হামাস-ইসরায়েল সংঘাত
হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান লড়াইয়ে মধ্যপ্রাচ্যে জ্বালানি উৎপাদন ব্যাহত করার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যার ফলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে।
গতকাল সোমবার ব্রেন্ট ক্রুডের বৈশ্বিক মূল্যসূচক ৪ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে প্রতি ব্যারেলের দর পৌঁছায় ৮৮ ডলার ১৫ সেন্টে। এদিন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের প্রধান মূল্যসূচক ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট ৪ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়ে ব্যারেলপ্রতি দর ৮৬ ডলার ৩৮ সেন্টে উন্নীত হয়।
আজ মঙ্গলবার (১০ আগস্ট) সেখান থেকে সামান্যই কমতে দেখা গেছে। সবশেষ খবর অনুযায়ী, ব্রেন্ট ক্রুড ও টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট- এ যথাক্রমে ৩৬ ও ৩৫ সেন্ট দর কমেছে।
বিশ্বের তিন ভাগের একভাগ জ্বালানি তেলের যোগানদাতা মধ্যপ্রাচ্য। বিশেষত, পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলো বিশ্বের প্রথমসারির উৎপাদক। এরমধ্যে রয়েছে আঞ্চলিক দুই শক্তি- ইরান ও সৌদি আরব। তেহরান হামাসের সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের কট্টর সমর্থক। ইরান সবুজ সংকেত দিলে, লেবাননের ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীও ইসরায়েলের সাথে সংঘাতে জড়াতে পারে। এ অবস্থায়, সৌদি আরব ইরানবিরোধী কোনো পদক্ষেপ নিলে হরমুজ প্রণালী দিয়ে জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এটি মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি রপ্তানির প্রধান কৌশলগত জলপথ।
ইসরায়েল বড় জ্বালানি তেল উৎপাদক নয়, অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার তো প্রশ্নই আসে না। তবু এই সংঘাত বৃহত্তর আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার ভীতি উস্কে দিয়েছে জ্বালানি বাজারে।
জ্বালানি তেলের দর কি বাড়তেই থাকবে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ যুদ্ধের পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়- তার ওপরই এটা সিংহভাগ নির্ভর করছে। বিশ্ববাজারে তাৎক্ষণিক প্রভাব হবে সীমিত।
গতবছরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দরে বড় উত্থান ঘটে। কারণ, রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম প্রধান তেল-গ্যাস উৎপাদক। সে তুলনায়, হামাস বা ইসরায়েল কোনো পক্ষই তেল রপ্তানিকারক নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক ও আর্থিক সেবাদাতা মরগ্যান স্ট্যানলি সোমবার জানিয়েছে, তেল সরবরাহের ক্ষেত্রে স্বল্প মেয়াদি ঝুঁকি সামান্য, কিন্তু আঞ্চলিক অন্যান্য দেশও এ সংঘাতে জড়ালে এই পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন হতে পারে। অর্থাৎ, বহুগুণে ঝুঁকি বেড়ে যাবে।
জ্বালানি বাজার-বিশ্লেষক সংস্থা কর্নারস্টোন এনালিটিক্স- এর প্রেসিডেন্ট ও প্রতিষ্ঠাতা মাইক রথম্যান আল জাজিরাকে বলেন, বাজারে বর্তমানে অনুমান নির্ভর দরবৃদ্ধির যে প্রতিক্রিয়া আমরা দেখছি, সেটা খুবই স্বল্পস্থায়ী ব্যাপার। এই ঘটনার (হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ) পরিপ্রেক্ষিতে অপরিশোধিত তেলের (ক্রুড অয়েল) দাম সেভাবে বাড়ার ঝুঁকিও দেখছি না।
এই সংঘাত জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক চাহিদা বা দীর্ঘমেয়াদে ওপেক জোটের উৎপাদনে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলেও মনে করছেন তিনি। তবে বিশ্বের কিছু কিছু দেশের জ্বালানি তেলের মজুত কমছে, এই ঘটনা তেলের দামে প্রভাব ফেলতে পারে।
ব্যাপকভাবে বাড়ার আশঙ্কা কতটা?
চলমান সংঘাতে ইরান বা তাদের সমর্থিত হিজবুল্লাহ জড়ায় কিনা- এ দুটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাজার বিশ্লেষকরা এদিকে ঘনিষ্ঠ নজর রাখছেন।
ইসরায়েলের গোলাবর্ষণে নিজদের তিন সদস্য নিহত হওয়ার পর, সোমবার ইসরায়েলে রকেট নিক্ষেপ করার কথা জানায় হিজবুল্লাহ।
প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিক ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল এক প্রতিবেদনে দাবি করে, ইরানি কর্মকর্তারা হামাসের আক্রমণ পরিকল্পনায় সাহায্য করেছেন। এরপর শনিবার দেওয়া এক বিবৃতিতে হামাসের আক্রমণের সাথে সকল প্রকার সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে ইরান।
তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী- উভয়পক্ষই বলেছে, এই হামলায় ইরানের সমর্থন দেওয়ার কোনো প্রমাণ পায়নি তারা।
অবশ্য, দখলদার ইসরায়েলে হামলার জন্য হামাসকে অভিনন্দন জানিয়েছে তেহরান।
যুদ্ধে ইরান জড়ালে কী হবে?
২০১৮ সালে ইরানের জ্বালানি তেল শিল্পের ওপর পুনরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে হোয়াইট হাউস থেকে ট্রাম্প বিদায় নেওয়ার পর নতুন প্রশাসন ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে পুনরায় আলোচনার উদ্যোগ নেয়। এরপরে ২০২২ ও ২০২৩ সালে ইরানের তেল রপ্তানি বেড়েছে।
এই অবস্থায়, হামাসের আক্রমণের পেছনে ইরানের সংশ্লিষ্টতার কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলে আলোচনা প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে, এবং ইরানের জ্বালানি রপ্তানিতে নতুন করে আরও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে।
জ্বালানি-বাজার বিশ্লেষক সংস্থা উড ম্যাকেঞ্জির বিশ্লেষক অ্যালান গেল্ডার বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের বৃহৎ শক্তিগুলো তাদের প্রক্সি এজেন্টদের (ইসরায়েলের বিরুদ্ধে) ব্যবহার করে, এই সংঘাতকে বৃহত্তর রূপ দিতে পারে জ্বালানি বাজারের এমন আশঙ্কাকেই প্রতিফলিত করে সাম্প্রতিক দরবৃদ্ধির ঘটনা।
তার মতে, ইরান জড়িয়ে পড়লে যুক্তরাষ্ট্র যেসব নিষেধাজ্ঞা দেবে, জ্বালানি বাজারে সঙ্গেসঙ্গেই তার প্রভাব পড়বে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে এটা জ্বালানি বাজারকে ঘোর অনিশ্চয়তায় ফেলতে পারে।
গতকাল সোমবার সিএনবিসি-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে র্যাপিডান এনার্জি গ্রুপের প্রেসিডেন্ট বব ম্যাকনেলি বলেন, ইরান এ সংঘাতে জড়ালে এক ধাক্কায় তেলের দর ব্যারেলপ্রতি ৫ থেকে ১০ ডলার পর্যন্ত বাড়বে।
সূত্র- আল জাজিরা
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : জ্বালানি জ্বালানি তেল হামাস ইসরায়েল
© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh