতুন করে চিনির দাম বাড়ানোর সরকারি ঘোষণার অপেক্ষায় রয়েছেন। 

স্মরণ করা যেতে পারে, কিছুদিন আগে সয়াবিন তেলের দাম নিয়েও ব্যবসায়ীরা এই একই পথ অনুসরণ করেছিলেন। প্রথমে তারা বাজার থেকে তেল উধাও করে দিয়েছেন। এর পর লিটারে কয়েক দফা দাম বাড়িয়ে অতিপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটির দাম দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়। অর্থাৎ ব্যবসায়ীরা যা চাইবেন, যেভাবে চাইবেন, সেভাবেই হবে; সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তারা সেটিই প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। মাঝেমধ্যে কোনো কোনো মন্ত্রী ব্যবসায়ীদের এই কারসাজির বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও আখেরে তাদের কিছুই হয় না। 

কারসাজি করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর অভিযোগে সম্প্রতি দেশের শীর্ষ ৩৬টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে প্রতিযোগিতা কমিশন। এর মধ্যে অধিকাংশই খাদ্যপণ্য প্রস্তুত ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া কিছু রয়েছে কসমেটিকসসহ অন্য পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহকারী। কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানও রয়েছে এই তালিকায়। (ডয়েচেভেলে, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২)। 

অভিযোগ- সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে অস্বাভাবিক মুনাফা করে আসছিল এই প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশেষ করে চাল-ডাল, আটা-ময়দা, তেল, ডিম, মুরগির মতো নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়ে ক্রেতা ঠকিয়ে আসছিল তারা। বাজার থেকে তুলে নিচ্ছিল বাড়তি মুনাফা। এসব বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর কমিশন তদন্ত করে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার পর মামলা হয়। বাস্তবতা হলো- যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সেগুলো অত্যন্ত প্রভাবশালী। সুতরাং এসব মামলা যে আখেরে ফলশূন্য হবে সেটি বোঝার জন্য খুব বেশি গবেষণার প্রয়োজন নেই। কারণ এই কমিশন আগেও কয়েকটি মামলা করেছিল। তাতে সতর্ক ও ভর্ৎসনা ছাড়া আর কোনো শাস্তির কথা জানা যায়নি।

কারণ ব্যবসায়ীরা এতটই শক্তিশালী যে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া কঠিন। যেমন- পুরো চিনির বাজারটাই বেসরকারি খাতনির্ভর হয়ে গেছে। 

যথেষ্ট সম্ভাবনা ও চাহিদ থাকার পরও ২০২০ সালের নভেম্বরে দেশের ১৫টি রাষ্ট্রীয় চিনিকলের মধ্যে ৬টির (পাবনা, কুষ্টিয়া, রংপুর, পঞ্চগড়, শ্যামপুর ও সেতাবগঞ্জ) আখমাড়াই বন্ধ করে পার্শ্ববর্তী চিনিকলগুলোয় মাড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যে কারণে অনেক কৃষক আখ চাষ বাদ দিয়ে অন্য ফসল আবাদ শুরু করেছেন। (প্রথম আলো, ৩০ মে ২০২২)।

আবার একই ধরনের আবহাওয়া ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যখন চিনিশিল্পের বিকাশ ঘটছে, তখন বাংলাদেশে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো বন্ধ করে দেয়া বা সংকুচিত করে দেয়ার কারণ কী, জনমনে এ প্রশ্ন জাগাই সঙ্গত; কিন্তু সব প্রশ্নের উত্তর দেয়া যায় না; দেয়া নিরাপদও নয়। যেমন- রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো লোকসানের অজুহাতে বন্ধ করে দেয়া বা সেখানে উৎপাদন কমিয়ে দেয়া হলেও বেসরকারি খাতের রিফাইনারিগুলো কীভাবে মোটা অংকের মুনাফা করছে, সেই প্রশ্নেরও সদুত্তর মিলবে না।

কারণ ব্যবাসায়ীরাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা অজুহাতে জনগণকে জিম্মি করে যে অসাধু ব্যবসায়ীরা শত শত কোটি টাকা মুনাফা তুলে নেবেন এবং সেখানে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর মাঝেমধ্যে দুই-একটি হাঁকডাক দেয়ার বাইরে যে বিশেষ কিছু করতে পারবে না, সেটিই স্বাভাবিক। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫