Logo
×

Follow Us

ক্রিকেট

অস্তিত্ব সংকটে ক্রীড়া ক্লাব

Icon

সোহাগ আহমেদ

প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০১৯, ০৯:৩০

অস্তিত্ব সংকটে ক্রীড়া ক্লাব

টাঙ্গাইল দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট লীগে চ্যাম্পিয়ন উদয়ন ক্রীড়া চক্রের ফটোসেশন ।

মাঠে খেলা অনিয়মিত। সাফল্য আরও অনিয়মিত। ক্রিকেটের জাতীয় দল বাদে অন্য খেলাগুলোর দর্শক নেই। যে ক্লাব সংস্কৃতির ওপর বেঁচে থাকে দেশের ক্রীড়াঙ্গন কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে একটা স্থবিরতার মধ্যে যাচ্ছিল বাংলাদেশের ক্রীড়া-ক্লাবগুলো। ক্যাসিনো ক্যালেঙ্কারিতে জড়িয়ে ক্লাবগুলোর অস্তিত্ব এখন সংকটের মুখে। ক্রীড়া সংগঠক এবং ক্রীড়াবিদরা মনে করেন, আগামী মৌসুমে খেলা মাঠে গড়াবে কিনা, তা নিয়ে এখন ঘোর সংশয়।

ঢাকার ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাব, ওয়ান্ডারার্স, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র এবং কলাবাগান ক্রীড়া চক্র খেলাধুলার কারণে সংবাদ শিরোনামে আসে না বহুকাল। এবার পুরো দেশ কাঁপিয়ে গণমাধ্যমে ক্লাবগুলোর সরব উপস্থিতি। আর সেটি কী ন্যক্কারজনক কারণে! আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেখানে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করেছে ক্যাসিনোর বিপুল সরঞ্জাম। এরপর অভিযান ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, দিলকুশা স্পোটিং ক্লাব এমনকি মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে পর্যস্ত। এখানেই শেষ নয়। চট্টগ্রামের আবাহনী লিমিটেড, মোহামেডান ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাবেও চলে একই রকম অভিযান। ক্লাবগুলো মাঠের খেলা ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছিল জুয়ার আখড়া। আরও ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, ক্রীড়া ক্লাবগুলোর এই ক্যাসিনো ক্লাবে রূপান্তর সংগঠকদের প্রশ্রয়ে; তাদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে। আয়ের উৎস হিসেবে বাংলাদেশের অনেক ফুটবল ক্লাবে ‘হাউজি’ খেলা শুরু হয় আশির দশকের দিকে। তবে নব্বইয়ের দশকে জুয়ার আসরও জমে ওঠে। গত কয়েক বছরে তা আরও ভয়াবহ মাত্রা পায়। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের অনেক ক্লাবেই গড়ে ওঠে ক্যাসিনো।

খেলোয়াড়- কোচ-সংগঠক হিসেবে ক্লাবের সঙ্গে নিজের জীবনের প্রায় পুরোটাই কাটিয়েছেন ফুটবলের গোলাম সারোয়ার টিপু। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি ভীষণ উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, আমার বয়স এখন ৭৫ বছর। এর মধ্যে ৫০-৬০ বছর তো খেলার সঙ্গে, ক্লাবের সঙ্গেই কাটিয়ে দিলাম। এই দীর্ঘ সময়ে সামগ্রিক অর্থে বাংলাদেশের ক্লাবগুলো এমন সংকটে কখনো পড়েছে বলে আমার মনে পড়ে না। 

তার পরিচয়ের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা মোহামেডন স্পোর্টিং ক্লাবের নামও এ কেলেঙ্কারিতে যোগ হওয়ায় ক্ষুব্ধ টিপু, ‘আমি আবাহনীতে খেলেছি। ওদের প্রথম লিগ চ্যাম্পিয়ন দলের অধিনায়ক ছিলাম; কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবার কাছে আমি ‘মোহামেডানের টিপু’। এখন তো সেই পরিচয় সংকটেই পড়ে গেছি। মোহামেডানের টিপু পরিচয়টা দিতে এখন আমি লজ্জিত বোধ করছি; অপমানিত বোধ করছি।’

ক্লাবগুলোর নিজস্ব আয় নেই; সত্যি। অনুদানের ভিত্তিতে ক্লাবগুলো চলে; সত্যি কিন্তু বাংলাদেশে এ বাস্তবতা তো চিরকালই। তবু কি অতীতে নিবেদিতপ্রাণ সংগঠকরা নিজেদের মতো অর্থ সংস্থান করে ভালোবাসার ক্লাব চালাননি? তেমনই এক উদাহরণ দেন গোলাম সারোয়ার টিপু, ‘আমাদের সময়ের সংগঠকরা বউয়ের গয়না বিক্রি করে ক্লাব চালাতেন। আমার মনে আছে, মোহামেডান ক্লাব একবার অর্থ সংকটে পড়ল। আমান ভাই নামের এক সংগঠক ফুটবলের দলবদলের সময় নিজের গাড়ি বিক্রি করে দিলেন খেলোয়াড় কেনার জন্য। এখন তো এটি গাঁজাখুরি গল্পের মতো শোনাবে। কারণ, এখনকার সংগঠকরা ক্লাবকে ব্যবহার করে বিপুল বিত্তশালী হয়ে উঠছেন। নিজেদের আর্থিক লাভের জন্য, লোভের জন্য এখানে ক্যাসিনো পর্যন্ত চালাতেন, ভাবা যায়!’

৪০ বছরের বেশি সময় ধরে ক্লাব সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি। ক্যাসিনো-কান্ডে তিনিও ভীষণ বিব্রত। অবৈধ অর্থের মালিকদের ক্লাবে প্রবেশকে এর কারণ হিসেবে দেখেন তিনি। সাজ্জাদুল আলম ববি বলেন, আগে ক্লাবের কার্ডরুমে কার্ড খেলা হতো। সেটি নির্দোষ বিনোদন। ক্লাব সদস্যরাই অংশ নিতেন কেবল। সেখান থেকে অল্প যে কিছু টাকা উঠত, তা দিয়ে ক্লাবের বল কেনা কিংবা চা-নাস্তা কেনার মতো টুকটাক কাজে ব্যয় হতো। পরবর্তীতে ক্লাবের খরচ অনেক বেড়ে যাওয়ায় এখানে প্রবেশ করেন কালো টাকার মালিকরা। ক্লাবের সুনাম ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করেন তারা। সেটি করতে করতে এভাবে যে ক্যাসিনোর সংস্কৃতিতে ঢুকে যাবে ক্লাবগুলো, তা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না।’

বাংলাদেশ, ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার মনে করেন সাম্প্রতিক এ কেলেঙ্কারিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের। কীভাবে? তিনি বলেন, ‘দেখুন, বাংলাদেশে ক্রিকেট বাদে অন্য সব খেলার খেলোয়াড় এখন কমে গেছে তবু তো কিছু ছেলে দেশের   বিভিন্ন জায়গা থেকে ঢাকায় ফুটবল খেলতে আসে, ক্রিকেট খেলতে আসে, হকি খেলতে আসে। খুলনা থেকে, কুমিল্লা থেকে, নীলফামারি থেকে যে ছেলেটি খেলার স্বপ্ন নিয়ে ক্লাব তাঁবুতে এসে ওঠে, সে কী পরিবেশ পাচ্ছে? পাচ্ছে জুয়ার পরিবেশ; ক্যাসিনোর পরিবেশ। ওখানেই তো সব শেষ। মা-বাবারা কেন তাঁদের সন্তানকে এমন পরিবেশে পাঠাবেন?’

জাতীয় দলের ফুটবলার মিশু বলেন, এতদিন আমাদের ক্লাবগুলোর ক্রীড়ায় সাফল্য ছিল না। এবার যোগ হলো বদনাম। এখনো যে অল্পসংখ্যক নিবেদিত প্রাণ সংগঠক রয়েছেন, তারা কি ক্লাবের সঙ্গে জড়িয়ে এ বদনামের ভাগিদার হতে চাইবেন? চাইবেন না। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান নতুন করে ক্লাবের সঙ্গে জড়িয়ে এই ক্যাসিনো-লজ্জার ভাগ হতে চাইবে? চাইবে না। আগামী মৌসুমে ক্লাবগুলো তাই কিভাবে ফুটবল-হকি-ক্রিকেটসহ সব খেলার দল গঠন করবে, সেটি ভেবে পাচ্ছি না। খেলা মাঠে গড়ায় কিনা, তা নিয়েও আমার সন্দেহ রয়েছে।’

ঘোর অন্ধকারেও সম্ভাবনার সূর্যরশ্মি দেখছেন জাতীয় সংসদ সংদস্য, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। তিনি জানান, ‘‘সময়টা অবশ্যই খারাপ। তবে এই খারাপ থেকে ভালো কিছুও হতে পারে। ক্লাবগুলোর আয়ের নির্দিষ্ট জায়গা তৈরি করতে হবে। সরকার, ক্রীড়া মন্ত্রণালয় মিলে সেটি করা সম্ভব। তাহলে কালো টাকার মালিকরা এখানে আসতে পারবেন না। ক্লাবগুলো যদি বিত্তশালী কালো টাকার মালিকদের হাতে জিম্মি না হয়ে সত্যিকার সংগঠকদের দ্বারা পরিচালিত হয়, তাহলে এ দুঃসময় কেটে যাবে?’’

অভিযানের বিষয়ে মো. ইয়াকুব বলেন, ‘ক্লাব চালাতে হলে টাকা দরকার। ফাস্ট ডিভিশন এবং সেকেন্ড ডিভিশনে দল গঠনে অনেক টাকা দরকার। আমরা এসময় অনেকের সহযোগিতা নেই। ক্লাব ভাড়া দেই। ভাড়া নিয়ে তারা এসব করেছে। অনেক ক্লাব পদ দেয়। পদের বদলে তারা টাকা দেয়। কিন্তু সব ক্লাবেতো ডোনার আসতে চায় না। যেগুলোতে ডোনার পাওয়া যায় না, সেখানেই এই জুয়া হয়। এটা বাস্তবতা। তবে ক্লাবের অতীত এরকম ছিল না।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫