পুড়ছে রাজধানীর মার্কেট-শপিংমল
‘পরিকল্পিত’ আগুন, অভিযোগ ব্যবসায়ীদের

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৩:২৪

কৃষি মার্কেট। ফাইল ছবি
বঙ্গবাজার, নিউ সুপার মার্কেটের পর এবার ভোররাতে লাগা ভয়াবহ আগুনে পুড়ল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ঐতিহ্যবাহী কৃষি মার্কেট। এতে সব হারিয়ে নিঃস্ব প্রায় ৫ শতাধিক ব্যাবসায়ী। তবে ব্যবসায়ীরা এই আগুন লাগাকে স্বাভাবিকভাবে দেখছেন না।
তারা বলছেন, ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে মার্কেট ভাঙার সিদ্ধান্তের পর আগুন লাগা স্বাভাবিক নয়। ব্যবসায়ীদের অনড় অবস্থানের কারণে মার্কেট ভাঙতে না পেরে জায়গা খালি করতে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগানো হয়েছে বলে অভিযোগ করছেন তারা। তবে সিটি করপোরেশন বলছে, আগুনের সঙ্গে মার্কেট ভাঙার সিদ্ধান্তের কোনো সম্পর্ক নেই। অন্যদিকে ঘন ঘন এসব আগুনের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সঠিক চিত্র উঠে আসছে না বলে দাবি করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারাও আগুনের ঘটনাকে সন্দেহের চোখে দেখছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ও উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) নগরীতে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত কয়েকটি কাঁচাবাজার ভেঙে বহুতল মার্কেট করার সিদ্ধান্ত নেয়; কিন্তু এসব মার্কেটের ব্যবসায়ীদের একাধিকবার উচ্ছেদের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় কর্তৃপক্ষ। ব্যবসায়ীরা আদালতের দ্বারস্থ হওয়ায় দোকান ছাড়ার নির্দেশ আটকে গেছে। ফলে মার্কেট ভাঙা যাচ্ছে না। এমন একটি সময়ে মার্কেটে মধ্য কিংবা ভোররাতে আগুন লাগায় ব্যবসায়ীদের সন্দেহ জোরদার হয়েছে।
এদিকে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে ভোররাতে রহস্যময় আগুনের ঘটনায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ২৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. সলিমুল্লাহ সলু ও তার লোকজনকে সন্দেহ করছেন অনেক ব্যবসায়ী। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, কয়েক বছর ধরে মার্কেটটি ভেঙে ১২ তলাবিশিষ্ট বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন সলু; কিন্তু দোকানদারদের বাধার মুখে তা সম্ভব হচ্ছিল না। তাদের উচ্ছেদ করতেই পরিকল্পিতভাবে আগুন দেওয়া হয়েছে। তবে কাউন্সিলর সলু তা অস্বীকার করছেন।
ব্যবসায়ীরা বলেন, ডিএনসিসির সহযোগিতায় কৃষি মার্কেটের জমিতে ১২ তলা কমপ্লেক্স ভবন করার পরিকল্পনায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। তারা নিজ নিজ দোকানের পজিশন ছাড়তে রাজি হননি। এ ছাড়া কমপ্লেক্স করার সময় যতদিন মার্কেট বন্ধ থাকবে, ততদিন বিকল্প জায়গা চান ব্যবসায়ীরা। বিকল্প জায়গা না থাকায় মার্কেটের পজিশন ছাড়ার বিষয়টি সুরাহা হয়নি।
কৃষি মার্কেটের ব্যবসায়ীরা বলেন, বৃহস্পতিবার ভোরে পূর্ব-দক্ষিণ কর্নারে কাঁচাবাজারের প্রবেশমুখে হক বেকারিতে প্রথম আগুন দেখা যায়। একই সময় দক্ষিণ-পশ্চিম পাশের আরও দুটি দোকানে আগুন দেখা যায়। শর্টসার্কিট বা কয়েলের আগুন হলে প্রায় একই সময় তিন স্থানে আগুন লাগা সম্ভব নয়। ব্যবসায়ীরা মার্কেটে পেট্রল ছিটিয়ে দেওয়ারও অভিযোগ করেন।
কৃষি মার্কেটের ‘খ’ ব্লকের রেডিমেড কাপড় ব্যবসায়ী কামাল হোসেন বলেন, ‘মার্কেটের পাশেই আমার বাসা। প্রথমে যখন আগুন লাগে, তখন মানুষের চিৎকার শুনে আমি দ্রুত দৌড়ে দোকানে আসি। এসে দেখি মার্কেটের পূর্ব পাশে হক বেকারিতে আগুন লেগেছে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই পশ্চিম পাশের উত্তর কোনায় আরেকটি দোকানে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। একই সঙ্গে পশ্চিম-দক্ষিণ কোনার শেষপ্রান্তে আরেকটি দোকানে আগুন জ্বলে ওঠে। মার্কেট বন্ধ থাকায় কেউ মার্কেটে এসে পেট্রল জাতীয় কিছু একটা দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’
ব্যবসায়ীদের সন্দেহের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন কাউন্সিলর সলিমুল্লাহ সলু। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি কেন? অন্যরাই-বা কেন আগুন লাগাবে? মার্কেটে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা ছিল, যদিও সেটা পুড়ে গেছে, তবে দারোয়ান, নৈশপ্রহরী সবাই আছে। কেউ নাশকতা করলে সেটা অবশ্যই ধরা পড়ত।’
১২ তলা কমপ্লেক্স করার বিষয়ে সলু বলেন, ‘আপাতত আমরা সেটা চাই না। আমরা চাই এখানে আগের মতো টিনশেড দোকান করে যার যে ব্যবসা ছিল, সেভাবে পুনর্বাসন করা হোক। পোড়া-সামগ্রীগুলো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। সেখানে কাজ করাও ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা যত দ্রুত সম্ভব পুড়ে যাওয়া জিনিসপত্র সরিয়ে দিতে চাই, যাতে সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে সেখানে নতুন মার্কেট করা যায়। আমাদের মেয়র মহোদয় দেশের বাইরে আছেন। তিনি এলে ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনসহ পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এর আগে গত বছরের ৮ জানুয়ারি কাপ্তানবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটিও ঘটে ভোররাত সাড়ে ৪টার দিকে। ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট সোয়া ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও পুড়ে ছাই হয় অনেক দোকান। গত এপ্রিলে ঈদের আগে রাজধানীর দুটি বড় মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে প্রায় একই সময়ে, ভোররাতের দিকে। অনেক মার্কেটে রাতেও আগুন লেগেছে। গত ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজারে আগুন লাগে ভোর ৬টা ১০ মিনিটের দিকে। পুড়ে ছাই হয় ৪ হাজারের বেশি দোকান। ১৫ এপ্রিল রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার নিউ সুপার মার্কেটে আগুন লাগে ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে। পুড়ে যায় প্রায় আড়াইশ দোকান। এ ছাড়া ১৩ এপ্রিল পুরান ঢাকার নবাবপুরে একটি গুদামে আগুন লাগে রাত ১০টার দিকে। সেখানে মার্কেটের প্রায় অর্ধশত দোকানের মালামাল রাখা ছিল। এর মধ্যে শুধু ১৭ এপ্রিল উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরে বিজিবি মার্কেটে আগুন লাগে সকাল সোয়া ১০টার দিকে।
বঙ্গবাজারে আগুনের ঘটনায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) গঠিত আট সদস্যের তদন্ত কমিটি ১১ এপ্রিল সংস্থাটির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের কাছে প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। তাতে অগ্নিকাণ্ডের উৎসস্থল হিসেবে আদর্শ মার্কেটের তিনতলাকে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়। মশার কয়েল বা সিগারেট থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে মতপ্রকাশ করা হয়। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ধারণা করা হয় ৩০৩ কোটি টাকা। তবে সেই আগুন নাশকতা কিনা, তা নিশ্চিত করে তদন্ত কমিটি বলতে পারেনি।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, একটা আগুনে হাজার হাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর স্বপ্ন ছাই হয়ে যাচ্ছে। দুর্ঘটনা ঘটার পর তদন্ত কমিটি হচ্ছে। তবে তার প্রতিবেদন ঠিকমতো প্রকাশ হচ্ছে না। সঠিক কারণও মানুষ জানতে পারছে না। এসব ঘটনায় আগুনের উৎসটা কী, সেটা বের করা প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, আমাদের পরিষ্কার সন্দেহ হয়- এসব আগুন স্বাভাবিক নয়, রহস্যময়। সিটি করপোরেশন যে মার্কেটগুলো ভেঙে পাকা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেই মার্কেটগুলোতেই আগুন লেগেছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা পাকা মার্কেট চাই, তার অর্থ এই নয় আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে পাকা মার্কেট করতে হবে।’
ঢাকা মহানগর ব্যবসায়ী দোকান মালিক সমিতির সভাপতি আরিফুর রহমান টিপু বলেন, প্রত্যেকটি সিটি করপোরেশনের মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ভোরে, যখন বৈদ্যুতিক ইউনিট ব্যবহার জিরোতে থাকে। এমন সময় আগুন লাগার ঘটনা অবশ্যই তদন্ত হওয়া উচিত।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বলেন, আগুনের সঙ্গে মার্কেট ভাঙার কোনো সম্পর্ক নেই। আগুনে পুড়ে যাওয়া দোকানগুলো সিটি করপোরেশন থেকে বরাদ্দ দেওয়া।
কৃষি মার্কেটে আগুনের উৎসের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, কীভাবে আগুন লেগেছে, সেটা জানার জন্য তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, শর্টসার্কিট বা মশার কয়েল থেকে আগুন লেগেছে।