
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ছবি: সংগৃহীত
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিঃসরণের নির্ধারিত কোনো মানমাত্রা নেই দেশে। তাই বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০২২ অনুসারে বায়ুকণা, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড নিঃসরণের একটি মাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
সেগুলো আবার ভারতের বিভিন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনায় ঢের বেশি। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের দেওয়া প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে এসেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর কিসের ভিত্তিতে নতুন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের নিঃসরণ মাত্রা নির্ধারণ করে- সে বিষয়টি জানতে চেয়ে সুপারিশ করেছিল সংসদীয় কমিটি। এর পরিপ্রেক্ষিতে করা প্রতিবেদনে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পাশাপাশি মালয়েশিয়া, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, কম্বোডিয়াসহ বিভিন্ন দেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কার্বন নিঃসরণের হার ও মানমাত্রা তুলে ধরা হয়।
তিনটি প্যারামিটারের মাধ্যমে তুলে আনা তুলনামূলক এ চিত্রে দেখা যায়, বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০২২ অনুসারে পার্টিকুলেট ম্যাটারের (পিএম) মানমাত্রা ২০২০ সালের পর দেশে চালু কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে প্রতি ঘনমিটারে ৫০ মিলিগ্রাম। এর আগে চালু কেন্দ্রের ক্ষেত্রে ১০০ মিলিগ্রাম। যদিও এনভারনমেন্ট, হেলথ অ্যান্ড সেফটি গাইডলাইন (থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট) অনুযায়ী, বিশ্বব্যাংকের আইএফসির নির্ধারিত মানমাত্রা নন-ডিগ্রেডেড এয়ারশেডে (এনডিএ) ৫০ মিলিগ্রাম এবং ডিগ্রেডেড এয়ারশেডের (ডিএ) ক্ষেত্রে ৩০ মিলিগ্রাম।
প্রতিবেশী দেশ ভারতও সেই মাত্রা মেনে চলছে অর্থাৎ ২০০৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে চালু প্রকল্পে পার্টিকুলেট ম্যাটারের মানমাত্রা ৫০ এবং ২০১৬ সালের পর চালু কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে ৩০ মিলিগ্রাম নির্ধারণ করেছে। অন্যান্য দেশে অবশ্য এ মাত্রা ৫০ থেকে ৪০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত।
এদিকে দেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে সালফার ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে প্রতি ঘনমিটারে ২০০ থেকে ৪০০ মিলিগ্রাম। এর মধ্যে ২০২০ সালের পরে চালু কেন্দ্রের ক্ষেত্রে সেটি ২০০ এবং তার আগে চালু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে ৪০০। ভারতে যদিও ২০১৬ সালের পরে চালু প্রকল্পের ক্ষেত্রে এ মানমাত্রা ১০০ মিলিগ্রাম।
তবে ২০০৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে চালু ৫০০ মেগাওয়াট থার্মালের কম ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রের জন্য সালফার ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে ৬০০ মিলিগ্রাম আর ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রের ক্ষেত্রে ২০০ মিলিগ্রাম। দেশে ২০২০ সালের পর চালু কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে নাইট্রোজেন অক্সাইড নিঃসরণের মানমাত্রা ২০০ এবং তার আগে চালু কেন্দ্রের জন্য ৪০০ মিলিগ্রাম। ভারতে ২০০৩ থেকে ২০১৬ সালে চালু প্রকল্পের ক্ষেত্রে সেটি ৩০০ এবং এর পর চালু প্রকল্পের ক্ষেত্রে ১০০ মিলিগ্রাম।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কার্বন নিঃসরণের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়ার পক্ষে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যেসব দেশ বিনিয়োগ করবে, তাদের নিজ দেশের মানমাত্রা ও বাংলাদেশের মানমাত্রা বিবেচনায় নিতে হবে। গত ৬ মার্চ রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে পরিবেশ অধিদপ্তরের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে এ সুপারিশ এসেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে রাসায়নিক নিঃসরণের ক্ষেত্রে অনেক দেশই বাড়তি সুবিধা দাবি করে। অনেক ক্ষেত্রেই তারা নিজেদের দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে নির্ধারিত মানমাত্রা এদেশে মানতে চায় না।’
তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির নতুন যে মহাপরিকল্পনা হচ্ছে, সেখানে এ মানমাত্রার বিষয়টি উল্লেখ থাকতে হবে। আর সেটি হতে হবে সংশ্লিষ্ট দেশের মানমাত্রা এবং আমাদের দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী। যেসব দেশ এখানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ করবে তাদের এ বিষয়টি মেনে নিয়েই বিনিয়োগ করতে হবে। এ বিষয়টি আমরা সংসদীয় কমিটির বৈঠক থেকে সুপারিশ আকারে নিয়ে আসব।’
এর আগে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ একটি প্রতিবেদন দেয়। সেখানে বলা হয়, সাধারণত কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, ফার্নেস অয়েল প্রভৃতি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এর মধ্যে জ্বালানির সহজলভ্যতা ও খরচ বিবেচনায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রথমে বয়লার ফার্নেসে কয়লা পুড়িয়ে উচ্চতাপমাত্রার স্টিম (বাষ্প) উৎপাদন করা হয়। স্টিম টারবাইনের মধ্য দিয়ে নিয়ন্ত্রিত উচ্চচাপে চালনা করে জেনারেটর ঘুরিয়ে উৎপাদন করা হয় বিদ্যুৎ। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে সাব-ক্রিটিক্যাল, সুপার ক্রিটিক্যাল ও আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি।
তবে সাব-ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি অপেক্ষাকৃত প্রাচীন, যা স্বল্প কর্মদক্ষতার এবং তুলনামূলকভাবে অধিক কার্বন নিঃসরণ করে। এ কারণে বর্তমানে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই এ প্রযুক্তি ব্যবহার থেকে সরে আসছে এবং সুপার ক্রিটিক্যাল ও আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৫০ সালে প্রথম সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির স্টিম জেনারেটর ব্যবহার করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়, যার কমিশনিং শুরু হয় ১৯৫৭ সালে।
এ প্রযুক্তি বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে জনপ্রিয় হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। আর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত সর্বাধুনিক প্রযুক্তি হচ্ছে আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি। এ প্রযুক্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের কর্মদক্ষতা ৪৩ থেকে ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ে এবং কার্বন নিঃসরণের হারও সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির চেয়ে ২-৩ শতাংশ কমে। প্রতিবেদনে প্রযুক্তিটিকে অত্যন্ত পরিবেশবান্ধব উল্লেখ করে বলা হয়, এ প্রযুক্তিতে কম কয়লা পুড়িয়ে অধিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়।
দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনার শুরু থেকেই পরিবেশবাদীরা এর বিরোধিতা করে আসছিলেন। তারা বলছেন, জ্বালানি পণ্যগুলোর মধ্যে পরিবেশে সবচেয়ে বেশি দূষণ ঘটায় কয়লা। এ কারণে বিশ্বব্যাপী এখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার আওয়াজ উঠেছে। বৈশ্বিকভাবেও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে এরই মধ্যে সরে এসেছে অনেক দেশ।
বাংলাদেশের ওপরও এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। যদিও পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে বলে দাবি সরকারের। ইউনেস্কো ২০১৮ সাল থেকে রামপাল প্রকল্প নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে অনেক দেশই নতুন করে কয়লা খাতে ঝুঁকছে।
প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর সদর দপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মাদ আব্দুল মোতালিব (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) বলেন, ‘দেশের আর্থ-সামাজিক বিষয়াদি বিবেচনায় নিয়েই বিদ্যুৎকেন্দ্রের মানমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ভারতের বেশিরভাগ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ২০১৬ সালের আগে স্থাপিত।
এ জন্য তাদের মানমাত্রার সঙ্গে আমাদের কিছু পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। তবে এটি নির্ধারিত কিছু না। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ার পর আরও যাচাই-বাছাই করে এ মানমাত্রা আরও সুনির্ধারিত করা হবে, যাতে পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি কম হয়।’