Logo
×

Follow Us

নগর

ভূমিকম্পের ঝুঁকি

ঢাকার প্রস্তুতি কতটুকু

Icon

প্রতীক সিফাত

প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০:০৫

ঢাকার প্রস্তুতি কতটুকু

রাজধানী ঢাকা।

ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায়ই কেঁপে ওঠে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। এসব ভূমিকম্পে তেমন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও বড় মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগে বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের কাতারে রয়েছে ঢাকা।

ঘনবসতির এ শহরটির ঝুঁকি কমাতে বিভিন্ন প্রকল্প ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও তার বেশিরভাগই আলোর মুখ দেখেনি। তুরস্ক ও সিরিয়ায় গত ৬ ফেব্রুয়ারির ভূমিকম্পে প্রাণ হারিয়েছে কয়েক হাজার লোক। তুরস্কের ১০ প্রদেশে ধসে পড়েছে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি বহুতল ভবন। সিরিয়া ও তুরস্ক- দুই দেশ মিলিয়ে কয়েক হাজার ভবন ধসে পড়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই আলাচনায় আসছে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শহরের তালিকায় থাকা ঢাকার প্রস্তুতি নিয়ে। কেননা আর্থ অবজারভেটরি সেন্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইন্ডিয়ান, ইউরোপিয়ান ও বার্মা- এ তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। ফলে যে কোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত করতে পারে এ বদ্বীপ অঞ্চলে।

ভূমিকম্পের কোনো পূর্বাভাস ব্যবস্থা নেই। সে জন্য দিনক্ষণ সুনির্দিষ্ট করে বলতে না পারলেও বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ, সেটা হতে পারে যে কোনো সময়। কিন্তু তা মোকাবিলার প্রস্তুতিতে অনেকটাই পিছিয়ে বাংলাদেশ।

বহু পুরনো ভবন, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করা- ভূমিকম্প ঝুঁকি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা জানান, ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রমের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষিত জনবলেরও সংকট রয়েছে।

ভূ-তত্ত্ববিদরা বলছেন, সাধারণত প্রতি একশ বছর পরপর বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে। সর্বশেষ ১৮২২ ও ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। সে হিসাবে আরেকটি বড় ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। রাজধানী ঢাকা রয়েছে মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. বদরুদ্দোজা মিয়া বলেন, ‘যে কোনো সময় যে কোনো মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে বাংলাদেশে। ঝুঁকির মাত্রা বিবেচনায় বাংলাদেশকে তিনটা জোনে ভাগ করা হয়েছে। উত্তরবঙ্গের রংপুর থেকে শুরু করে সিলেট- এ জোনটা উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ঢাকা, রাজশাহী থেকে শুরু করে কুমিল্লা, নোয়াখালী অঞ্চল মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ। আর দক্ষিণ-পূর্ব দিকটা নিম্ন ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়ে থাকে।’

১৯৭৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত যতবার পাঁচ বা তার বেশি মাত্রায় ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে, তার প্রায় সব কটির উৎপত্তিস্থল সিলেট, মৌলভীবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজার এলাকায়। এসব অঞ্চলে ভবিষ্যতে আরও বেশি মাত্রার ভূকম্পনের পূর্বাভাস উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

আসাম-বাংলা অঞ্চলে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল ১৮৯৭ সালের ১২ জুন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম, মেঘালয়ের সীমান্ত সংলগ্ন সিলেট, ময়মনসিংহ অঞ্চল উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর।

সম্প্রতি রাজধানীর পুরান ঢাকা ঘুরে দেখা যায়, অল্প জায়গায় অনেক মানুষের বসবাস। ভবনগুলো দাঁড়িয়ে আছে একটি আরেকটির গা ঘেঁষে। যে ভবনটি তিনতলা করার কথা সেটি করা হয়েছে ৪-৫ তলা, দুর্বল অবকাঠামো এবং পুরাতন জীর্ণশীর্ণ। এক একটি ফ্ল্যাটে থাকেন ১০-১৫ জন। বাণিজ্যিক কেন্দ্র হওয়ায় সেখানকার অলিগলিতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য দোকানপাট ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান। তাই দিন-রাত মানুষের ভিড় লেগে থাকে।

রাজধানীতে ভূমিকম্প হলে ভবনগুলো থেকে তৎক্ষণাৎ সরে যাওয়ার ব্যবস্থাটুকুও নেই। পুরান ঢাকার বাসিন্দারা তাই ভূমিকম্পের সময় ভয়ে থাকেন, কখন না তাদের ভবনটি নিজেদের ওপরেই ধসে পড়ে। রাস্তাগুলো সরু হওয়ায় সেখানে উদ্ধার কাজ করাও কঠিন বলছে ফায়ার সার্ভিস। এত অল্প জায়গায় এমন বহুতল ভবন ভূমিকম্প বা অন্য যে কোনো দুর্যোগের ক্ষেত্রে ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

অধ্যাপক বদরুদ্দোজা বলেন, ‘ভবনের ফ্রিকোয়েন্সি ও গ্রাউন্ডের ফ্রিকোয়েন্সির মধ্যে সম্পর্ক আছে। দেখা যায় একই জায়গায় দুই তলা একটা ভবন ভেঙে যাচ্ছে, কিন্তু ১০ তলা ভবন ঠিকই দাঁড়িয়ে আছে। কারণ ভূমিকম্পের সঙ্গে ভূমি যখন কাঁপে তার একটা ফ্রিকোয়েন্সি আছে। তার সঙ্গে ভবনটাও কাঁপে, সেটারও একটা ফ্রিকোয়েন্সি আছে। গ্রাউন্ড যেভাবে মুভ করছে, ভবন যদি তার বিপরীতে মুভ করে তাহলে সেটি ভেঙে পড়বে।

নিউজিল্যান্ডে আমি দেখে এসেছি তারা ভবন বানাচ্ছে আর ভবনের নিচে অনেক বড় বড় বিয়ারিং সেট করে দিচ্ছে। যেন ভূমিকম্পের সময় গ্রাউন্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভবন মুভ করে এবং একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত। তখন আর এটি ভেঙে পড়ে না। ঢাকা অনেক বেশি ঘনবসতির শহর। এখানে ভবন থেকে ভবনের যে দূরত্ব থাকা দরকার সেটি মানা হয় না। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাও অনেক খারাপ।’ 

সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ও জাইকার ২০০৯ সালে করা এক যৌথ জরিপে জানা গেছে, ঢাকায় সাত বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে, শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে এবং এক লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তৈরি হবে সাত কোটি টন কংক্রিটের স্তূপ।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা শহরের ৭৬ শতাংশ রাস্তা সরু হওয়ায় ভূকম্প হলে উদ্ধার তৎপরতা চালানো কঠিন হয়ে যাবে। এছাড়া ৬০ শতাংশ ভবন মূল নকশা পরিবর্তন করে গড়ে ওঠায় বড় ধরনের ভূমিকম্পের সময় এ অপরিকল্পিত ভবনগুলো সঙ্গে সঙ্গেই ধসে পড়তে পারে। সেই সঙ্গে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইনে বিস্ফোরণ ঘটে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ভূমিকম্প অসহনশীল ভবনগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সংস্কার বা ধ্বংস করার পরিকল্পনা করা হলেও তার কোনো বাস্তবায়ন নেই। 

নেপালে ২০১৫ সালে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের প্রভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল। সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিলের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ‘ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার’ প্রতিষ্ঠার। সেই সিদ্ধান্তটিও এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। এছাড়া ওই বৈঠকে ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এনডিএমআইএস) নামে একটি ওয়েবসাইট তৈরির সিদ্ধান্তও হয়েছিল। এটিও আলোর মুখ দেখেনি।

ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘ঢাকার ভবনের যে কোয়ালিটি, সেটি অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বল। অনেক এলাকাতেই, বিশেষ করে গত ১০ বছরে, অল্প কিছু মাটি ভরাট করে অনেক বড় বড় ইমরাত হচ্ছে।

আবার অনেক বড় বড় অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে ঢাকায়; হতে পারে সেগুলো অনেক নিয়ম মেনে করা হচ্ছে। কিন্তু যখন বড় মাত্রার ভূমিকম্প হবে, তখন হিসাব-নিকাশ উলট-পালট হয়ে যাবে অনেক ক্ষেত্রেই। সম্প্রতি রাজউক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ অনেক ভবনের তালিকা করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দৌড়টা- তালিকা করা পর্যন্তই। পরে এর কোনো তদারকি নেই।’

রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদরা যদিও বলছেন, কোনো ভবন ভূমিকম্প সহনশীল কিনা সেটা খতিয়ে দেখার কোনো সক্ষমতাই তাদের নেই। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো গুঁড়িয়ে ফেলা কিংবা ভূমিকম্প সহনশীল করে সংস্কার করা প্রয়োজন হলেও এ কাজে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যায় না। 

নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল বলেন, ‘এমন অনেক সরকারি স্থাপনা, স্কুল, হাসপাতাল- এসব প্রতিষ্ঠানও ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে। কিছু কিছু জায়গায় তো ভূমিকম্প ছাড়াই ভবন ধসে যাচ্ছে। এমনিতেই অনেক ঝুঁকিতে আছে, তার মধ্যে যদি ভূকম্পন হয়, তাহলে না আছে পর্যাপ্ত উদ্ধার ব্যবস্থা, না আছে খালি জায়গা; যেখানে মানুষ গিয়ে দাঁড়াবে। তার মধ্যে গ্যাস-বিদ্যুতের ঝুঁকিপূর্ণ সংযোগ থেকে ভূমিকম্পের সময় আরও বড় দুর্ঘটনা হতে পারে। সব মিলে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ একটা শহর ঢাকা।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫