বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমেই চলেছে। গত সপ্তাহে বিশ্ববাজারে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ৭৬.৮১ ডলার। ডব্লিউটিআই ক্রুডের দাম ছিল ৭৩.৫২ ডলার। বেশ কয়েক দিন ধরেই অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৮০ ডলারের নিচে। এর আগে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ছিল ৭৩ দশমিক ২৪ ডলার।
আইএমএফের হিসাবে এ বছর বিশ্ব প্রবৃদ্ধি হবে ৩ শতাংশ। আগামী বছর তা আরও কমে হবে ২.৯ শতাংশ। তবে জ্বালানি তেলের দামের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। সে জন্য তেলের দাম বাড়লে পরিবহন ব্যয় এবং শিল্প, কৃষি ও বিদ্যুৎ-সবকিছুর উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। কেবল বাংলাদেশই নয়, জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোও বিপদে পড়েছিল। ২০২২ সালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠে। ওই বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে পশ্চিমারা রাশিয়ার তেল বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। ব্যাহত হয় তেল সরবরাহ ও উৎপাদন। সে বছর অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ব্যারেলপ্রতি দাম সর্বোচ্চ ১৩৯ মার্কিন ডলারে উঠে যায়। যদিও তারা নীতি সুদহার বাড়িয়ে ধারাবাহিকভাবে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে সক্ষম হয় অনেক দেশ।
গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক হামলা চালায় হামাস। এর পরদিনই এক লাফে তেলের দাম ৪ শতাংশ বেড়ে যায়। পরবর্তী সময়ে গাজায় ইসরায়েলের বোমাবর্ষণ শুরু হলে এবং স্থল অভিযানের ঘোষণা দিলে তেলের দাম প্রায় ৬ শতাংশ বাড়ে। বাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং ইকোনমিকস জানায়, তখন যুক্তরাষ্ট্রের ডব্লিউটিআই অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ছিল প্রতি ব্যারেল ৮৭.৬৯ ডলার। এর পাশাপাশি লন্ডনের ব্রেন্ট অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল প্রতি ব্যারেল ৯০.৭৬ ডলার। এএনজেড ব্যাংকের বিশ্লেষকেরা এক নোটে লিখেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি বাড়লে তেলের দাম আরও বাড়বে। তেলের দাম বাড়লে রাশিয়ার সুবিধা, তারা সেখান থেকে অতিরিক্ত মুনাফা করতে পারবে। তাই যুক্তরাষ্ট্র এমনটা চায় না। মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতিতে এই সংঘাতের যে স্বল্প ও মধ্যম মেয়াদি প্রভাব পড়বে, তা রীতিমতো অনেক বড় একটা আঘাত।
তবে এ বছর হিজবুল্লাহ-ইসরায়েল যুদ্ধাবস্থা সত্ত্বেও বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ছে না, উল্টো কমছে। গত বছর ওপেক ও সহযোগী দেশগুলো তেলের উৎপাদন দফায় দফায় কমিয়েছে। এতে সাময়িকভাবে তেলের দাম বাড়লেও চলতি বছর দাম কমছে। লেবানন ও ইরানজুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে পুরো অঞ্চলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যাবে। এতে পর্যটন, শিপিং, খুচরা ও রিয়েল এস্টেট খাত প্রভাবিত হবে। তবে বিশ্লেষকরা বলেছেন, সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক হুমকি আসবে জ্বালানি তেল খাতে। এর ফল হলো দাম ও বাজারের অস্থিরতা বৃদ্ধি, যার প্রভাব বৈশ্বিক অর্থনীতির সব প্রান্তে পড়বে ও মূল্যস্ফীতি আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
অর্থনীতির মূল নিয়ম, চাহিদা ও জোগানের কারণেই জ্বালানি তেলের দাম কমছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। অর্থাৎ জোগান আছে, কিন্তু চাহিদা কমে গেছে-তাই জ্বালানি তেলের দাম কমছে। অপরিশোধিত তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। চীনের সরকারি তথ্যমতে, বছরের প্রথম ভাগে চীনের জ্বালানি তেল আমদানি ১১ শতাংশ কমেছে। বছরের বাকি সময় চাহিদা কতটা বাড়বে, তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই শঙ্কা আছে।
সম্প্রতি ব্যাংক অব আমেরিকা তেলের বাজারকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের সঙ্গে তুলনা করে জানিয়েছে। এ বাজার ব্যাপকভাবে অনিশ্চিত। চীনের প্রবৃদ্ধি কমে তেলের দাম আরও কমে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। তবে ওপেক ও সহযোগী দেশগুলো তেলের উৎপাদন আরও কমালে দাম উল্টো বাড়তে পারে। বর্তমানে কিছুই নিশ্চিত নয়। তেলের দাম অনেকটা বেড়ে গেলে উৎপাদন কমাতে হতে পারে; কিন্তু এখন তেমনটা হচ্ছে না।
ব্যাংক অব আমেরিকা আশঙ্কা করছে, পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে চলতি বছরের শেষ নাগাদ বিশ্ববাজারে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৬০ ডলারে নেমে আসতে পারে। এই পরিস্থিতিতে চীনের চাহিদার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। তেলের মজুদ কত আছে, তার চেয়ে বরং চীনের চাহিদার বিষয়টি মুখ্য হয়ে ওঠে। চীনের চাহিদা কমার কারণে জুলাই মাসে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল রপ্তানি গত ১১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh