বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলির এই ঢাকা শহরের অলিগলিতে রয়েছে অসংখ্য মসজিদ। ১৬১০ সালে মুঘল সুবেদার ইসলাম খাঁ এই শহরকে রাজধানী ঘোষণা করেন। এর আগে এই অঞ্চলে কোনো মসজিদ ছিল কিনা তা ইতিহাসে নেই। সুলতানি আমল বা তার আগে সেন বা পাল আমলে ছিল কিনা, তা নিয়ে তেমন তথ্যও নেই। তবে জানা গেছে সুলতানি আমলে ঢাকায় প্রথম মসজিদ নির্মাণ হয়েছিল।
রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে পুরনো বিনত বিবির মসজিদ। ইতিহাসবিদরা একমত, এটিই রাজধানীর সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ এবং প্রাক-মুঘল যুগের অন্যতম প্রধান স্থাপত্য নিদর্শন। বাংলাপিডিয়ার তথ্যানুযায়ী, বিনত বিবির মসজিদই ঢাকার সবচেয়ে পুরনো মুসলিম স্থাপত্য এবং প্রথম মসজিদ। জানা যায়, এটি ১৪৫৬ সালে পাঠান রাজা নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহর আমলে নির্মিত। যার সাক্ষ্য বহন করছে মসজিদে খোদিত শিলালিপি। সে হিসেবে এর বয়স ৫৬৮ বছর চলছে।
স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, কে ছিলেন বিনত বিবি? আর কেনই বা তার নামে মসজিদ!
বিনত বিবির পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্ত হতে হয়।
কোনো কোনো ইতিহাসবিদ মনে করে বিনত বিবি হলো সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহর কন্যা। ড. মুনতাসীর মামুনের ‘ঢাকা : স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ গ্রন্থে লেখা বিনত বিবি ছিলেন মারহামাতের কন্যা। কিন্তু এই মারহামাত ভদ্রলোকটি কে ছিলেন তা জানা যায় না। ঢাকাকে নিয়ে অন্য একটি প্রবন্ধে মেলে, বিনত বিবি জনৈক হার্মাদের কন্যা।
এই তথ্য বিনিত বিবির পরিচয় সহজ করে তোলে। মারহামাত আর হার্মাদ শব্দযুগল যে একই ব্যক্তি সেটা বুঝতে পারি। সেই সঙ্গে বিনত বিবি যে নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহর কন্যা ছিলেন না সেটাও পরিষ্কার হয়ে যায়।
ঢাকার আদি বাসিন্দারা পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের বলত, হার্মাদ। ফলে বোঝা যায়, বিনত বিবির বাবা ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। কিন্তু পর্তুগিজরা কি মুসলমান ছিল? হিসাব মেলে না। মূল ইতিহাস আমরা জানতে পারি ‘বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন’-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে-মসজিদটি নির্মাণ করেন মূলত বিনত বিবির বাবা আরকান আলী।
সে সময় পারস্য উপসাগরের আশেপাশের লোকজন প্রায়ই জলপথে এ অঞ্চলে বাণিজ্যে আসতেন। পুরান ঢাকার এই এলাকায় অবস্থিত তৎকালীন নারিন্দা-ধোলাইখাল দিয়ে তখন বয়ে যেত বুড়িগঙ্গার একটি শাখা। যেটি বুড়িগঙ্গা হয়ে শীতলক্ষ্যায় গিয়ে মিশত।
আরাকান আলী নামক এক সওদাগর সে সময় এ এলাকায় বাণিজ্যের জন্য আসেন এবং বসবাস শুরু করেন। তিনিই নামাজ পড়ার সুবিধার্থে এখানে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। জানা যায়, এখানে বসবাসকালে আরাকান আলীর মেয়ে বিনত বিবির আকস্মিক মৃত্যু হয়। মসজিদের পাশেই তার সমাধি হয় এবং পরে আরাকান আলীর মৃত্যু ঘটলে তাকেও এখানেই কবর দেওয়া হয়। মসজিদের পাশে তাদের কবর এখনো রয়েছে। পরবর্তীকালে মসজিদটির নামকরণ হয় বিনত বিবির নামে।
মসজিদটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এর বিশেষ আকৃতির স্তম্ভ, বর্গাকার কক্ষের ওপর অর্ধবৃত্তাকার গম্বুজ, উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বদিকে খিলানের ব্যবহার, সাদামাটা অলঙ্করণ, প্লাস্টারে ঢাকা, বাঁকানো কার্নিশ। মূল মসজিদটি বর্গাকৃতির এবং এক গম্বুজবিশিষ্ট।
এর ভেতরের দিকের পরিমাপ প্রতিদিকে ৩.৬৬ মিটার। মসজিদটির ছাদ গোলাকার গম্বুজ দিয়ে ঢাকা এবং গম্বুজটি সরাসরি ছাদে স্থাপিত। মসজিদের দেয়ালগুলো ১.৮৩ মিটার পুরু। এর পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে মোট তিনটি প্রবেশপথ আছে। পশ্চিম দেয়ালের পেছনের দিকে একমাত্র মিহরাবটি প্রসারিত। আগে চার কোণে প্লাস্টারবিহীন বক্রাকৃতির ‘ব্যাটেলমেন্ট’যুক্ত (গুলি চালানোর ছিদ্রবিশিষ্ট প্রাচীর) চারটি অষ্টভুজাকৃতির বুরুজ ছিল।
বিনত বিবি মসজিদটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এর শিলালিপি। ধারণা করা হয়, ঢাকায় প্রাপ্ত শিলালিপিগুলোর মধ্যে এটিই প্রথম মুসলিম শিলালিপি। এটি মূল মসজিদের প্রধান প্রবেশ পথে লাগানো ছিল, কিন্তু বর্তমানে উত্তর দিক থেকে দ্বিতীয় প্রবেশ পথের মাথায় রয়েছে।
মসজিদ কমিটির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলা ১৩৩৭ সালে মসজিদটির দ্বিতীয় সংস্করণ হয় এবং দ্বিতীয় গম্বুজ স্থাপন করা হয়। ২০১৫ সালের দিকে সংস্কারের নামে মসজিদটির বেশিরভাগ অংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে। তবে নারিন্দা এলাকার ঐতিহ্য রক্ষার জন্য কিছু মানুষ এগিয়ে আসেন। তাদের প্রবল বাধার কারণে ঢাকার প্রথম মসজিদটির কিছু অংশ রক্ষা পায়। যদিও মসজিদটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যাদের দায় তারা এই বিষয়ে নীরব ভূমিকাই পালন করছেন সব সময়।
বর্তমানে পুরনো ভবনের সামনের অংশটুকু ঠিক রেখে নতুন করে তিনতলা মসজিদ ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। বারবার সংস্কার এবং পরবর্তী সময়ে সংযোজনের ফলে বর্তমানে মসজিদের বাইরের প্রকৃত অবয়ব একেবারেই পাল্টে গেছে। তবে মসজিদটির প্রাক-মুঘল সালতানাতের বৈশিষ্ট্যসমূহ এখনো বেশ প্রকট। আর বারবার সিমেন্টের পুরু আস্তরণ মসজিদের পোড়ামাটির অলঙ্করণকে সম্পূর্ণ রূপে মুছে ফেলেছে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh