খামার বিপর্যয়ের শঙ্কা
লাম্পিতে ক্ষতি দুই হাজার কোটি টাকা

কে এম ওবায়দুল্লাহ
প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৯:৫৬

দেশের খামারগুলোতে দিন দিনই ছড়িয়ে পড়ছে গরুর লাম্পি স্কিন ডিজিজ (এলএসডি)।
চিকিৎসকরা বলছেন, ভাইরাসজনিত এ রোগ মশা-মাছি ও কীটপতঙ্গের মাধ্যমে গরুর শরীরের ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত পশুর শরীরের তাপমাত্রা ১০৩ থেকে ১০৫ ডিগ্রিতে বেড়ে দাঁড়ায়। প্রচণ্ড জ্বরের কারণে খাওয়া বন্ধ করে দেয়। পাশাপাশি গায়ে দেখা দেয় বসন্তের মতো গুটি গুটি চাকা। সেখানে পুঁজ জমে ফেটে গিয়ে মাংস খসে পড়ে। কমে যায় দুধ উৎপাদনও।
সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এখন পর্যন্ত ১০ লাখের বেশি গরু-মহিষ লাম্পিতে আক্রান্ত হয়েছে। এরই মধ্যে মৃত্যু হয়েছে কয়েকশ গরুর, গর্ভপাতের সংখ্যা তারও কয়েকগুণ। সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতির শঙ্কা দুই হাজার কোটি টাকা, যা এ খাতের জন্য অশনিসংকেত। রোগটির পর্যাপ্ত প্রতিষেধক ও চিকিৎসা না থাকায় দুশ্চিন্তায় রয়েছেন খামারিরা।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতর বলছে, দেশে গো-বসন্ত বা লাম্পি স্কিন ডিজিজ প্রথম শনাক্ত হয় গত বছরের ১২ জুলাই চট্টগ্রামে। এরপরই মাঠে নামে অধিদপ্তরের তদন্ত টিম। তখন দেশের ১২ জেলায় ৪৮ হাজার গরুর মধ্যে এ রোগের লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায়। বিষয়টি প্রাণিস্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিশ্ব সংস্থা ওআইইকে অবহিত করে সরকার। একইসাথে দেশব্যাপী খামারিদের সতর্ক করা হয়। কিন্তু কোনোভাবেই রোগটির বিস্তার ঠেকানো সম্ভব হয়নি। প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছে নতুন নতুন খামার।
আফ্রিকার রোগটি এসেছে ভারত হয়ে
১৯২৯ সালে জাম্বিয়ায় প্রথম অফিসিয়ালি শনাক্ত হওয়া গরুর এলএসডি ১৯৪৩ থেকে ৪৫ সালের মধ্যে মহাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময়ের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা, মোজাম্বিকসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আক্রান্ত হাজার হাজার গরুর মৃত্যু হয় ও বন্ধ হয়ে যায় শত শত খামার।
পরবর্তীতে সত্তর ও আশির দশকে আফ্রিকার প্রায় সব দেশের গরু এ রোগে আক্রান্ত হয়। আর এতে খামার ব্যবসায় ধস নামে। বর্তমানে সেখানে লাম্পিতে পশুর গড় মৃত্যুহার ৪০ শতাংশ। তবে এ রোগটি দেশে প্রবেশ করেছে প্রতিবেশী ভারত থেকে। দেশটির উড়িষ্যা ও অন্ধ্রপ্রদেশে প্রথম গো-বসন্তের দেখা মিলে।
খামারিরা জানান, চিকিৎসা খরচ কম হলেও এলএসডিতে গরুর স্বাস্থ্যহানির পাশপাশি কমে যায় দুধ উৎপাদন। বর্তমানে দেশে লাখ চারেক দুগ্ধগাভী লাম্পিতে আক্রান্ত। আর দুই মাসেরও অধিক সময় পর্যন্ত এ রোগে ভুগলে সেই গরু অর্ধেক দুধ দেয়। একটি গাভী দৈনিক গড়ে ১০ কেজি দুধ দিলে আক্রান্তের পর দেয় ৫ কেজি। সেই হিসাবে দু’মাসে ৩০০ কেজি দুধ কম মেলে, যার বাজারমূল্য কেজিপ্রতি ৫০ টাকা ধরে ১৫ হাজার।
পাশাপশি চিকিৎসা ও পুষ্টিকর খাবার বাবদ গড়ে আরো হাজার দশেক টাকা খরচ হয়। অর্থাৎ একটি গরুর ক্ষেত্রে লোকসান ২৫ হাজার টাকার মতো। সব মিলিয়ে চার লাখে লোকসানের পরিমাণ হাজার কোটি টাকা।
এর বাইরে গর্ভপাত ও মৃত্যুজনিত ক্ষতি তো আছেই। তবে লাম্পিতে বেশি ক্ষতি হয় ষাঁড়, আক্রান্ত হলে ৩০ কেজি পর্যন্ত ওজন কমে যায়। সঠিক চিকিৎসায় দুই মাসের মধ্যে গরু সুস্থ হলেও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব। এছাড়া আক্রান্ত বেশিরভাগ গরুর চামড়াও হয়ে পড়ে মূল্যহীন। আবার গায়ে দাগ পড়ায় সৌন্দর্যও নষ্ট হয়ে যায়। ফলে অন্য পশুর থেকে অনেক কম দাম মেলে। এতেও লোকসানের পরিমাণ দাঁড়াবে হাজার কোটি টাকা। সামনের কোরবানিতে এই সংকট স্পষ্ট হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আক্রান্তে চট্টগ্রাম, মৃত্যুতে এগিয়ে খুলনা
দেশে গরু রয়েছে ৩ কোটি ৭০ লাখের মতো। এর মধ্যে ৬৩ জেলায় আট লাখের বেশি লাম্পিতে আক্রান্ত। অনেক খামারি স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দেয়ায় এর সঠিক তথ্য অবশ্য অধিদফতরের জানা নেই। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে চট্টগ্রামে। সেখানকার ৩১ লাখ ৪৫ হাজারের মধ্যে তিন লাখের মতো গরু রোগটিতে ভুগছে।
এরপরেই রয়েছে খুলনা, ৩৬ লাখের মধ্যে আড়াই লাখেরও বেশি গরু ক্ষতিগ্রস্ত। এ বিভাগের ঝিনাইদহ জেলাতেই দেড় লাখ গরু ও বাছুর গো-বসন্তে আক্রান্ত। বরিশাল, ঢাকা, রাজশাহী, রংপুর ও সিলেট বিভাগেও কয়েক লাখ পশু এলএসডিতে কাবু। তবে সবচেয়ে বেশি গরুর মৃত্যু ও গর্ভপাত হয়েছে খুলনা বিভাগে।
কবিরাজি চিকিৎসাই ভরসা
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কারখানায় বছরে গোট পক্স ভ্যাকসিনের উৎপাদন ক্ষমতা মাত্র ৬ লাখ। আর সর্বসাকুল্যে প্রতিষেধক রয়েছে ৭ লাখের মতো। অথচ বর্তমানে এ প্রতিষেধকের চাহিদা কোটিরও বেশি। তাই আমদানির পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এরপরও সরকারের উদ্যোগে দেওয়া হয়েছে সাড়ে ৩ লাখ পশুর চিকিৎসা। পাশাপাশি অধিদফতরের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে কিংবা নামমাত্র মূল্যে দেয়া হয়েছে ৪ লাখ ১০ হাজার ৬৪০টি ভ্যাকসিন। এছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের পুনর্বাসনের প্রস্তাবনাও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে অধিদফতর।
এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (প্রাণিস্বাস্থ্য ও প্রশাসন) ডা. মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান বলেন, ‘আমাদের সক্ষমতা কম থাকায় চাহিদানুযায়ী ভ্যাকসিন সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। যেসব দেশে এটি উৎপাদন হয় তাদের কাছ থেকে আমদানির পরিকল্পনা করেছি। মন্ত্রণালয় অনুমোদন ও অর্থ বরাদ্দ দিলেই তা আনা হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আক্রান্ত গরুকে প্রতিষেধক দেয়া হয় না। তাই সনাতনি পদ্ধতি খুব একটা খারাপ নয়। বিভিন্ন জেলায় নিমপাতা, বাসক পাতাসহ কর্পুর ও অন্যান্য কবিরাজি চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।’
আর্থিক ক্ষতির বিষয়ে সরকারের এ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। তবে লাম্পিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হবে। এটি পুষিয়ে উঠতে খামারিদের সহায়তার চেষ্টা করব আমরা। ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের প্রণোদনা দিতে ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়কে একটি প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে।’
পশুবিজ্ঞানীরা বলছেন, এ রোগের সবচেয়ে বড় প্রতিষেধক হলো- আক্রান্ত গরুকে আলাদা করে রাখা, খামার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা ও খামারে মশারি ব্যবহার করা। সাধারণত আক্রান্ত গরুর প্রথমে জ্বর আসে। এছাড়া শরীরে বড় বড় গোটা উঠতে থাকে। এমন দেখা গেলে আতঙ্কিত না হয়ে গরুকে আলাদা করে রেখে প্যারাসিটামল খাওয়াতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু হাদী নুর আলী খান বলেন, ‘রোগটি দেশে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আছে। প্রধানত বর্ষার শেষে, শরতের অথবা বসন্তের শুরুতে যে সময়ে মশা-মাছি অধিক বংশবিস্তার করে সেই সময়ে প্রাণঘাতি এ রোগটি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। আমরা এ নিয়ে গবেষণা করছি। আক্রান্ত হওয়ার আগে গোট পক্স ভ্যাকসিন দিতে পারলে আর হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে আক্রান্ত হলে তেমন কোনো প্রতিষেধক নেই। মশা-মাছির মাধ্যমে এটি ছাড়নোয় বিস্তার রোধ সম্ভব হচ্ছে না।’
আক্রান্ত গরুর চামড়ার মূল্য নেই
লাম্পি স্কিন রোগের কারণে চামড়া খাতে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আক্রান্ত গরুর চামড়ায় গোটা তৈরি ও সৌন্দর্য্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এর গুণগত মান ঠিক থাকে না। এছাড়া অনেক পশুর চামড়া পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে আতঙ্কিত খাতের সংশ্লিষ্টরাও।
বাংলাদেশ ট্যানারি সমিতির সভাপতি সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ‘চামড়ায় গোটা থাকলে ক্রেতারা কেনে না। এর আগে অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হওয়া গরুর চামড়াও আমরা এ কারণে কিনতে পারিনি। তবে দুয়েকটি ছোট কারখানা স্থানীয় বাজারের জন্য এসব চামড়া কিনলেও দাম খুবই কম।’
মানবদেহে ছড়ায় না
আক্রান্ত গরুর মাংস বা দুধ পান করলে মানবদেহের কোনো ক্ষতি হয় না বলে জানিয়েছেন প্রাণিরোগ বিশেষজ্ঞরা। এমনকি এসব গরুকে কামড়ানো মশা যদি মানুষকে কামড়ায় তাহলেও লাম্পিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের মাইক্রোবাইলোজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুল কাফি বলেন, ‘গবাদিপশুর শরীর থেকে এলএসডি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা নেই। তবে তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ জরুরি। আর যেসব প্রাণী আক্রান্ত হয়েছে সেগুলোকে দ্রুত চিকিৎসা ও যেগুলো আক্রান্ত হয়নি, সেগুলোকে টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কেননা একটা খামারকে অর্থনৈতিকভাবে ধসিয়ে দেয়ার জন্য এফএমডি বা খুরা রোগের চেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর হিসেবে ধরা হয় এলএসডিকে।’