Logo
×

Follow Us

ক্যাম্পাস

অপরিকল্পিত উন্নয়নে হুমকিতে ঢাবির প্রাণ-প্রকৃতি

Icon

কেএম ওবায়দুল্লাহ

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২২, ১০:০৯

অপরিকল্পিত উন্নয়নে হুমকিতে  ঢাবির প্রাণ-প্রকৃতি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় রাজু ভাস্কর্যের উপর দিয়ে মেট্রোরেলের কাজ চলছে। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এলাকায় বছরদশেক আগেও খেকশিয়ালের বিচরণ ছিল। গোধূলিলগ্নের সঙ্গে সঙ্গেই বিকট চিৎকার এবং সারারাতে কয়েকবার ডাক দিয়ে জানান দিত নিজেদের অস্তিত্বের। এখন সেই দৃশ্য নিকট অতীত, দোয়েলের শিসটুকু পর্যন্ত শোনা যায় না শীতের সকালে। বিশ্বব্যাপী নগরায়ণের প্রভাবে সবুজ কেটে কংক্রিটের আচ্ছাদন বাড়ছে। অবাধে উজাড় হচ্ছে গাছপালা। পরিবেশগত সংকট বৃদ্ধির পাশাপাশি হুমকির মুখে পড়ছে জীববৈচিত্র্য।

ঢাবি এলাকাও এর বাইরে নয়, অপরিকল্পিত উন্নয়নের চাপে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে সেখানকার প্রাণ-প্রকৃতি। বিষেশজ্ঞরা বলছেন, গত দুই দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসংখ্যা বেড়েছে কয়েক গুণ। তাদের আবাসন ও শ্রেণিকক্ষের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে বেশ কিছু বহুতল ভবন। পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, বিশেষ করে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজও বেশ প্রভাব ফেলেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বৈচিত্র্যে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাধিক গবেষণায়ও ঢাবি এলাকার প্রাণ-প্রকৃতির ক্ষতির বিষয়টি উঠে এসেছে।

গবেষকরা বলছেন, উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের ফলে ক্রমেই কমে আসছে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বন্যপ্রাণীর প্রজনন ও বিচরণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের পাঁচ শিক্ষক সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বন্যপ্রাণীদের জীবনধারণ নিয়ে একটি গবেষণা করেন। সেই গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়, প্রতিকূল পরিবেশেও ৯৪ প্রজাতির ২০ বর্গের অন্তত ৫২ পরিবারের প্রাণীর বিচরণ রয়েছে ঢাবি এলাকায়। মূলত চার শ্রেণির প্রাণীদের বিচরণের প্রমাণ পেয়েছেন গবেষকরা। এর মধ্যে পাঁচ শতাংশ উভচর, ১০ শতাংশ সরীসৃপ, ৭০ শতাংশ পাখি ও ৯ শতাংশ স্তন্যপায়ী। ২০১৭ সালের মার্চ থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট তিন বছরে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বিভিন্ন স্থান পর্যবেক্ষণ করে এসব প্রাণীর সন্ধান মিলে বলে গবেষকদের দাবি।

গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিচরণ করা পাখির মধ্যে তোতা, টিয়া, ডাহুক, শিকরা, ঝুঁটি শালিক, গাঙ শালিক, ভাত শালিক, ফটিকজল শালিক, পাতি মাছরাঙা, ধানি তুলিকা, বাতাসি, কানিবক, অঞ্জন, গোবক ইত্যাদি অন্যতম। এ ছাড়াও কয়েক প্রকার ইঁদুরের দেখা পেয়েছেন গবেষকরা। এর মধ্যে অন্যতম ধাড়ি ইঁদুর, বড় ইঁদুর, নেংটি ইঁদুর, কালো ইঁদুর। পাঁচডোরা কাঁঠবিড়ালি, কাঁঠবিড়ালি, ছোট বেজি, লাল বানর, চামচিকা, উড়ন্ত শিয়াল (ইন্ডিয়ান ফ্লায়িং ফক্স) ইত্যাদি।

সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীর মধ্যে গিরগিটি, লিজার্ড, তক্ষক, হাউস লিজার্ড, টিকটিকি, দুমুখো সাপ, সুন্দি কাছিম, বেঙ্গল লিজার্ড, জলঢোঁড়া সাপ ইত্যাদির সন্ধান মিলেছে। তবে ভয়ানক তথ্য ওঠে এসেছে অ্যাম্ফিবিয়া পরিবারের ব্যাঙ প্রজাতির প্রাণীর ক্ষেত্রে। গবেষণার প্রথম বছর ৪০ শতাংশ প্রাণীই রেকর্ড করা হয়েছিল ব্যাঙ প্রজাতির। পরবর্তী বছর ধীরে ধীরে এর সংখ্যা কমতে থাকে বলে গবেষকরা দাবি করেছেন। মূলত বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ক্রমবর্ধমাণ মানুষের হাঁটাচলা ও শব্দদূষণের কারণে বন্যপ্রাণীদের জীবনধারণ হুমকির মুখে পড়ছে। 

গবেষক দলের অন্যতম সদস্য সহকারী অধ্যাপক মো. মাহবুব আলম বলেন, ‘ঢাকার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এখনো যথেষ্ট সবুজ। ফলে এখানে বন্যপ্রাণীরা বসবাস করছে। আমরা মূলত দেখেছি বন্যপ্রাণীদের বসবাসের ক্ষেত্রে মানুষের আনাগোনা ও শব্দদূষণ এবং উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ কীভাবে প্রভাব ফেলছে। আমাদের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মানুষের হাঁটাচলা এবং ক্রমবর্ধমাণ শব্দদূষণ বন্যপ্রাণীদের জীবনধারণে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বন মানেই নীরব এলাকা। আর সেখানে যেসব প্রাণী বাস করে তাদের নীরবতাই পছন্দ; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সে পরিবেশ ধীরে ধীরেই কমছে। যদিও এখনো বেশ কিছু এলাকা সন্ধ্যার পর পুরোপুরি নীরব হয়ে যায়, এ কারণেই প্রতিকূল পরিবেশ হলেও বন্যপ্রাণীরা আমাদের একেবারে ছেড়ে যাচ্ছে না। এদের সঠিক জীবনযাপনের জন্য যতটুকু সম্ভব অনুকূল পরিবেশ দেওয়া প্রয়োজন।’

বন্যপ্রাণীদের প্রজননের ব্যাপারে জানতে চাইলে এ গবেষক বলেন, ‘গবেষণায় আমরা বলেছি- ওদের বিচরণ ও প্রজননে প্রভাব পড়ছে; কিন্তু একেবারেই যে প্রজনন বন্ধ, সে কথা বলা যাবে না। বিরক্তির শব্দদূষণপূর্ণ এলাকায় ওরা মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা যেমন করছে পাশাপাশি ওদের প্রজননও অব্যাহত রেখেছে। নয়তো এখানে ৪৯২ প্রজাতির প্রাণী পাওয়া যেত না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. ফিরোজ জামানের নেতৃত্বে চালানো এ গবেষণাটি ইতালির বায়োডাইভার্সিটি জার্নালে প্রকাশ হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যপ্রাণী রিসার্চ ল্যাবরেটরির অধীনে গবেষণাটি ২০৩০ সাল পর্যন্ত চালানো হবে। অধ্যাপক ফিরোজ জামান বলেন, ‘গবেষণায় দেখা গেছে, পাখির মধ্যে এখনো বিপন্ন প্রজাতি তেমন নেই; কিন্তু স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রে বিপন্ন প্রজাতি আছে কয়েকটি। প্রতিকূল পরিবেশে বাস করা এসব প্রাণীর বড় অংশটি এখন অস্তিত্বের সংকটে। ঢাকার পরিবেশ থেকে সবুজ যেভাবে কমছে তাতে এদের সংরক্ষণের ব্যবস্থা না নিলে অচিরেই হারিয়ে যাবে।’ 

কার্জন হলের বোটানিক্যাল গার্ডেনে গত বছরের ডিসেম্বরে যাত্রা শুরু হয় গ্রিন হাউস প্রজেক্টের। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রোগপ্রতিরোধী ফসল গবেষণায় এটি নির্মাণ করা হলেও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার প্রাণ-বৈচিত্র্যের জন্য সেটি হুমকিস্বরূপ। একইভাবে বিশ্ববিদ্যায়ের সায়েন্স ক্যাফেটেরিয়া নির্মাণের সময়ও বৃক্ষ নিধন করা হয়। যদিও এ নিয়ে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ প্রতিরোধ আমলে নিচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে মেট্রোরেলের রুট যাওয়ার বিরোধিতা করেছেন শিক্ষার্থীদের একাংশ। তাদের অভিযোগ- ট্রেন চলাচলে উচ্চ শব্দ ও যাত্রীদের ভিড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হবে। ক্ষতি হবে জীববৈচিত্রের। যদিও প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাথমিকভাবে শাহবাগ থেকে রোকেয়া হল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, বুয়েট হয়ে সায়দাবাদ যাওয়ার কথা ছিল মেট্রোরেলের পথ। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আপত্তির কারণে শাহবাগ থেকে টিএসসি, বাংলা একাডেমি, দোয়েল চত্বর, হাইকোর্ট, প্রেসক্লাবের দিকে রুট নির্ধারণ করা হয়। এরইমধ্যে শেষ হয়েছে পথ নির্মাণকাজ। সেক্ষেত্রে কাটা পড়েছে বেশ কিছু গাছ, যেগুলোতে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির আবাস ছিল। শিক্ষার্থীরা বলছেন, এসব গাছ কেটে ফেলার ফলে শুধু রাস্তার সৌন্দর্যহানিই হয়নি, এ এলাকার পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা জানান, বিশ্বের জনবহুল শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা অন্যতম। এখানে ব্যাপক অপরিকল্পিত অবকাঠামো এবং উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চলমান। এতে শহরটির জীববৈচিত্র্য মারাত্মক বিঘ্নিত হচ্ছে। শহরটির কেন্দ্রে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তুলনামূলক গাছ বেশি থাকায় এখানে প্রাণবৈচিত্র্য অন্য এলাকার চেয়ে ভালো। তবে ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ ও লোকসমাগম বৃদ্ধির প্রভাবে হুমকির মুখে পড়েছে এ প্রাণ-প্রকৃতি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ‘আমরা নানান সময় বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু গাছ ছিল, যেগুলোতে চিল বসত। গাছগুলো কেটে ফেলার সময় আন্দোলন করেছি। এ ছাড়া আরও বিভিন্ন সময় বন্যপ্রাণীদের অবাধ বিচরণ বাধাগ্রস্ত হয়- এমন উদ্যোগের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ করেছি। প্রশাসন কখনো আমাদের কথা শুনেছে? শেনেনি। আসলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। এখানেই যদি পরিবেশ, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য নিরাপদ না হয়, তা হলে আর কোথায় সম্ভব? আসলে এটি জাতির জন্য চরম দুঃখজনক।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের পকিল্পনাতেই পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের বিষয়টি থাকা জরুরি বলে মন্তব্য করেন এই পরিবেশকর্মী।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫