
মারাত্মক ‘ছোঁয়াচে’ করোনাভাইরাসের কবল থেকে বাদ যায়নি কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ। ধনী, গরিব ভেদাভেদ ভুলে আক্রান্ত হয়েছেন সারা দুনিয়ার কোটিরও বেশি মানুষ। তবে খেলার দুনিয়ায় বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন- মাশরাফি বিন মুর্তজা। সারাজীবন লড়াই করে বেঁচে থাকা এই ক্রিকেটারের পাশাপাশি নাফিস ইকবাল, নাজমুল ইসলাম অপুও আক্রান্ত হয়েছিলেন। শেষের দু’জন নেগেটিভ এলেও দ্বিতীয় দফায় পজিটিভ হয়েছেন নড়াইল এক্সপ্রেস। করোনা নামক ভাইরাসটি কবে নির্মূল হবে সেই আতঙ্ক যেমন সাধারণের রয়েছে, ঠিক তেমনি শঙ্কিত ক্রীড়াজগতও।
আক্রান্ত মাশরাফি বিন মুর্তজা
লড়াকু মাশরাফিকে বাংলাদেশের মতো সারাদুনিয়ার মানুষই চেনে। বিশেষ করে ক্রিকেট বিশ্বে তার বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। কীভাবে একটার পর একটা অপারেশন করার পরও মাঠের ক্রিকেটে ফেরা যায় সেটাই প্রমাণ করেছেন জাতীয় দলের সাবেক এই অধিনায়ক। মাঠের মানুষটিকে মাঠের বাইরে নিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নড়াইল-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য বানিয়েছেন তিনি। তাতেই নতুন এক জনসেবকের দেখা মিলেছে। মাঠের ক্রিকেট না ছাড়লেও সংসদ সদস্য হিসেবে দারুণ সুনাম কুড়িয়ে চলেছেন ‘ম্যাশ’।
করোনাকালে প্রথমবারের মতো নিজ জেলা হাসপাতালে বসিয়েছেন জীবাণুনাশক কক্ষ। সহায়তার হাত বাড়িয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায়। সবাইকে যিনি নিরাপদে থাকার আহ্বান করেন; কিন্তু তিনি নিজেই আর নিরাপদ থাকতে পারলেন না। তাকেও গ্রাস করেছে করোনা নামক ভয়াল ভাইরাস। জুন মাসের ১৯ তারিখ পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় তার শরীরে করোনার অস্তিত্ব রয়েছে।
৩ জুলাই দ্বিতীয় পরীক্ষায়ও পজিটিভ আসায় বেড়ে যায় দুশ্চিন্তা। তবে যারা মাশরাফিকে চেনে তাদের ভালোই জানা আছে, এই লড়াইয়েও জিতবেন দেশের সবচেয়ে সফল এই অধিনায়ক। তবে শুরুর দিকের মতো অতটা খারাপ নয় তার শরীরের অবস্থা। ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। তার ভাই মোরসালিন মুর্তজা জানিয়েছেন, ‘মাশরাফি ভাই এখন আগের থেকে অনেক ভালো আছেন। শরীরে আজ জ্বর নেই। তবে শরীর ব্যথা আছে এখনো। অ্যাজমার সমস্যাটা নিয়েই চিন্তিত আমরা।’
এর আগে পারিবারিক এবং নিজের সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে ঢাকার মিরপুরে নিজের বাসায় আসার আগে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনও মেনে চলেন মাশরাফি।
মা-বাবাকে নিয়ে সুস্থ নাজমুল ইসলাম অপু
অনেকটাই ব্যতিক্রম বলা যেতে পারে নাজমুল ইসলাম অপুকে। করোনার শুরু থেকেই নিজের আয়ের অর্থে মানুষকে সহায়তা করে এসেছেন। আক্রান্ত হিসেবে নারায়ণগঞ্জ রাজধানী ঢাকার পরে থাকলেও সেটিকে পাত্তা দেননি অপু। বন্ধুবর ক্রিকেটার রনি তালুকদারকে সঙ্গে নিয়ে মানুষকে সহায়তা করে গেছেন। একটা সময় নিজেই আক্রান্ত হয়ে যান। আবার যুদ্ধ করে ফিরেও আসেন। অপু তার মা-বাবাসহ আক্রান্ত হয়েছিলেন। পরে এই তিনজনই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছেন স্বাভাবিক জীবনে।
সংবাদ মাধ্যমকে তিনি জানিয়েছেন, ‘মহান আল্লাহর রহমতে আব্বা-আম্মাসহ আমি সুস্থ হয়েছি। আমাদের তিনজনের রিপোর্টই নেগেটিভ এসেছে। সৃষ্টিকর্তার দয়ায় এখন আর কোনো সমস্যা নেই। সব জটিলতা ও উপসর্গ কেটে গেছে’।
শুরুতে নিজের অর্থায়নে নারায়ণগঞ্জের ফরাজিকান্দায় কয়েক দফায় ত্রাণ কার্যক্রম চালান। এরপর রোজায় প্রায় প্রতিদিন হাজার খানেক মানুষকে ইফতার দিয়েছেন। শুরুতে অপু একাই লড়াইয়ে নামলেও পরে জাতীয় দলের ওয়ানডে অধিনায়ক তামিমের সাহায্য নেন। এভাবেই মানুষকে সহায়তা করে যাচ্ছেন তিনি।
বিওএ-এর কয়েকজন আক্রান্ত
কর্মকর্তা হিসেবে বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের (বিওএ) সাবেক মহাসচিব কুতুবউদ্দিন আহমেদ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। হাসপাতালে কয়েক সপ্তাহ কাটিয়ে এখন তিনি সুস্থ। মানসিক জোরের বলেই সুস্থ হওয়া সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। এরপর আরেক সংগঠক আহমেদুর রহমান বাবলু আক্রান্ত হলেও দ্রুতই সুস্থ হয়ে ওঠেন।
তবে সুস্থ হতে সময় লাগছে বিওএ উপ মহাসচিব, বাংলাদেশ ভলিবল ফেডারেশন ও নড়াইল জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান মিকুর। নড়াইল জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক হলেও বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন এবং ভলিবল ফেডারেশনই তার প্রধান ঠিকানা। বছরজুড়ে বিওএ এবং ভলিবলের কর্মপরিকল্পনা এখানে বসেই করেন মিকু।
মা’সহ সুস্থ হলেন নাফিস ইকবাল
মাশরাফির ঠিক পাশাপাশি সময়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন সাবেক ক্রিকেটার নাফিস ইকবাল। জাতীয় দলের ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবালের বড় ভাই তার মাসহ আক্রান্ত হন। তবে নিয়ম মেনে সুস্থতার সার্টিফিকেট ‘নেগেটিভ’ অর্জন করেছে তার পরিবার। নাফিসের মা, দুই শিশুসন্তান ও গৃহকর্মীর পরীক্ষার ফল নেগেটিভ এসেছে। নাফিসরা সবাই পজিটিভ হওয়ার খবর পেয়েছিলেন গত ১৩ জুন। এরপর বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিয়েছেন সবাই।
যুদ্ধে জয়ী হলেন কোচ আশিকুর রহমান
করোনাযুদ্ধে জয়ী হওয়াটাকে এখন অনেক বড় অর্জন হিসেবে দেখা হয়। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে প্রথম আক্রান্ত হয়েছিলেন ক্রিকেট কোচ আশিকুর রহমান। গত ১২ মে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে তাকে ভর্তি করানো হয়। প্রায় ১৭ দিন করোনার সঙ্গে যুদ্ধের পর আশিক স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছেন। করোনা জয় করে, সুস্থ হয়ে আশিক বাসায় ফিরে আসেন। দু’বার তার করোনা পরীক্ষা করানো হয়েছিল।
দু’বারই টেস্টের ফল নেগেটিভ আসে। তবে আশিক জানালেন, বুকে ব্যথাটা এখনো রয়েছে। এ জন্য বুকের সিটি স্ক্যান করানোর পরামর্শ দিয়েছেন ডাক্তার। পাশাপাশি বাসায় ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন বাধ্যতামূলক। তবে পরিবারের কেউ করোনা আক্রান্ত হননি। লকডাউনের শুরু থেকেই সবুজবাগ বাসাবোর নিজের বাসায় অবস্থান করছিলেন আশিক; কিন্তু একটা সময়ের পর দরিদ্রদের সাহায্যে এগিয়ে যান। নিজের বাসার আশ-পাশের দরিদ্রদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছেন। এ জন্য বাসা থেকে বের হতে হয়েছে একাধিকবার। ঘর থেকে বের হওয়ার কারণেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে ধারণা তার।
অসময়ে চলে গেলেন এসএম সালাউদ্দিন ও কারাতে কোচ জুয়েল
করোনাকালে অনেক নিবেদিতপ্রাণ ক্রীড়া সংগঠকের পাশাপাশি খেলোয়াড়রা আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন মারা গেছেন। সাবেক ফুটবলার ও বর্তমান কোচ নুরুল হক মানিক তাদের মধ্যে অন্যতম। এ ছাড়া সাবেক ফুটবলার এসএম সালাউদ্দিন ও কারাতে কোচ জুয়েল অন্যতম। ফুটবলের ‘উর্বর ভূমি’ নারায়ণগঞ্জ থেকে উঠে এসে সালাউদ্দিন ঢাকায় ফুটবলে নজর কাড়েন।
১৯৮২ সালে বিজেএমসি দিয়ে শুরু করার পর ৩ বছর ফরাশগঞ্জে খেলেছেন। এরপর জাতীয় দলেও খেলেছেন। তবে কারাতে কোচ জুয়েলের চলে যাওয়া যেন বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। জাতীয় কারাতে চ্যাম্পিয়ন ও বাংলাদেশ কারাতে দলের সাবেক কোচ হুমায়ুন কবির জুয়েল ঢাকার সিটি হাসপাতালে মারা গেছেন। তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে শ্বাসকষ্টের কথা বলা হয়েছে। তবে তার শরীরে করোনার উপসর্গ ছিল বলে জানা গেছে। তিনি বাংলাদেশ কারাতে ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটির সদস্যও ছিলেন। এ ছাড়াও আনসার কারাতে দলের কোচিংয়ের দায়িত্ব পালন করছিলেন।