
বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় রাজধানীর ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরে মিরপুর রোডে
বৃষ্টি হলেই রাজধানীর বড় অংশ জলাবদ্ধ হয়ে পড়ার ঘটনা নতুন নয়। গত ১০ বছরে এই সমস্যা আরো প্রকট হয়েছে। এই সময়ে ঢাকা ওয়াসা জলাবদ্ধতা মোকাবেলায় অন্তত ৫২৩ কোটি টাকা খরচ করেছে। ওয়াসার পাশাপাশি পানিনিষ্কাশনে (ড্রেনেজ ব্যবস্থা) টাকা খরচ করেছে দুই সিটি করপোরেশনও। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন পানিনিষ্কাশনের জন্য গত ১০ বছরে ব্যয় করেছে ১ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা। কিন্তু এরপরও সমস্যা কমেনি, বরং বেড়েছে। এবারো বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতায় বিপাকে পড়ছেন নগরবাসী।
ঢাকায় সাধারণত ২৪ ঘণ্টায় ৪০ মিলিমিটারের নিচে বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা হয় না৷ আর এবার জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই ঢাকায় ২৪ ঘণ্টায় ১৩৩ মিলি মিটার বৃষ্টির রেকর্ড আছে৷ এবার বর্ষার আগে থেকেই বৃষ্টির পরিমাণ বেশি৷ আর সামনে পড়ে আছে পুরো বর্ষা ঋতু ৷ তাই আগের হাঁটু পানির জলাবদ্ধতা এখন কোমড় পানির দিকে যাচ্ছে৷ বৃষ্টি একটু বেশি হলেই ঢাকার সড়কে নৌকা চলে৷ সড়ক পথের যানবাহন পানি ঢুকে বন্ধ হয়ে যায়৷ একমাত্র ভরসা রিকশা৷ তাও পানিতে তলিয়ে যাওয়া খানাখন্দে ভরা সড়কে চলতে গিয়ে যাত্রীসহ প্রায়ই উল্টে যায়৷ কাদাপানিতে একাকার হয়ে যান রিকশাযাত্রী৷
গত মঙ্গলবার (৮ জুন) কারওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতা আবুল হোসেন জানান, সকালে তাদের কাঁচাবাজার পুরোটাই বৃষ্টির পানিতে ডুবে যায়৷ তখনো দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা কাঁচামাল তারা ট্রাক থেকে নামাচ্ছিলেন৷
কয়েক বছর ধরেই ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে জলাবদ্ধতা হচ্ছে। গত বছর এই এলাকায় নালা সংস্কারের কাজও হয়েছে। তারপরও অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। জলাবদ্ধতার কারণে ব্যস্ত এই সড়ক একেবারে স্থবির হয়ে যায়, দীর্ঘ যানজট আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু ধানমণ্ডি কিংবা কারওয়ান বাজার নয়, এ অবস্থা রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকাতেই।
জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে নতুন অর্থবছরে ১০ লাখ করে টাকা পাচ্ছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রত্যেক কাউন্সিলর। বৃহস্পতিবার (১০ জুন) করপোরেশনের দ্বিতীয় পরিষদের ষষ্ঠ সভায় ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম ঘোষণা দেন, সাধারণ ও সংরক্ষিত মোট ৭২ জন কাউন্সিলরের সবাই পাবেন এ অর্থ। অর্থাৎ জলাবদ্ধতা নিরসনের নামে আবারও টাকা খরচের আয়োজন চলছে। তবে এরপরও সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে কীনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে বিশ্লেষকদের। তারা বলছেন, ঢাকার পানি সরে যাওয়ার কোনো পথই খোলা নেই৷ তাহলে জলাবদ্ধতা হবে না কেন?
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. মুজিবুর রহমান বলেন, টাকা খরচ হচ্ছে, কিন্তু সুষ্ঠু পরিকল্পনা অনুযায়ী তা হচ্ছে না। বাসাবাড়ি থেকে খাল ও নদী পর্যন্ত পানিনিষ্কাশনের বিষয়টি পরিপূর্ণভাবে না বুঝে শুধু রাস্তা কেটে পাইপ বসালে কিংবা কালভার্ট নির্মাণ করলে টাকাটা পানিতেই যাবে।
তিনি বলেন, সব সময় নালা পরিষ্কার রাখার পাশাপাশি খালগুলো দখলমুক্ত এবং খনন করে প্রবহমান রাখতে হবে। যাতে বৃষ্টির পানি খাল হয়ে নদী পর্যন্ত যেতে পারে। সে জন্য ঢাকা ও চারপাশের নদীরও খনন দরকার।
রাজধানীর ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান অনুযায়ী, রাজধানীর মোট আয়তনের ১২ শতাংশ জলাধার থাকার কথা। কিন্তু ওয়াসার কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, রাজধানীতে জলাধারের পরিমাণ ২ শতাংশের মতো। বৃষ্টির পানি দ্রুত না সরার এটিও অন্যতম কারণ।
এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যনার্সের সাধারণ সম্পাদক আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, আসল সমস্যা হলো আমাদের নগর পরিকল্পনায়৷ আমদের মত বৃষ্টিবহুল এলাকায় ঢাকা শহরের মত জায়গায় ২০-২৫ ভাগ সবুজ এলাকা এবং ১০-১২ ভাগ, সব মিলিয়ের কমপক্ষে ৩০-৩৫ ভাগ ওয়াটার বডি থাকতে হয়৷ এই সব ফাঁকা জায়গা থাকলে পানি সেখানে যেত৷ কিন্তু ঢাকায় কংক্রিটের স্থাপনা ৮৫ ভাগের মত৷ ফলে ৯০ ভাগ পানি ড্রেনে চাপ সৃষ্টি করে৷ যে চাপ নেয়ার মত ড্রেনের নাই৷ ফলে জলাবদ্ধতা অনিবার্য৷
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহরের সবচেয়ে সমন্বয়হীন অবহেলিত একটি খাত হচ্ছে জলাবদ্ধতা নিরসন। ছয়টি সংস্থা ও বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ হওয়ার কথা। কিন্তু সংস্থাগুলো ঠিকমতো কাজ করে না। এক প্রতিষ্ঠান আরেক প্রতিষ্ঠানের ওপর দায় চাপায়।
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, খালের মুখ বন্ধ আছে ফলে পানি সরতে পারে না৷ ড্রেন যতই পরিষ্কার করেন কাজ হবে না ৷ পশ্চিমের পানি নিষ্কাশনের জন্য পাম্পগুলোর অর্ধেকই অচল৷ দক্ষিণ আর উত্তরের পাম্পগুলোও শতভাগ কার্যকর নয়৷
তিনি বলেন, ঢাকার ড্রেনেজ সিস্টেমও অকার্যকর হয়ে পড়েছে ৷ হাতিরঝিলে বৃষ্টির পানি নেয়া যায়৷ কিন্তু হাতিরঝিলের সব গেট খুলে দিলে ড্রেনের পানিতে ভয়াবহ দুর্গন্ধ সৃষ্টি হবে ওই এলাকায় ৷ গত ১০ বছর ধরে পরিকল্পনা, মহা পরিকল্পনার কথা বলা হলেও বাস্তবে কোনো কাজই হয়নি৷
ঢাকা ওয়াসার গভীর নর্দমা রয়েছে ৩৮৫ কিলোমিটার, বক্স কালভার্ট ১০ কিলোমিটার এবং খাল রয়েছে ৮০ কিলোমিটার। ওয়াসার ড্রেনেজ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর রাজধানীর ২৬টি খালের মধ্যে ১৯টি খাল খনন ও পরিষ্কার করা হয়। এছাড়া ৮ দশমিক ৮০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট, ২৮০ কিলোমিটার গভীর নর্দমা পরিষ্কার করার কথা জানিয়েছে ওয়াসা। এর বাইরে গভীর নর্দমায় বৃষ্টির পানি যাওয়ার জন্য ১ হাজার ৩০০টি ক্যাচপিট (সড়কের পাশে বৃষ্টির পানি প্রবেশের পথ) বসানো হয়। যেসব খাল খনন ও পরিষ্কার করার কথা বলেছে ওয়াসা, সেগুলোর মধ্যে ধোলাইখাল, দেবধোলাইখাল, ডিএনডি খাল, সুতিখোলা খাল, কল্যাণপুর প্রধান ও ‘খ’ খাল, কল্যাণপুর পাম্পস্টেশনের পাশে বাঁধসংলগ্ন খাল, রূপনগর প্রধান খাল, মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর খাল, বেগুনবাড়ি খাল, উত্তরার কসাইবাড়ি খাল অন্যতম।
এ প্রসঙ্গে স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, নালা পরিষ্কারের কাজটি শুধু বর্ষার আগে করা হয়, কিন্তু এটি সারা বছরের কাজ। ওয়াসা ও সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য কী করছে, তা নিয়মিত তদারকি দরকার। ঢাকা ওয়াসা ও সিটি করপোরেশন একে অন্যকে দোষ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে। তাদের কাজে সমন্বয় না হলে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে রাজধানীর মানুষ মুক্তি পাবে না।