
ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় ফুট ওভারব্রিজ আছে। এর মধ্যে এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে ফুট ওভারব্রিজ খুব বেশি দরকার ছিল না।
অন্যদিকে অনেক অত্যাবশ্যক জায়গায় আবার ফুট ওভারব্রিজ নেই। যেমন- ঢাকার দয়াগঞ্জ, তাঁতীবাজার, ধানমন্ডির আবাহনী মাঠ, শংকর বাসস্ট্যান্ড, মিরপুর মাজার রোডসহ আরো বেশ কিছু এলাকায় পথচারীরা ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছে। তাদের দাবি, ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণের।
আবার দেখা গেছে অনেক জায়গায় ফুট ওভারব্রিজ আছে; কিন্তু পথচারীরা তা ব্যবহার না করে রাস্তা দিয়ে পার হচ্ছেন; কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে পথচারীরা বলছেন, তারা নিরাপত্তা আতঙ্কে ভোগেন। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে পথচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা ব্যবহারযোগ্য ফুট ওভারব্রিজ চান।
ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে দয়াগঞ্জের মোড়, একটি ব্যস্ততম সড়ক। প্রতিদিন শত শত যানবাহন চলাচল করে। এখানে একটি ফুট ওভারব্রিজের প্রয়োজনীয়তা মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম। দয়াগঞ্জের মোড়েই তার ব্যবসায়িক দোকান। তিনি জানান, করোনাভাইরাসের আগে গত বছরের শেষ দিকে রাস্তা পার হতে গিয়ে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের মা বাসচাপায় নিহত হন। এ রকম দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটে। এখানে একটি রাস্তা পারাপারের ব্রিজ খুবই প্রয়োজন।
ঠিক একই রকম অভিযোগ করেন তাঁতীবাজারের বাসিন্দা রাসু মন্ডল। তিনি জানান, দীর্ঘদিন ধরেই তারা এই জায়গাতে একটি ফুট ওভারব্রিজের দাবি জানিয়ে আসছেন; কিন্তু অদৃশ্য কারণে সেই দাবি পূরণ হয়নি।
মিরপুর মাজার রোডে এক বৃদ্ধকে রাস্তা পার করে দিচ্ছেলেন ট্রাফিক পুলিশ আসাদ। তিনি বলেন, ‘মিরপুরের এই সড়কটি রাস্তা পারাপারের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক বয়স্ক পথচারী একা রাস্তা পার হতে পারেন না, তখন তাদের আমরা সহযোগিতা করি।’ ওই এলাকায় ফুট ওভারব্রিজের প্রয়োজনীয়তা তিনিও অনুভব করেন বলে জানান।
ফুট ওভারব্রিজ বানানোই একমাত্র কাজ নয়, এর চেয়ে জরুরি এটিকে ব্যবহারযোগ্য রাখা। দেখা গেছে, বেশিরভাগ জায়গায় ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহারে পথচারীদের আগ্রহ তেমন নেই। লুনা শিকদার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। প্রতিদিনই তাকে বাংলামটর এলাকায় ফুট ওভারব্রিজ পার হতে হয়। তিনি বলেন, সন্ধ্যার পর লোকজন না থাকলে উঠতে ভয় লাগে। ওখানে হকাররা শুয়ে থাকে। মাদকসেবীরাও থাকে। অনেক সময় ছিনতাই হয়। লাইট থাকে না।
মণিপুরীপাড়ায় থাকেন নাসরীন আক্তার। তিনি একটি সংবাদমাধ্যমে কাজ করেন। তার দুই ছেলে পড়াশোনা করছে শংকর বাসস্ট্যান্ডের সামনে নালন্দায়। তিনি জানান, ‘এখানে একটি ফুট ওভারব্রিজ খুব প্রয়োজন। রাস্তার অপর পাশ থেকে প্রতিদিন কয়েকশ শিক্ষার্থী, অভিভাবক স্কুলে আসেন। প্রায়ই তারা দুর্ঘটনার শিকার হন। এ নিয়ে আন্দোলনও হয়েছে; কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, এখনো তা বাস্তবায়ন হয়নি।’
তিনি আরো অভিযোগ করেন সন্ধ্যার পর ইকবাল রোডের অফিস থেকে বাসায় যেতে আসাদ গেটের ফুট ওভারব্রিজটি ব্যবহার করতে তিনি নিরাপদবোধ করেন না। এজন্য রাস্তা দিয়েই পার হন।
ফার্মগেট, নিউমার্কেটসহ কয়েকটি জায়গার ফুট ওভারব্রিজে বখাটেদের হাতে নারীদের অপমানিত হওয়ার অভিযোগ শোনা যায় প্রায়ই। এছাড়াও বেশির ভাগ ফুট ওভারব্রিজ নোংরা, অপরিচ্ছন্ন এবং অনেকগুলোতে ফাটল ধরেছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল বলেন, ‘আমরাও অভিযোগ পেয়েছি, বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপ পর্যন্ত হয় এই ব্রিজগুলোতে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সচেষ্ট রয়েছে। অপরাধীরা তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এ ধরনের কাজ করছে বলে আমরা অভিযোগ পেয়েছি।’
ডিএমপি ট্রাফিক (দক্ষিণ) বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) রিফাত রহমান বলেন, ‘আমরা পথচারীদের ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহারে প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে উৎসাহিত করে থাকি। অনেক সময় ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার না করার কারণে পথচারীদের জরিমানাও করা হয়।’ পথচারীরা ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহারে নিরাপত্তা বোধ করেন না কেন- এমন প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের নিরাপত্তায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর আছেন।’
পথচারীদের যথেষ্ট পরিমাণে ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার না করার কারণ হিসেবে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘রাজধানীতে শতাধিক ফুট ওভারব্রিজ থাকলেও পথচারীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা দিয়ে পারাপার হচ্ছেন। এমনকি সামান্য ফাঁকা জায়গা দিয়েই রাস্তা পার হচ্ছেন। অনেক ফুট ওভারব্রিজে গিয়ে দেখবেন, সেখানে নানা রকম পসরার দোকান বসিয়ে রেখেছেন হকাররা। দিনের বেলায়ই স্বস্তিতে হাঁটা যায় না। পথচারীরা অস্বস্তিবোধ করেন। সন্ধ্যার পর থেকে ভবঘুরে, মাদকাসক্ত, ছিনতাইকারী ও ভ্রাম্যমাণ পতিতাদের দখলে থাকে ফুট ওভারব্রিজগুলো। তাহলে বলেন, পথচারীরা কীভাবে ফুট ওভারব্রিজ স্বস্তিতে ব্যবহার করবেন? সিটি করপোরেশন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই এসব দূর করতে। আর ঢাকার যেসব জনবহুল জায়গায় ফুট ওভারব্রিজ নেই, সেখানে তা নির্মাণের দাবি অনেক আগে থেকেই আমরা জানিয়ে আসছি। কর্তৃপক্ষের কোনো মাথাব্যথা নেই। আর যেগুলো আছে, সেগুলো নিরাপদ রাখতেও তাদের কোনো তৎপরতা নেই।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী খন্দকার মাহবুব আলম বলেন, ‘ঢাকা শহরের মানুষের সবচেয়ে বড় দাবির মধ্যে রয়েছে- ময়লা-আবর্জনা রাখার জন্য ডাস্টবিন ও নিরাপদে রাস্তা পারাপারের জন্য ফুট ওভারব্রিজের; কিন্তু এগুলো করতে গেলেই আমাদের পদেপদে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। জনসাধারণের সুবিধামতো স্থানে এসব ডাস্টবিন ও ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ না করা গেলে এগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘বিশেষ করে ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহারে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বাড়াতে হবে। উদ্বেগের বিষয় হলো- কোটি কোটি টাকা খরচ করে ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছে পথচারীদের সুবিধার জন্য, অথচ সেই ব্রিজ দিয়ে পথচারীরা পারাপার হন না- এটি সত্যিই দুঃখজনক।’
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবদুস সোবহান বলেন, ‘পথচারীদের ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহারে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা কর্তা ব্যক্তিদের জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করেই যেন সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব শেষ! ফুট ওভারব্রিজগুলো সারাক্ষণ তত্ত্বাবধায়ন করার জন্যও লোক রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।’
এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবীব বলেন, ‘বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই রাস্তা পারাপারের জন্য ফুট ওভারব্রিজ নেই। তারা জেব্রাক্রসিং ব্যবহার করেন। আমাদের এখানেও জেব্রাক্রসিং আছে। তবে অধিকাংশ পথচারী ও চালক জানেন না এর ব্যবহারের সঠিক নিয়ম। ফুট ওভারব্রিজগুলোর ব্যাপারেও এমনটাই ঘটেছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এটি নেই। আবার যেখানে দরকার নেই, সেখানে ফুট ওভারব্রিজ আছে। রাজধানীর পরিবাগের ফুট ওভারব্রিজটির কোনো দরকার ছিল না। সারাদিনে একশ’ মানুষ এটি দিয়ে পার হয় কি-না সন্দেহ আছে। নগরের অধিকাংশ ফুট ওভারব্রিজ সংস্কার করতে হবে। সিটি করপোরেশনকে এসব বিষয়ে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে হবে। ফুট ওভারব্রিজকে পথচারীদের জন্য নিরাপদ রাখতে হবে।’