
সাত গম্বুজ মসজিদ। ছবি: বখতিয়ার আবিদ
বাংলার সুলতানি ও মুঘল আমল থেকে ঢাকা মসজিদের নগরী হতে শুরু করে, ঐতিহাসিক দলিলপত্রে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে বর্তমান কালের মতো নগরীর অলি-গলিতে সে সময় এত মসজিদ যে ছিল না, তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু সুলতানি কিংবা মুঘল আমলের মসজিদগুলো নির্মাণশৈলীতে ছিল অনন্য।
এদিকে খাল-বিল ও নদ-নদীবেষ্টিত ঢাকায় মসজিদ তৈরি করাও বেশ কষ্টসাধ্য কাজ ছিল সে কালে। ঢাকার তেমনই একটি মসজিদ হলো মোহাম্মদপুরের সাত গম্বুজ মসজিদ। এ মসজিদের পেছন দিকের গা ঘেঁষে অতীতে এক প্রকাণ্ড বিল ছিল। আশির দশক পর্যন্ত এই বিলের অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায়।
সাত গম্বুজ মসজিদের ভিত্তি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যে, শত শত বছর ধরে বয়ে চলা বিলের পানি মসজিদের কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। সাত গম্বুজ মসজিদ কত সালে নির্মাণ করা হয় এবং তা কার আমলে-এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। প্রাচীনকালের মসজিদগুলোর নির্মাণের সাল এবং নির্মাতার বিবরণের জন্য মসজিদের গায়ে খোদাই করা শিলালিপির ওপর নির্ভর করতে হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। কিন্তু সাত গম্বুজ মসজিদে এমন কোনো শিলালিপি পাওয়া যায়নি। তবে গবেষকরা অনুমান করেন সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খাঁ কিংবা তার পুত্র উমেদ খাঁ এ মসজিদ তৈরি করেন।
আবু জাফর অনূদিত ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এ এইচ দানীর লেখা ‘কালের সাক্ষী ঢাকা’ গ্রন্থ থেকে জানা যাচ্ছে, ‘আলাকুরীর মসজিদের প্রায় ৫০ গজ দূরে অবস্থিত ঐতিহাসিক সাত গম্বুজ মসজিদ। এটা অবস্থিত জলাভূমির উত্তর ধারে। এ স্থান দিয়েই আগে বুড়িগঙ্গা নদী প্রবাহিত হতো। বর্তমানে বুড়িগঙ্গা প্রবাহিত হয় আরও মাইলখানেক দূরে। বর্ষাকালে নৌকায় করে মসজিদের দিকে আসার সময় সবুজ ঝোপ-ঝাড় ও জঙ্গলের পেছন দিকে সাদা প্লাস্টার করা মসজিদকে খুবই সুন্দর দেখায়। স্থানীয়ভাবে প্রচলিত কাহিনি থেকে জানা যায়, এই মসজিদ নির্মাণ করেন নবাব শায়েস্তা খান। এই মসজিদ নির্মাণে যে অলঙ্কারপূর্ণ স্টাইল অনুসরণ করা হয়েছে তাতে মনে হয়, এটা ১৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের দিকেই নির্মাণ করা হয়েছে।’
এ গ্রন্থে মসজিদের নির্মাণশৈলীর বর্ণনায় বলা হয়েছে, ‘একটা আধুনিক ছোট প্রবেশপথ দিয়ে মসজিদে যাওয়া যায়। মসজিদটি প্রস্থের চেয়ে দৈর্ঘ্যে বড়-বাইরের দিক থেকে এটা ৫৮ ফুট লম্বা এবং প্রস্থ ২৭ ফুট। চারটি কোনায় প্রচলিত মিনারের পরিবর্তে আছে বারো ফুট চওড়া অষ্টকোণী ফাঁপা টাওয়ার। এই টাওয়ারগুলো দ্বিতলবিশিষ্ট; প্রতিটি তলায় আছে ধনুকাকৃতির খিলানযুক্ত প্যানেল ও জানালা। এর ওপর আছে পদ্মফুলের লতাপাতার কারুকাজ শোভিত গম্বুজ। সামনের দিকে মূল অংশে আছে তিনটি প্রবেশ পথ, এতে আছে চারকোনা বিশিষ্ট
ধনুকাকৃতির খিলান। মাঝখানের প্রবেশপথটি অন্য দুই প্রবেশপথের চেয়ে বড়-সব প্রবেশ পথের ওপরে আছে কৌণিক অর্ধ-গম্বুজসহ উঁচু ধনুকাকৃতির খিলান। মূল ধনুকাকৃতির খিলানটি একাধিক চূড়াবিশিষ্ট; পাশের ধনুকাকৃতির খিলানের বাইরের দিকে অলঙ্কারপূর্ণ চূড়া। মূল প্রবেশপথটি দেয়াল থেকে সামনের দিকে সামান্য প্রলম্বিত এবং তার চতুর্দিকে অলঙ্কারপূর্ণ মিনার দ্বারা বর্ডার করা। সামনের পুরো অংশটি কুলঙ্গিসহ প্যানেল করা এবং এর ওপরে আছে সচ্ছিদ্র প্রাচীরের মতো চূড়া; আধুনিক নীল রঙের বেড়ের ওপর। কোনার টাওয়ারেও দুই স্তরে একই ধরনের চূড়ার ঢাকনা আছে। পুরো ছাদটি ঢাকা আছে তিনটি গম্বুজ দ্বারা; এ ছাড়া টাওয়ারগুলোর ওপর আছে চারটি গম্বুজ। সব মিলিয়ে সাতটি গম্বুজের জন্য এই মসজিদকে বলা হয় সাত গম্বুজ মসজিদ।’
ইতিহাসবিদ হাসেম সূফী মসজিদের নির্মাতা হিসেবে উমেদ খাঁর কথা জানালেন। মুঠোফোনে তিনি সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, ‘বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণের পর আমি ধারণা করছি সাত গম্বুজ মসজিদটি শায়েস্তা খাঁর পুত্র উমেদ খাঁ তৈরি করেন। খুব সম্ভবত তিনি তার কোনো একজন বোনের স্মৃতিতে এ মসজিদ তৈরি করেন। কারণ মসজিদের কাছাকাছি এলাকায় একটি মাজার আছে, আর ধারণা করা হয় কবরটি শায়েস্তা খাঁর কোনো এক কন্যার।’