Logo
×

Follow Us

নগর

হরিজনদের কান্না কি এই সমাজ শুনতে পায়?

Icon

সুজিত সজীব

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৪, ১৭:১৬

হরিজনদের কান্না কি এই সমাজ শুনতে পায়?

আগা সাদেক রোডের মিরনজিল্লার সুইপার কলোনি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে হরিজনদের আন্দোলান। ছবি: সংগৃহীত

কেউ ডাকে সুইপার। কেউ মেথর, ক্লিনার, ঝাড়ুদার। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তারা সমাজের নিচু ও অচ্ছুত জনগোষ্ঠীর মানুষ। তাই তাদের সঙ্গে কেউ কোনো আত্মীয়তা করে না, এক সঙ্গে বসে খায় না। কেউ ঘর ভাড়া দেয় না, হোটেল রেস্তোরাঁয় প্রবেশ নিষেধ, তাদের সঙ্গে কেউ বন্ধুত্ব করে না। ঠিকমতো আচার-ব্যবহার করা হয় না। ধমক আর শাসানিতে তাদের দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। বলছিলাম, হরিজনদের কথা। তারা এই সমাজের অচ্ছুত বলে অলিখিতভাবে প্রতিষ্ঠিত। 

বাংলাদেশে হরিজনদের মূলত দুটি চিন্তার ভেতর আবদ্ধ রাখা হয়েছে। এক. তারা ভারত থেকে এখানে এসেছে। মানে বহিরাগত। দুই. তারা ময়লা আবর্জনা পরিষ্কারের কাজ করেন, তাই সমাজে অচ্ছুত। তাদের সঙ্গে সমাজের উঁচু শ্রেণির কারও আত্মীয়তা বা বন্ধন থাকতে পারে না। তবে এই সমাজ অচ্ছুতদের সেবা গ্রহণে কখনো পিছপা হয় না। যদিও তা প্রকাশ্যে কেউ মানতে চান না। ফলে হরিজনদের ওপর বহু বছর ধরে চলা সামাজিক অত্যাচার আর নির্যাতনের ইতিহাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এ যেন ঘোর অন্ধকার থেকে আরও গভীর অন্ধকারের ভেতর তলিয়ে যাওয়া।

এমন অন্ধকারের অমানিশা ঢাকার বংশালের আগা সাদেক রোডের মিরনজিল্লার সুইপার কলোনিতেও ভর করেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এখানকার হরিজন পল্লী উচ্ছেদ করে বহুতল মার্কেট তৈরি করতে চায়। তাই হরিজনদের শত শত বছরের বসতভিটা ছেড়ে দিতে হবে। 

মিরনজিল্লার কলোনিতে প্রায় চার হাজার মানুষের বাস। বেশিরভাগ বাসিন্দা সনাতন ধর্মাবলম্বী। সিটি করপোরেশনের অভিযানে উচ্ছেদ হওয়া মানুষগুলো সেখানকার মন্দির, বিদ্যালয় ও কমিউনিটি কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন।

বাসিন্দাদের প্রায় সবাই সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মী হলেও কর্তৃপক্ষ বলছে, স্থায়ী নিয়োগ পাওয়া বাসিন্দারাই শুধু ঘর পাবেন। অস্থায়ী কর্মীদের ঘর দেওয়া হবে না। অথচ সেখানে বসবাসরত প্রায় পাঁচশ পরিবারের মধ্যে স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা মাত্র ৪০ জন। যারা ঘর পেয়েছেন, তারা কেউ চাবি নেননি। তাদের দাবি, সবাইকে ঘর দিতে হবে। না হলে তারাও নতুন ঘরে উঠবে না। অভূতপূর্ব উদাহরণ সৃষ্টি করে হরিজনরা হরিজনের পাশে ঠিকই দাঁড়িয়েছে। 

হরিজনরা আন্দোলনে নেমেছেন, কোনোভাবে তারা তাদের বাসস্থান ছেড়ে যাবেন না। সমাজের কেউ তাদের বাসা ভাড়া দেবে না, কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তারা?

এই প্রশ্নের উত্তর নেই সিটি করপোরেশনের কাছে, তাই হরিজনরা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। আদালত তাদের পক্ষে এক মাস উচ্ছেদ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপিও দিয়েছেন। তবে এখনো অনিশ্চয়তা কাটেনি।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থী পূজা রানী দাস বলেন, আমরা কোথায় যাব? সমাজে আমাদের অবস্থান কী? কেউ আমাদের বাসা ভাড়া দেবে না, কাজ দেবে না। তাহলে আমাদের জীবনের কী হবে?

আন্দোলনরত আরেকজন মহেশ লাল জানান, সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গে মিটিং হয়েছে। প্রধান প্রকৌশলী জানিয়েছেন, সমস্যা সমাধানে মেয়রের সঙ্গে কথা বলবেন। কিন্তু আশ্বাস নয় ‘মাথার উপর ছাদ চাই’ বলে জানান মহেশ। 

তিনি বলেন, যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন, বাংলাদেশে কেউ ঘরহীন থাকবেন না, সেখানে ডিএসসিসি মিরনজিল্লার সুইপার কলোনির বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করছে, বিকল্প আবাসনের ব্যবস্থা না করেই। 

কলোনির হরিজনরা সিটি করপোরেশনে স্মারকলিপি দেওয়ার সময় স্থানীয় কাউন্সিলরকে অনুরোধ করেছিলেন উপস্থিত থাকতে। কিন্তু কাউন্সিলর সাফ মানা করে দিয়েছেন। কেননা তিনি চান এখানে মার্কেট হোক। 

বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলনের (বিডিইআরএম) সাধারণ সম্পাদক উত্তম কুমার ভক্ত বলেন, সারাদেশেই হরিজনরা নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার। আইনে আছে, সরকারি জমিতে বসবাসকারীদের নির্দিষ্ট সময় পরে ওই জমির ওপর তার মালিকানার অধিকার সৃষ্টি হয়। আর মিরনজিল্লায় আমরা প্রায় চারশ বছর ধরে বসবাস করছি। তাহলে আমাদের উচ্ছেদ করে কী করে?

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ব্রিটিশ আমলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা (১৮৩৮-১৮৫০), চা-বাগানের কাজ (১৮৫৩-৫৪), জঙ্গল কাটা, পয়োনিষ্কাশন প্রভৃতি কাজের জন্য ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দরিদ্র দলিত মানুষকে এদেশে আনা হয়। থাকতে দেওয়া হয় কর্মস্থলের পাশের খালি জায়গায়। এভাবেই গড়ে ওঠে হরিজন কলোনি। 

১৯৩২ সালে দলিত নেতা বি আর আম্বেদকারের প্রচেষ্টার ভিত্তিতে নতুন সংবিধানের আওতায় অস্পৃশ্যদের জন্য আলাদা ভোট ব্যবস্থা রাখা হয়। গান্ধী তা মানতে চাইলেন না। বি আর আম্বেদকার তাদের জন্য লড়াই জারি রাখলেন। কিছুটা হলে কাগজপত্রে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করলেন। কিন্তু সমাজে? তথাকথিত সভ্য-ভদ্র নাগরিকদের মানসিকতায়? সমাজের সকলের সঙ্গে সমভাবে ঠাঁই হলো কি হরিজনদের? 

মিরনজিল্লা আমাদের সেই প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে, তথাকথিত এই সমাজের সভ্য ভদ্র নাগরিকদের মানুষ হতে আরও অনেক অনেক পথ হাঁটতে হবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫