Logo
×

Follow Us

ক্যাম্পাস

৫ আগস্ট লড়াই শুরু, শেষ হয়নি এখনো

Icon

ড. মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী

প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩:০৬

৫ আগস্ট লড়াই শুরু, শেষ হয়নি এখনো

২৯ জুলাই ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ আবৃত্তির সময় ড. মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মূল চেতনাই ছিল বৈষম্যবিরোধী, আর বৈষম্যের সঙ্গে জড়িত মূলত অর্থনীতি। আমাদের এ অঞ্চলের মানুষের রাজনীতির মূল হচ্ছে অর্থনৈতিক মুক্তির পথ খুঁজে নেওয়া। শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক প্রায়ই একটি কথা বলতেন, ‘আওয়ার ইকোনমিক্স ইজ আওয়ার পলিটিকস’। কারণ আমরা অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য রাজনীতি করি। মোগল আমলে মোগলদের দ্বারা শোষণের শিকার হয়েছি, ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশদের দ্বারা শোষণের শিকার হয়েছি, কলকাতার উচ্চবিত্তের দ্বারা শোষণের শিকার হয়েছি, শেষ পর্যন্ত আমরা পাকিস্তানে যুক্ত হয়েছিলাম। প্রত্যাশা ছিল জিন্নাহর নেতৃত্বে যে পাকিস্তান হচ্ছে, সেখানে মুসলমান-মুসলমান ভাই-ভাই, কোনো শোষণ-বৈষম্য থাকবে না। কিন্তু সেখানে আমরা দেখেছি শোষণ-বৈষম্যই বেড়েছে। পাকিস্তান সৃষ্টির ইমিডিয়েট পরেই অপ্রয়োজনীয়ভাবে তারা ভাষার প্রশ্নটি নিয়ে এলো। ভাষা আন্দোলন যে শুধু ভাষা ও সংস্কৃতির আন্দোলন তা নয়, এ আন্দোলনের একটা অর্থনৈতিক দিক ছিল, চাকরি না পাওয়ার আশঙ্কা ছিল। 

২০১৮ সালের কোটাবিরোধী আন্দোলন এবং ২০২৪-এর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনেও চাকরি পাওয়া না পাওয়ার প্রশ্ন এলো। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। ২০২৪-এর ফেব্রুয়ারিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল, তার বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম। আন্দোলনের প্রথম দিন অনেক ছেলে-মেয়ে এলো, আমরা অনেক শক্তি পেলাম। দেখলাম, দুই দিন পরই আর ছেলেমেয়েরা আসছে না। শেষ পর্যন্ত ওই আন্দোলনটা আমরা ১৫ থেকে ২০ জন ছেলেমেয়ে নিয়ে চালিয়ে গেছি এবং সফলও হয়েছি। এ ঘটনাটি বর্ণনা করলাম, কারণ এই আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা তেমন না এলেও জুলাই আন্দোলনে সবাই এলো। কারণ শিক্ষার্থীরা নিজেদের এখানে রিলেট করতে পেরেছিল।

শিক্ষার্থীরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেই বিসিএসের গাইড নিয়ে বসে, সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হোক আর জাহাঙ্গীরনগরের। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ৫ আগস্ট যা ঘটেছে তারপর মূল প্রত্যাশা হচ্ছে বৈষম্য মুক্ত সমাজ। এ আন্দোলনের কোনো মাস্টারমাইন্ড ছিল না। সমন্বয়কদের যখন ডিবি হারুন ধরে নিয়ে গেল তখন সারা দেশের শিক্ষার্থীরা বলেছিল আমিই সমন্বয়ক। ১৪ জুলাই প্রথম ছাত্রদের সঙ্গে আরিচা মহাসড়কে যাই, তারা সেদিনই প্রথম সমন্বয় কমিটি গঠন এবং সংহতি সমাবেশ করে। সংহতি সমাবেশের পরামর্শটি আমিই দিয়েছিলাম। ছাত্রদের বললাম, তোমরা মিছিল করলে তো আমরা যোগ দিতে পারি না, সমাবেশ করলে সংহতি জানাতে পারি। সেদিন রাতে ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে হামলা চালাল। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর নির্মমভাবে হামলা করল ছাত্রলীগ, এ ঘটনার প্রতিবাদে সেদিন বিকেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মিছিল বের করলে এখানেও হামলা চালায় ছাত্রলীগ। আমি তখন ক্যাম্পাসে ছিলাম না, সন্ধ্যার আগে যখন খবরটি পেলাম তখন কেন জানি না অজানা আশঙ্কায় মন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল, যে আজকে আমাদের ছেলেমেয়েদের ওপর হয়তো আরো বড় ধরনের হামলা নেমে আসতে পারে। 

আঠারো বছর ধরে শিক্ষকতা করে যাচ্ছি, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক আমার, সে জায়গা থেকে মনটা ছটফট করছিল। কোনোভাবে ক্যাম্পাসে আসার উপায় খুঁজছিলাম, তখন আমার একজন বন্ধু তার গাড়ি নিয়ে এগিয়ে এলেন। তিনি নিজে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলেন। আমি ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করতে লাগলাম। এক ছাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলাম, বললাম কোথায় আসব? সে জানাল, ‘স্যার আপনি আগে এনাম মেডিক্যালে যান, সেখানে আমাদের অনেকে আহত অবস্থায় আছে।’ এনাম মেডিক্যালে পৌঁছে দেখি একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স আসছে-যাচ্ছে, ২০ থেকে ৩০ জন আহত ছাত্রছাত্রী দেখতে পেলাম, তাদের সঙ্গে প্রায় একঘণ্টা থেকে এবং চিকিৎসার বিষয়ে ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে ক্যাম্পাসে এলাম। 

ততক্ষণে ছাত্রছাত্রীরা হামলার প্রতিবাদ ও নিরাপত্তার দাবিতে ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছে। খবর পাচ্ছিলাম, ছাত্রলীগ হামলা করতে পারে। আমাকে দেখে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীরা আশ্বস্ত হলো, ওরা ভীতসন্ত্রস্ত ছিল। বারবার বলছিল আমরা নিরাপত্তার জন্য এখানে এসেছি। আমি ওদের আশ্বস্ত করলাম, তোমরা ভিসির বাড়ির সামনে আছ, এটা নিরাপদ জায়গা, তোমরা দুশ্চিন্তা কোরো না। তারপর ভিসির বাড়িতে প্রবেশ করে দেখলাম ভিসি, প্রো-ভিসি, প্রক্টর, কয়েকজন ডিন এবং ১২-১৪ জন প্রভোস্ট একসঙ্গে বসে রয়েছেন। আমি ভিসি ও প্রক্টরকে অনুরোধ করলাম ‘দিনে যা হয়েছে, তা হয়েছে। আপনারা দয়া করে ব্যবস্থা নিন, আপনার বাসার সামনে যে ছেলেমেয়েরা অবস্থান নিয়েছে তাদের ওপর রাতে যেন হামলা না হয়।’

ক্যাম্পাসে কয়েকশ পুলিশ ছিল, আমি ভিসি ও প্রক্টরকে বললাম, অন্তত একশ পুলিশ এনে শিক্ষার্থীদের দুই পাশে দাঁড় করিয়ে দিন, এদের নিরাপত্তা দিন। প্রক্টর আমাকে একাধিকবার জানালেন, আমরা চেষ্টা করছি, কিন্তু আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। ১০টার সময় শিক্ষার্থীদের ওপর নারকীয় হামলা হলো। চারদিক থেকে ঘিরে শিক্ষার্থীদের ওপর শত শত কাচের বোতল, পেট্রল বোমা, ককটেল ইত্যাদি মারতে শুরু করল। শিক্ষার্থীরা তখন ভিসির বাসার গেট খুলে ভেতরে আশ্রয় নিল। একপর্যায়ে ছাত্রলীগের কর্মীরা ভেতরে ঢুকে পড়ল এবং নারকীয় হামলা চালাল, আমি যে কীভাবে সেদিন বেঁচে গেছি তা আল্লাহ জানেন। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া যে সেদিন কেউ মারা যায়নি। পুরো ঘটনায় পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল। 

ছাত্রলীগ যখন হামলা করছিল তখন শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ সাহায্য চেয়ে ফেসবুক লাইভ করছিল, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে একযোগে প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে এসে যখন ঢুকল, আমরা ভয় পেয়েছিলাম, ভেবেছিলাম এরা ছাত্রলীগের কর্মী, হামলা করতে এসেছে। কিন্তু আমাদের সঙ্গে আন্দোলনরত এক ছাত্র ওই মিছিলের একজনকে যখন জড়িয়ে ধরল, তখন বুঝতে পারলাম এরা আমাদের উদ্ধার করতে এসেছে। হঠাৎ করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা পুলিশকে ধাওয়া দিল। পুলিশ লাঠিপেটা করতে শুরু করল, একপর্যায়ে টিয়ার শেল ও শটগানের গুলিও ছুড়তে শুরু করে। আমি ও আমার এক কলিগ একটি কাঁঠালগাছের দুই পাশে অবস্থান নিলাম, টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় চোখে জ্বালাপোড়া করছিল, দমবন্ধ হয়ে আসছিল, সে অবস্থায়ই আমার কলিগের গলা শুনতে পেলাম ‘রব্বানী আমার গুলি লেগেছে’। আমি যে তার সাহায্যে এগিয়ে যাব আমার তখন সে শক্তি ছিল না। আমার ওই কলিগ এখনো সুস্থ হয়নি, চোখে শটগানের গুলি লেগেছে, চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে অবস্থান করছেন। ১৬ তারিখ সকালে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট ডাকল, আমরা শিক্ষকরা গিয়ে ভিসিকে ধরলাম, রাতের ঘটনার জবাবদিহি চাইলাম। সেখান থেকে বেরিয়ে দেখি আশপাশের সব স্কুল-কলেজের অন্তত পাঁচ-ছয় হাজার শিক্ষার্থী এসে পুরো ক্যাম্পাস ভরে ফেলেছে, তারা ইউনিফর্ম পরিহিত এবং সবার হাতেই লাঠি। আমি সেদিনই বুঝে ফেললাম শেখ হাসিনার আর কোনো উপায় নেই। সেদিন রাতেই সরকার দেশের সব স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একদম সিলগালা করে দিয়েছিল। 

১৭ তারিখ সকাল ১০টার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট বসলে, ছাত্রছাত্রীরা সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল, সারা ক্যাম্পাস পুলিশে ভরে গেল। ১২টার দিকে হল বন্ধ করার ঘোষণা এলো। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে তাদের বোঝালাম, ‘আন্দোলন আমরা করব, কিন্তু তোমাদের জীবন আগে, আপাতত ফিরে যাও’। কিন্তু আমি ওদের বাড়িতে পাঠাতে পারিনি। রেজিস্ট্রার যখন হল বন্ধের ঘোষণাপত্র পাঠ করছিল, তখন শিক্ষার্থীরা তাকে জুতা নিক্ষেপ করল এবং ভাঙচুর করতে শুরু করল। তারা হল ছাড়বে না, লাঠি, ইটের খোয়া ইত্যাদি নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। বিকেল ৩টা থেকে পুলিশ ম্যাসাকার শুরু করল। আমি ফেসবুকে পোস্ট করলাম ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা শুরু হয়েছে, আমি তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত’। সারা ক্যাম্পাস টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় ভরে উঠল। পুলিশের শটগানের গুলি থেকে বাঁচতে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের ঝোপঝাড়ে, ভবনের পেছনে লুকিয়ে পড়ল, পুলিশ সেসব জায়গাতেই টিয়ার শেল নিক্ষেপ করতে থাকল, শিক্ষার্থীরা সেখানে শ্বাসকষ্টে ভুগছিল। 

আমরা তাদের উদ্ধার করতে পারছিলাম না, অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে মুভ করতে পারছিলাম না। মেডিক্যালের সামনে আমি রীতিমতো কাঁদছিলাম, এর মধ্যে একজন মোবাইল ক্যামেরা ধরে আমাকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করল, আমার সে বক্তব্যটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে যায়। দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচিত হয়। এখানে বলে রাখা দরকার, ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের মেরে রক্তাক্ত করেছে। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় উল্টো ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করেছে। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম বিজয় এটা। 

১৮ তারিখ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনকে আরো চরম পর্যায়ে নিয়ে গেল। এরপর আন্দোলন ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকল। ২২ অথবা ২৩ তারিখ সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীরা আমাকে জানাল শহীদদের স্মরণে তারা একটা স্মৃতিস্তম্ভ করতে চায়। সামান্য কিছু টাকা পাঠালাম ওদের সঙ্গে একাত্ম থাকার জন্য। স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের পর আমরা বাইশ-তেইশ জন শিক্ষক সরাসরি স্মৃতিস্তম্ভের সামনে শিক্ষার্থীদের পক্ষে সমর্থন জানালাম। এর মধ্যেও আন্দোলন কিন্তু থেমে নেই। শিক্ষার্থীরা প্রতি দিন দুইবার-তিনবার করে ক্যাম্পাস থেকে মিছিল নিয়ে হাইওয়েতে যেত­- প্রত্যেক দিনই আমি মিছিলে ছিলাম। ২৯ জুলাই একজন ছাত্র ফোন করে বলল, ‘স্যার, বিকেলে আমরা একটা বিক্ষোভ সমাবেশ করব, আপনি আসুন’। ৩টার দিকে ক্যাম্পাস থেকে মিছিল করে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক হয়ে আবার ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারে এসে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলো। সমাবেশ যখন শুরু হলো তখন ভাবলাম, বিরাজমান পরিস্থিতিতে আমি কী বলতে পারি? আমার মাথায় শুধু একটা বিষয়ই ঘুরছিল ‘মানুষকে বের করতে হবে, নইলে এ ম্যাসাকার থামবে না। শেখ হাসিনাকে আর ফেলা যাবে না।’ মঞ্চে তখন চার-পাঁচজন শিক্ষক, আর শখানেক শিক্ষার্থী উপস্থিত আমাদের সামনে। বক্তব্যে আমি বললাম, “প্রথমেই একজন শিক্ষক হিসেবে এই স্বাধীন বাংলাদেশে আমার শিক্ষার্থী হত্যার বিচার চাই। যাদের গুম করা হয়েছে তাদের ফেরত চাই। যাদের ধরে নিয়ে গিয়েছে, তাদের পরিবারে ফেরত চাই। যে শিক্ষার্থীরা ঘরে ঘুমাতে পারছে না, তাদের ঘরে ঘুমাতে দেওয়ার পরিবেশ চাই। সব নির্যাতন বন্ধ করা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার আহ্বান জানাই। যেসব অভিভাবক, পেশাজীবী, শিক্ষক এখনো নীরব আছেন তাদের জন্য একটি বার্তা আছে আজকের দিনে। সে বার্তাটি আমি কবি নবারুণ ভট্টাচার্যের লেখা ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ কবিতার কয়েকটি চরণ থেকে তুলে আনছি। কবিতা আবৃত্তি করতে গিয়ে আমি ভীষণ আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলাম, এটি আমার জীবনের স্মরণীয় মুহূর্ত। আমার বক্তৃতা ও আবৃত্তি শেষ করে যখন আমার ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকালাম, দেখতে পেলাম সবাই কাঁদছে। আমার এ বক্তব্য অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ার পর জাহাঙ্গীরনগরে হাজার হাজার মানুষ এসেছে। মানুষ বুঝতে পারল এখানে আন্দোলন হচ্ছে।”

৪ আগস্টের ম্যাসাকারের পর সবাই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল ৫ তারিখ লংমার্চ হবে কি না, জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীরাই প্রথম লংমার্চ শুরু করে। সকাল ৯টায় লংমার্চ শুরু হয়। আমি ৮টায় এসে উপস্থিত হলাম। বাসা থেকে বেরিয়ে আসার সময় আমার স্ত্রী কাঁদছিল, আজ কী হবে এ আশঙ্কায়। আমি বললাম ভয় পেও না, মানুষ নামবে। আমরা অল্প-অল্প করে এগিয়ে যাওয়ার কৌশল নিলাম। ডেইরিগেট থেকে আমরা প্রথমে গেলাম এমআইএস গেট, সেখানে থেমে কিছু সাংবাদিককে সামনের দিকে পাঠালাম পরিস্থিতি দেখে আসার জন্য। তারা ফিরে এলে আমরা রেডিও কলোনি পর্যন্ত এগিয়ে যাই। আমার পায়ে সমস্যা থাকার ফলে আমি আর হাঁটতে পারছিলাম না, আমি সেখান থেকে ফিরে আসি। রেডিও কলোনি থেকে নিউ মার্কেট পর্যন্ত একটি টিম পাঠানো হলো পরিস্থিতি দেখার জন্য, তারা ফিরে এলে আমার সহকর্মী শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে নিউ মার্কেট পর্যন্ত এগিয়ে যায়। সেখানে তাদের ওপর গুলিবর্ষণ হলো। শ্রাবণ গাজি নামের একজন শিক্ষার্থী আমার কলিগের পাশেই ছিল, গুলি খেয়ে স্পটেই মারা গেল। শেখ হাসিনা যখন পালিয়ে গেল তখনো সাভারে গুলি চলছিল।

পরিশেষে এ আন্দোলনের বিষয়ে আমি একটা কথা বলতে পারি, কোনো মাস্টার মাইন্ডের ডাকে কেউ আসেনি। সবাই যার যার জায়গা থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসেছে। যেমন- ঢাকার মোহাম্মদপুর, বসিলা, শনির আখড়া, মিরপুর-১০, মহাখালী, বাড্ডা- এসব এলাকায় মধ্যবিত্ত-নিন্মমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষ, গাজিপুরের গার্মেন্টস ওয়ার্কার- এরা কেউই বিসিএসের চাকরির আশায় আন্দোলনে অংশ নেয়নি। সবার নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল। এদের দারিদ্র্য-ক্ষুধা নিয়ে শেখ হাসিনা ও তার লোকজন ঠাট্টা করেছে, শেখ হাসিনা নিজে সংসদে দাঁড়িয়ে কাঁঠালের রেসিপি দিয়েছেন। এ মানুষগুলোর প্রত্যাশা ছিল, বিশ্বাস ছিল শেখ হাসিনাকে নামাতে পারলে আমরা অর্থনৈতিকভাবে মুক্তি পাব, আমরা ভালো থাকব, আমরা বাজারে গিয়ে স্বস্তি পাব, আমরা চাল-ডাল কিনে দুবেলা-দুমুঠো খেতে পারব।

কিন্তু গত চার মাসে এ সরকার পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়েছে। প্রশ্ন আসতে পারে চার মাস কি যথেষ্ট? না যথেষ্ট নয়, কিন্তু খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রধান উপদেষ্টা ১০০ দিন উদযাপন করেছেন, কারণ ১০০ দিন গুরুত্বপূর্ণ। ১৯২৯ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মহামন্দা হয়েছিল। ১৯৩৩-এ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট। তিনি ক্ষমতায় এসে দেশবাসীর উদ্দেশে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেন, ‘আপনারা ভয় ছাড়া কোনো কিছুকে ভয় পাবেন না’। এরপর তিনি ১০০ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন, ‘রিকভারি, রিকনস্ট্রাকশন, রিফর্ম’। এর থেকে বোঝা যায় তাত্ত্বিকভাবে একটা বিপ্লব-পরবর্তী ১০০ দিন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। অনেক কিছু করা সম্ভব। কিন্তু আমরা দেখেছি, এই সরকার এবং যেসব ছাত্র নেতা নেতৃত্বে আছে, তাদের কথা বলার ক্ষেত্রে এবং কাজ করার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের জায়গায় কী থাকবে তারা সেটি ঠিক করতে পারেনি। ৫ আগস্ট যে গণ-অভ্যুত্থান ছাত্র-জনতা ঘটিয়েছে সেটি হলো দেশের মানুষের সার্বিক মুক্তি। কিন্তু আমি মনে করি, ৫ আগস্ট লড়াই শুরু হয়েছে, শেষ হয়ে যায়নি। এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক মুক্তি যতদিন না আসবে, ততদিন আমাদের এ লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে। লড়াইয়ের চরিত্রটি হোক বুদ্ধিবৃত্তিক।

লেখক: ড. মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী, অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫