দিনে ২ ঘণ্টা বন্ধ থাকে রমনা পার্ক, ভোগান্তিতে দর্শনার্থীরা

তাসকিনা ইয়াসমিন
প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৮:১৯

দুপুরে ২ ঘণ্টা পার্কে দর্শনার্থীদের থাকা নিষেধ বিধায় এসময় তারা পার্ক থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল
রাজধানীবাসীর অন্যতম বিনোদনকেন্দ্র রমনা পার্ক প্রতিদিন বেলা ১২টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত বন্ধ থাকে। আর এ কারণে পার্কে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের পড়তে হয় চরম বিড়ম্বনায়। এ নিয়ে দর্শনার্থীরা চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা অবিলম্বে পার্কের গেট ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার দাবি জানান। এদিকে কর্তৃপক্ষ বলছে, পার্ক পরিষ্কার করার জন্য এক ঘণ্টা বন্ধ রাখা হয়।
আজ বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে রমনা পার্কে গিয়ে দেখা যায়, দর্শনার্থীরা কেউ বেঞ্চে বসে বাদাম চিবোচ্ছেন। কেউবা সঙ্গীর সঙ্গে হেটে বেড়াচ্ছেন। ঠিক বেলা বারটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে দায়িত্বরত গার্ডরা বাঁশি বাজিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং সবাইকে পার্ক থেকে বের হতে অনুরোধ জানান। এসময় দেখা যায়, যখন দর্শনার্থীরা গেট দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছেন। ঠিক একইসময়ে বহু দর্শনার্থী গেটে ঢোকার জন্য গেটের বাইরে অপেক্ষা করছেন। কোন কোন দর্শনার্থী কর্তব্যরত গার্ডের সঙ্গে ঢুকতে না দেওয়ার কারণে তর্কেও জড়িয়ে পড়েন। সকলেই পার্কের ভিতরে ঢুকতে আগ্রহী। কিন্তু দায়িত্বরত গার্ড ঢুকতে দিতে আগ্রহী না।
শাহবাগের দিকের গেটের গার্ড আমিনুর বলেন, ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত বন্ধ থাকে। এরপর দুইটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত এই গেট খোলা থাকে। গেট কেন বন্ধ থাকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কেন এই সময় গেট বন্ধ থাকে এটা আমি সঠিক জানি না। এই প্রতিবেদক নিজের পরিচয় গোপন রেখেই তার কাছে জানতে চান আমরা বেশ কিছু দর্শনার্থীকে গেটের ভেতরে দেখতে পাচ্ছি। তারা পার্কের বিভিন্ন প্রান্তে বসে আছেন। এ প্রসঙ্গে আমিনুর বলেন, আমাদের লোকজন পুরো পার্ক জুড়েই আছে। তারা ধীরে ধীরে বাঁশি বাজিয়ে সবাইকে বের করে দিবে। এদিকে সকাল ছয়টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। আর বিকেলের দিকে দুপুর ২টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত পার্কের গেট খোলা থাকে।
তিনি বলেন, আমরা সকাল থেকে ছয় ঘণ্টা ডিউটি করি কোন অসুবিধা হয় না। কিন্তু এই দুই ঘন্টা গেট বন্ধ থাকে তখন ডিউটি করতে খুব কষ্ট হয়।
রাজধানীর রামপুরা থেকে নিজের ৬ জন ভাগিনা-ভাগিনীকে নিয়ে এসেছেন হাসান। তিনি এই প্রতিবেদকের নিকট ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমি তো রামপুরা থেকে এসেছি। ভাগনাদের সাথে করে এনেছি। তাদের নিয়ে ঢুকতে পারছি না। এটা কেমন কথা?
তিনি বলেন, প্রত্যেকটা জায়গায় দেখি এইরকম হয়রানি। মানুষের সময়ের মূল্য কেউ দিতে চায় না। কেন? ১২টায় কেন বন্ধ করেছে এটা বলতে পারছে না। কিন্তু বন্ধ করে রেখেছে।
একেএস গ্রুপের কর্মী সোহেল বলেন, আসলাম পার্কে কিছুক্ষণ সময় কাটাব। কিন্তু ঢুকতে দিবে না। এটা কোন কথা হলো?
হবিগঞ্জ থেকে ঢাকায় চিকিৎসা করাতে এসে ছোটবোন, ভাই এবং বন্ধুদের নিয়ে পার্কের গেটে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেলিনা আক্তার। তিনি বলেন, ঢাকায় এসেছি বেড়াতে। প্রথমে জাতীয় জাদুঘরে গেলাম। সেখানে বলল বৃহস্পতিবার বন্ধ। এখানে এসে এটাও বন্ধ। যাব কোথায় বুঝতে পারছি না!
রাজধানীর মিরপুর থেকে বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে আসা রুবেল হোসেন বলেন, এই পার্কটা এখন খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে আর তাই এখানে সময় কাটাতে বেশ ভাল লাগে। আর গাছপালা থাকায় এখানে এলে অনেক শান্তি লাগে। কিন্তু এই দুপুরে বের করে দেওয়ায় সমস্যা হয়ে যায়।
রমনার গেটের সামনের খেলনা বিক্রেতা মো. তরু মিয়া বলেন, ‘ক্যান বন্ধ কইরা রাহে এইটা বলতে পারব না। করোনা থাইক্যা এই দুপুরবেলা গেট বন্ধ করে রাহে। তার আগে পর্যন্ত খোলা আছিল।’
মৎস্যভবন গেটে দায়িত্ব পালনরত গার্ড ইমরান গেটে তালা দিয়ে চাবি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। এসময় গুলিস্তান থেকে আসা দুজন নারী ভিতরে প্রবেশ করতে চান। তখন ঘড়িতে বাজে পৌনে একটা। ইমরান তাদের দুজনকে ঠিক দুইটায় গেটে আসার জন্য অনুরোধ জানান। এসময় এই প্রতিবেদক নিজের পরিচয় গোপন করে ইমরানের কাছে জানতে চান এখন গেট বন্ধ কেন? ইমরান বলেন, কেন যে গেট বন্ধ তা আমি বলতে পারি না। আমি শুধু গেটটা বন্ধ করে রাখি। ঠিক দুইটায় আবার খুলে দেব।
রমনায় প্রবেশকারী দর্শনার্থীদের জন্য বেশ কিছু নিয়ম কানুন তৈরি করেছে কর্তৃপক্ষ। সেগুলো পার্কের প্রতিটি গেটে নোটিশ আকারো টাঙানো রয়েছে। নোটিশের মধ্যে রয়েছে- ‘পার্কের অভ্যন্তরে যেকোনো রকম আপত্তিকর অবস্থান করা নিষেধ।’ পার্কের অভ্যন্তরে বাইসাইকেল ও মোটরসাইকেল নিয়ে প্রবেশ করা নিষেধ।’ ‘সন্ধ্যা ৭ ঘটিকার মধ্যে সকল দর্শনার্থীগণকে রমনা পার্ক ত্যাগ করার জন্য অনুরোধ করা হইল। রমনা পার্কের ভিতরে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলাসহ অন্যান্য খেলাধুলার সামগ্রী নিয়ে প্রবেশ নিষেধ।’ এগুলো ছাড়াও প্রায় ১০ টি নির্দেশনাসহ আরো একটি নোটিশ দিয়ে রেখেছে কর্তৃপক্ষ।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, দুপুর বেলায় ২ ঘণ্টা পার্কের গেট বন্ধ থাকবে এটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। বরঞ্চ ঐ সময়ে বেশি করে পার্কের গেট খোলা রাখা দরকার। দুপুরে মানুষ পার্কে বসবে, ঘুরবে। কে এটা চালু করেছে আমি জানি না। আমি নিজেও দুই/তিন দিন গেট থেকে ঘুরে এসেছি। গেট এইসময় বন্ধ থাকে। এটা অবশ্যই বদলানো উচিত। কিভাবে এটা বদলানো যায়, সারাক্ষণ খোলা রাখা যায় সেটা ভাবা উচিত।
তিনি বলেন, করোনার আগে তো সবসময় গেট খোলা থাকত। করোনার সময় সম্ভবত কর্তৃপক্ষ এই নিয়ম চালু করেছে। তারা সেটাই এখন পর্যন্ত চালু রেখেছে। এখন এটা তারা কেন বদলাচ্ছে না সেটা বুঝা যাচ্ছে না।
এদিকে, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন গণপূর্ত অধিদপ্তর এই পার্কটির তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে আছে।
এ প্রসঙ্গে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন সাম্প্রতিক দেশকালকে মোবাইলে বলেন, পার্ক পরিষ্কার করার জন্য এক ঘণ্টা বন্ধ রাখা হয়। এটি এক ঘণ্টা পর খুলে দেওয়া হয়। তাছাড়া ভবঘুরেরা সকালে ঢুকে সারাদিন থেকে যায়। এটা যেন কেউ না করতে পারে।
তিনি বলেন, পার্ক তো আর সকাল থেকে রাত পর্যন্ত থেকে যাবার জন্য না। পার্কে মানুষ আসবে, কিছুক্ষণ থাকবে, আবার চলে যাবে। এটার জন্যই তো পার্ক।
তিনি বলেন, আমাদের কর্মীরা আছে। তাদের তো পার্কটা পরিষ্কার করতে দিতে হবে। পার্ক পরিষ্কার করার জন্যই এটা নির্দিষ্ট সময় বন্ধ রাখা হয়। আর এক ঘণ্টাতে মানুষের কোনো হয়রানি হয় না।
উইকিপিডিয়ার সূত্র মতে, রমনা পার্ক বা রমনা উদ্যানের আয়তন ৬৮ দশমিক ৫ একর (২৭.৭ হেক্টর)। এর ভেতরে একটি লেক আছে যার আয়তন ৮ দশমিক ৭৬ একর। এখানে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। এটি রাজধানীবাসীর প্রাতঃভ্রমণের মূল কেন্দ্র। এই উদ্যানটি ১৬১০ সালে মোঘল আমলে প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই সময়ে রমনার পরিসীমা ছিল বিশাল এলাকা জুড়ে। মোঘলরাই রমনার নামকরণ করেন। পুরানো হাইকোর্ট ভবন থেকে পূর্বের সড়ক ভবন পর্যন্ত মোঘলরা বাগান তৈরি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে কোম্পানি আমলে এ এলাকা জঙ্গলে পরিণত হয়। পরবর্তীতে ১৮২৫ সাল থেকে ব্রিটিশ কালেক্টর ডাউইজের সময় ঢাকা নগর উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় যার অন্যতম ছিল রমনা এলাকার উন্নয়ন। এসময় এলাকার একটি অংশ ঘেরাও করে ঘোড়দৌড় বা রেসকোর্সের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আর অন্য অংশটিকে রমনা গ্রিন নাম দিয়ে যাত্রা শুরু করে আজকের রমনা পার্ক। এসময় ঢাকার নবাব পরিবার এখানে একটি রাজকীয় বাগান তৈরি করেন যার নাম দেওয়া হয় শাহবাগ। তখন পার্কের আয়তন ছিল প্রায় ৮৯ একর। এসময় ঢাকার নবাবরা এখানে একটি চিড়িয়াখানাও গড়ে তোলেন। ১৯ শতকে ব্রিটিশ শাসক এবং ঢাকার নবাবদের সহায়তায় এটির উন্নয়ন সাধন করা হয়। ঢাকা শহরের নিসর্গ পরিকল্পনার কাজ শুরু হয়েছিল ১৯০৮ সালে লন্ডনের কিউই গার্ডেনের অন্যতম কর্মী আর. এল প্রাউডলকের তত্ত্বাবধানে। শহরের সেই নিসর্গ পরিকল্পনার ফল ছিল রমনা পার্কের উন্নয়ন। ২০ বছর লেগেছিল সে কাজ শেষ হতে। যা ১৯২৮ সালে শেষ হয়।
উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, রমনা পার্কে বর্তমানে উদ্ভিদ প্রজাতি ২১১টি। এর মধ্যে ফুল ও শোভাবর্ধক প্রজাতির সংখ্যা ৮৭টি, ফলজাতীয় উদ্ভিদ ৩৬টি, ঔষধি প্রজাতি ৩৩টি, কৃষি বনায়নের উদ্ভিদ প্রজাতি ৩টি, বনজ উদ্ভিদ প্রজাতি ২টি, জলজ উদ্ভিদ প্রজাতি ২টি ও মশলা উদ্ভিদ প্রজাতি ৩টি। রমনা পার্কে বেশ কিছু বিরল প্রজাতির গাছ আছে। এর কয়েকটি হলো পাদাউক, পলাশ, ধারমার, কাউয়াতুতি (বনপারুল), আগর, জ্যাকারান্ডা, তমাল, বাওবাব, গিন্ডরিসিডিয়া, কর্পূর, স্কারলেট কর্ডিয়া, জহুরিচাঁপা, ক্যাশিয়া জাভানিকা, মাধবী, মালতী, আফ্রিকান টিউলিপ, কেয়া, অশোক, ট্যাবেবুয়া, পাখি ফুল, কফি, উদয়পদ্ম, সহস্রবেলী, গোল্ডেন শাওয়ার, পালাম, কাউফল, ঝুমকো, লতা পারুল, স্থলপদ্ম, মহুয়া, কুর্চি, বন আসরা, চন্দন, মাকড়িশাল, দুলিচাঁপা, কনকচাঁপা, অঞ্জন ইত্যাদি। রমনা পার্কের ভিতর একটি শিশু প্রাঙ্গণ রয়েছে। শিশুদের বিনোদনের জন্য এখানে দোলনা, ঢেঁকিকল সহ বেশ কিছু খেলার উপকরণ আছে।