আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা। খুন-খারাবি, চাঁদাবাজি,
ছিনতাই, মাদক বাণিজ্য, কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত কিছুতেই থামছে না। একের পর এক সহিংস ঘটনা
ঘটছে। মোহাম্মদপুরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এই অবনতি এ অঞ্চলের মানুষের শঙ্কার কারণ
হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে মোহাম্মদপুর
এলাকায় ডাকাতির আতঙ্ক শুরু হয়েছে। ‘ডাকাতি হচ্ছে’ বলে মসজিদে মসজিদে মাইকিং
করা হলে স্থানীয়রা লাঠিসোঁটা হাতে দল বেঁধে রাস্তায় নেমে যান ডাকাতি ঠেকাতে।
মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিং, মোহাম্মদিয়া হাউজিং সোসাইটি, মোহাম্মদীয় হাউজিং
লিমিটেড, চান মিয়া হাউজিং, চাঁদ উদ্যান, ঢাকা উদ্যান, চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকায় ডাকাতির
আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
আগস্ট অভ্যুত্থানের পরে থানাগুলো অকার্যকর থাকায় এ অবস্থা প্রকট আকার ধারণ করে।
এর মধ্যে নবোদয় হাউজিংয়ের একটি বাড়ি থেকে ২ লাখ টাকা ডাকাতি হয় বলে অভিযোগ করেছেন সেখানকার
একটি বাড়ির মালিক। পরে সেনাবাহিনীর একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছালে স্থানীয়রা ১১ জনকে আটক
করে তাদের হাতে তুলে দেয়।
মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ির একটি বাড়ির নিরাপত্তা কর্মী ইমরান হোসেন জানান, একটি
ট্রাক ও কয়েকটি মোটরসাইকেল নিয়ে কিছু তরুণ এলাকায় ঢুকে এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করছিল। এ
সময় ডাকাত নেমেছে বলে মসজিদে মাইকিং করা হয়। পরে লোকজন রাস্তায় নেমে তাদের প্রতিরোধ
করে। এ সময় ট্রাকসহ ১১ জনকে আটক করে স্থানীয় জনতা।
কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত: রাজধানীর মোহাম্মদপুরে রয়েছে বেশ কয়েকটি কিশোর গ্যাং গ্রুপ। জানা গেছে, রায়েরবাজার
এলাকায় ইমন ওরফে এলেক্স ইমনের নেতৃত্বে চলছে ভয়ংকর কিশোর গ্যাং ‘এলেক্স’ গ্রুপ। রানা ওরফে গালকাটা রানা, গালকাটা নাহিদ, জেক কাল্লুসহ আরও ১৫-২০ জনের
সক্রিয় সদস্য রয়েছে তাদের। সাতমসজিদ এলাকায় সোলাইমান সলে, শাহিও ও ফিরোজের নেতৃত্বে
‘ল ঠ্যালা’ ও ‘ডায়মন্ড’ গ্রুপ সক্রিয়। রায়ের
বাজারের পাবনা হাউজ গলি, নেকাব খান রোডসহ আশপাশের এলাকায় মানিক ওরফে চাঁন মানিকের
রয়েছে ২০-২৫ জন অনুসারী। এ ছাড়া ‘অজানা কিশোর গ্যাং’, ‘পাটালি গ্রুপ’ চাঁদ উদ্যান এলাকার ‘ভাইব্বা-ল কিং’ বেশি ভয়ংকর। মোহাম্মদিয়া
হাউজিং লিমিটেড এলাকার বেড়িবাঁধে ‘ডায়মন্ড’ গ্রুপে হাসান, আকাশ,
সোহাগ, জুয়েল ও মিলনসহ ১৫-২০ জনের সদস্য রয়েছে। বাঁশবাড়ী এলাকায় ‘লাড়া-দে’গ্রুপে মিম, নাহিদ, আশিক, ওসামা, নাঈম, আলি ও রাব্বিসহ ২০ জন সদস্য রয়েছে।
বসিলা ৪০ ফিট ও তার আশপাশ এলাকায় ফারুক খান অভির নেতৃত্বে ‘দে-ধাক্কা’ নামে রয়েছে আরেকটি সক্রিয় গ্রুপ। এই গ্রুপে কাজ করে জাকির, শরিফুল, ফয়সাল,
রুহুল আমিন, ভাইস্তা রনি, ভুট্টু, সুমন, সাইফুল, মোল্লা সফিকুর, আরিফ এবং নাইমসহ ১৫-২০
জন। লাউতলা এলাকায় ‘ঠোঁটে-ল’ গ্রুপের হোতা মহিদুল ইসলাম মাহি।
বসিলা মেট্রো হাউজিং এলাকায় লাল ওরফে রক্ত লাল, মেহেদী ও রাফির নেতৃত্বে ‘লাল গ্রুপ’ নামে একটি কিশোর গ্যাং রয়েছে। তিন রাস্তার মোড় ও সোনা মিয়ার টেক এলাকায়
বাত রাসেল, আন্ডা রাসেল, ব্যাঁকা রাসেল, রাহুল, চকলেট ইমন, আলামিন, রমজান, ইউসুফ, রাশেদ,
মানিক, মনির ও নোমানের নেতৃত্বে টক্কর-লসহ বেশ কয়েকটি কিশোর গ্যাং সক্রিয় হয়ে কাজ
করছে। এসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা ঢাকা উদ্যান, চাঁদ উদ্যান ও বেড়িবাঁধসহ আশপাশের
এলাকায় চাঁদাবাজি ও অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রমের আধিপত্য ধরে রাখতে দেশীয় অস্ত্র
দিয়ে মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে। দিনের বেলায় তারা আত্মগোপনে থাকে। রাতের বেলায় খোলস
পাল্টে ছিনতাই ও চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়ে।
তাদের অনেকেই দৃশ্যমান পেশার আড়ালে কিশোর গ্যাংকালচারে সক্রিয়। গ্যাংয়ের সদস্যরা
দিনে কেউ রাজমিস্ত্রি, কেউ চা বিক্রেতা কিংবা
প্রাইভেটকার চালক। তবে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই ওরা ধারণ করে ভয়ঙ্কর রূপ। আগ্নেয়াস্ত্র
ও ধারালো দেশীয় অস্ত্রসহ কিশোর গ্যাং সদস্যরা
ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে আসছে।
মাদক ব্যবসা ও ডাকাতি: গত দুই মাসে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প এলাকায় মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংঘর্ষে
অন্তত পাঁচজন নিহত হয়েছেন। এরপরে ২০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টার দিকে রায়েরবাজার এলাকার
‘সাদেক খান কাঁচাবাজারের’ স্থানীয় দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে নিহতরা
হলেন নাসির (৩০) ও মুন্না (২২)। এদের মধ্যে নাসির ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এবং
মুন্না সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। রাজধানীর
মোহাম্মদপুরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে
দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় দুজনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
পুলিশ বলছে, নিহতের স্বজন ও পুলিশ সদস্যরা হত্যার সঙ্গে জড়িতে সদস্যদের নাম-ঠিকানা
সংগ্রহ করছে। তাদের বিরুদ্ধে দ্রুতই মামলা দায়ের করা হবে। এরপরে ঘটে আরেক ডাকাতি। গত
১২ অক্টোবর রাজধানীর মোহাম্মদপুরে
সেনাবাহিনী ও র্যাবের পোশাক পরে যৌথ বাহিনীর পরিচয়ে রাত সাড়ে ৩টার দিকে মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড়ের কাছে ব্যবসায়ী আবু বকরের বাড়িতে ঢুকে সংঘবদ্ধ
ডাকাত দল ৭৫ লাখ টাকা ও ৭০ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করে। পরে ব্যবসায়ী আবু বকর এ ঘটনায়
মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা করেন। এরপরই শুরু হয় অভিযান। বাসায় ঢুকে ডাকাতির ঘটনায়
এখন পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুনীম ফেরদৌস বলেন, ‘গ্রেফতারদের মধ্যে পাঁচজন বিভিন্ন বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত
ও তিনজন বেসরকারি ব্যক্তি। আটকদের থেকে প্রায়
৭ লাখ টাকা ও কিছু স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়েছে। আমাদের অভিযান চলছে। ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট
সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।’
মাদক ব্যবসা নিয়ে খুন: রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে মাদক কারবারিদের গুলিতে সর্বশেষ শানেমাজ
(৩৮) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। বুধবার (১৬ অক্টোবর) রাতে এ ঘটনা ঘটে।
নিহতদের স্বজনরা জানান, রাজধানীর শনির আখরায় একটি ফাস্টফুডের দোকানে কাজ করতেন
শাহনেওয়াজ। বুধবার রাতে মোহাম্মদপুরে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে দেখা করতে এলে গুলিবিদ্ধ
হন তিনি। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে
মৃত ঘোষণা করেন।
মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী ইফতেখার হাসান জানান, বুধবার
রাতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মাদক কারবারিদের দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা
ঘটে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে শানেমাজ নিহত হন। ময়নাতদন্তের পর এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেয়া
হবে।
স্থানীয়রা জানান, গত দুই মাসে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প এলাকায় মাদক ব্যবসায়ীদের
মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত পাঁচজন নিহত হয়েছেন।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh