ভারতের মাটিতে বসেছে ওয়ানডে বিশ্বকাপের ১৩তম আসর। ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত চলবে এই মেগা টুর্নামেন্ট। স্বাগতিক দেশ হিসেবে ভারতের সরাসরি বিশ্বকাপে খেলা নিশ্চিতই ছিল। ভারতের সঙ্গে নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, আফগানিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা ও নেদারল্যান্ডসকে নিয়ে শুরু হচ্ছে ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় মহাযজ্ঞ।
টুর্নামেন্টে দশ দলের ক্রিকেটারদের মধ্যে বাজির ঘোড়া হবেন কারা? কারা ব্যাটে-বলে জ্বলে ওঠে বিশেষভাবে নজর কেড়ে নিজ নিজ দলকে পৌঁছে দেবেন কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়? ১০ দল থেকে কোন ১০ জন ক্রিকেটার ভারতের মাটির বিশ্বকাপে বিশেষ আলো ছড়াতে পারেন, এই প্রতিবেদনে আমরা সে রকমই সম্ভাব্য ১০ জনকে নিয়ে আলোচনা করব।
মুস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ
এক দিকে চোট, কিছুটা অফ ফর্মও। অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের পেস বোলারদের মধ্যে তাসকিন আহমেদ, শরীফুল ইসলাম, হাসান মাহমুদরা ভালো করছেন। দুই মিলিয়ে প্রায়ই মাঠের বাইরে কাটাতে হচ্ছে মুস্তাফিজকে। ২০২৩ সালে যেমন বাংলাদেশ সব মিলে এ পর্যন্ত ২০টি ওয়ানডে খেললেও মুস্তাফিজ খেলেছেন মাত্র ১১টিতে। তাতে উইকেট নিয়েছেন ১৫টি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, বিশ্বকাপের আগে আগে ফর্মে ফিরেছেন ৯৩টি ওয়ানডেতে ১৫৬ উইকেট নেওয়া মুস্তাফিজ। সর্বশেষ ৪ ম্যাচে নিয়েছেন ৮ উইকেট; যা বিশ্বকাপ ঘিরেও মুস্তাফিজের ওপর প্রত্যাশাটা বাড়িয়ে তুলেছে। তাছাড়া বিশ্বকাপ তো তার প্রিয় মঞ্চই! ২০১৫ বিশ্বকাপের পরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক তার। কাজেই তিনি মাত্র একটা ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছেন। ইংল্যান্ডের সেই ২০১৯ বিশ্বকাপেই ৮ ম্যাচ খেলে নিয়েছিলেন ২০ উইকেট, যা বাংলাদেশিদের মধ্যে বিশ্বকাপে যৌথভাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটের মালিক বানিয়েছে তাকে। তার সমান ২০ উইকেট নিয়েছেন বর্তমানের নির্বাচক আব্দুর রাজ্জাক, ১৫ ম্যাচে। সর্বোচ্চ ৩৪ উইকেট সাকিবের। ৮ ম্যাচের মধ্যেই দুই বার ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়েছেন। বিশ্বকাপে বাংলাদেশি বোলারদের মধ্যে এই কীর্তি শুধু তার। এছাড়া একবার মাত্র ৫ উইকেট নিয়েছেন সাকিব। ভারতের মাটির বিশ্বকাপেও মুস্তাফিজ হয়ে উঠতে পারেন বল হাতের বড় নায়ক।
ড্যারিল মিচেল, নিউজিল্যান্ড
বর্তমান রানারআপ নিউজিল্যান্ড দল একের পর এক খেলোয়াড়ের ইনজুরিতে জর্জরিত। তারপরেও আশা জাগিয়ে রেখেছে ড্যারিল মিচেলদের মতো ব্যাটিং অল-রাউন্ডাররা। ড্যারিল গত এক বছরে ১৬টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন। ৪০.৭৩ গড়ে রান করেছেন ৬১১। করেছেন ৩টি শতক। পাশাপাশি বল হাতে নিয়েছেন ৭টি উইকেট। সব মিলে ২৯টি ওয়ানডে খেলে করেছেন ৪৬.৫৯ গড়ে ১০২৫ রান, উইকেট ২০.২৩ গড়ে ১৩। ৩২ বছর বয়সি ড্যারিল মিচেল এখন অপেক্ষায় প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার। আসন্ন বিশ্বকাপেও তিনিই হয়ে উঠতে পারেন নিউজিল্যান্ড দলের উজ্জ্বল কাণ্ডারি।
শাহীন শাহ আফ্রিদি, পাকিস্তান
২০১৮ সালে ওয়ানডে অভিষেকের পর মাত্র ৪৪টি ম্যাচ খেলেই ৮৬টি উইকেট নিয়েছেন শাহীন শাহ আফ্রিদি। এরই মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা পেসার হিসেবে। পাকিস্তানের এই পেসার বল হাতে নিজের কারিশমা সবচেয়ে বেশি দেখিয়েছিলেন ২০১৯ বিশ্বকাপে। ইংল্যান্ডের ওই আসরে মাত্র ৫টি ম্যাচ খেলেই শাহীন নিয়েছিলেন ১৬ উইকেট! ওয়ানডেতে
ক্যারিয়ার-সেরা বোলিং কীর্তিটিও তার ওই বিশ্বকাপেই। লর্ডসে বাংলাদেশের বিপক্ষে ৩৫ রান দিয়ে নিয়েছিলেন ৬ উইকেট। তার আগুনে পুড়েই ৩১৬ রানের লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশ অলআউট হয় ২২১ রানে। চোটের কারণে পরে বেশির ভাগ সময়ই মাঠের বাইরে কাটালেও শাহীনের বলের আগুনের তেজ এখনো কমেনি। চোটের কারণে বিশ্বকাপ মিস করা নাসিম শাহর অবর্তমানে তিনিই থাকবেন পাকিস্তানের বোলিং আক্রমণের নেতা। গত মাসে এশিয়া কাপে ৫ ম্যাচে ১০ উইকেট নেওয়া শাহীন শাহ আফ্রিদি পারবেন ২০১৯ বিশ্বকাপের রূপে ফিরে ভারতের মাটির বিশ্বকাপটা নিজের এবং পাকিস্তানের বানাতে? পারলে ২০২২ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালের সেই আক্ষেপও দূরে করতে পারবেন। ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে চোট পেয়ে মাঠ ছাড়তে হয় তাকে। তার অবর্তমানে ইংল্যান্ড অনায়াসেই ম্যাচ জিতে চ্যাম্পিয়ন হয়। ওই সময়ে মাঠ ছাড়ার কারণে শুনতে হয় সমালোচনা। পরে শাহীন নিজেও অনুশোচনার আগুনে পুড়েছেন। দলের শিরোপা ব্যর্থতার জন্য দায়ী করেছেন নিজেকে। মনে হলে হয়তো এখনো আফসোসের আগুনে পোড়েন। ভারত বিশ্বকাপে তাই শাহীনের জন্য সুযোগ দারুণ কিছু করে সেই অনুশোচনা থেকে মুক্ত হওয়ার।
কাগিসো রাবাদা, দক্ষিণ আফ্রিকা
ক্রিকেট বিশ্বকাপ দক্ষিণ আফ্রিকানদের জন্য আজন্ম আক্ষেপের মঞ্চ। চ্যাম্পিয়ন হওয়া দূরের কথা, সেরা সেরা দল নিয়েও দক্ষিণ আফ্রিকা কখনো ফাইনালেই উঠতে পারেনি। ৪ বার সেমিফাইনালে উঠলেও ৪ বারই সেমিতে থেকেই বিদায় নিতে হয়েছে কখনো ভাগ্যের ফেরে, কখনো বা নিজেদের ভুলে! চাপের মুখে তালগোল পাকিয়ে ফেলে বলে তাদের বলা হয় ‘চোকার’। এবার সেই ‘চোকার’ অপবাদ ঘুচিয়ে ভারত বিশ্বকাপে বিশেষ কিছু করতে পারবে প্রোটিয়ারা? এই প্রশ্নের উত্তর অনেকটাই নির্ভর করবে কাগিসো রাবাদার ওপর। নিশ্চিতভাবেই দক্ষিণ আফ্রিকার বোলিং আক্রমণের প্রধান অস্ত্র তিনি। ৯২টি ওয়ানডে খেলে ১৪৪ উইকেটের মালিক রাবাদার ভারতের কন্ডিশন এবং প্রতিটা মাঠ হাতের তালুর মতোই চেনা। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের পর থেকেই আইপিএলে খেলছেন তিনি। অগ্নিঝরা বোলিংয়ের সুবাদে আইপিএলের বড় তারকাও হয়ে উঠেছেন তিনি। ফলে ভারতের কোন স্টেডিয়ামের উইকেট কেমন, কীভাবে বল করলে সাফল্য মিলে, সবই তার জানা।
বিশ্বকাপ যেহেতু ভারতে, তাই রাবাদার সামনে সুযোগ আইপিএলের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশকে সাফল্যের পথ দেখানোর। আছে বিশ্বকাপে খেলার অভিজ্ঞতাও। ২০১৯ বিশ্বকাপে ৯ ম্যাচের ৮ ইনিংসে বল করে নিয়েছিলেন ১১ উইকেট। ২৮ বছর বয়সি রাবাদা এবার নিশ্চয় বিশেষ কিছু করার জন্যই মুখিয়ে আছেন।
বিরাট কোহলি, ভারত
এখন পর্যন্ত তিনটি বিশ্বকাপের মঞ্চে ভারতীয় দলের হয়ে খেলেছেন তিনি। ২০১১ সালে ভারতের বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য ছিলেন ভারতের এই তারকা খেলোয়াড়। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপের মঞ্চে খেলেছেন ২৬টি ম্যাচ। ভারতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক বিশ্বকাপের মঞ্চে এ পর্যন্ত করেছেন ১০৩০। রানের গড় যেখানে ৪৬.৮১। বিশ্বকাপের তিন আসরে দুইটি সেঞ্চুরির পাশাপাশি তার ঝুলিতে রয়েছে ৬টি হাফসেঞ্চুরি। এবার আবার বিশ্বকাপ খেলবেন নিজেদের ঘরের মাঠে। দারুণ ফর্মে ফেরা কোহলি নিশ্চিতভাবেই ভারতের ব্যাটিং লাইনআপের অন্যতম বড় ভরসা। আসন্ন বিশ্বকাপটাকেও নিজের রঙে রাঙাতে পারেন তিনি।
ডেভিড ম্যালান, ইংল্যান্ড
ওয়ানডে বিশ্বকাপের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের তুরুপের তাস হতে পারেন কয়েকজন। তবে সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স বিবেচনায় সবার চেয়ে এগিয়ে বাঁহাতি টপ অর্ডার ব্যাটার ডেভিড মালান। গত এক বছরে ১০টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। ৫৬ গড়ে তার ব্যাট থেকে রান এসেছে ৫০৪। আছে ২টি শতক ও ২টি অর্ধশতক। সব মিলে ২১টি ওয়ানডে করেছেন ৬১.৫১ গড়ে ১০৪৬ রান এবং ১টি উইকেট। আসন্ন বিশ্বকাপটা যদি নিজের রঙে রাঙিয়ে দেন ডেভিড মালান, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
বাস ডি লিড, নেদারল্যান্ডস
বিশ্ব ক্রিকেট অঙ্গনে ছোট দলের বড় তারকা বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। নেদারল্যান্ডস দলের বাস ডি লিড সেই ছোট দলের বড় তারকা। নেদারল্যান্ডসের ডানহাতি ক্রিকেটার ব্যাট হাতে যেমন কার্যকর, তেমনি বল হাতেও সমান দক্ষ। দুই মিলে পরিপূর্ণ এক পেস-অলরাউন্ডার। ২৩ বছর বয়সি তরুণ অলরাউন্ডার এ পর্যন্ত ৩০টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন। তাতে ২৭.৩২ গড়ে করেছেন ৭৬৫ রান। আছে একটি সেঞ্চুরি ও দুটি হাফ সেঞ্চুরি। বল হাতে নিয়েছেন ২৪ উইকেট। এবার অপেক্ষা বিশ্বকাপের মঞ্চ কাঁপানোর। তরুণ বাস ডি লিড সত্যিই বিশ্বকাপে হয়ে উঠতে পারেন বড় তারকা।
অ্যাডাম জাম্পা, অস্ট্রেলিয়া
আসন্ন ভারতের মাটির বিশ্বকাপে ভালো করার প্রত্যাশার মাত্রাটা অ্যাডাম জাম্পা নিজেই বাড়িয়ে দিয়েছেন। গত মার্চে দ্বিপক্ষীয় ওয়ানডে সিরিজে ভারতের মাটিতে ভারতকে হারানোর নায়ক তো ছিলেন তিনিই। করেছিলেন রেকর্ডও। ওয়ানডেতে ভারতে এসে সবচেয়ে কম রান দিয়ে ৪ উইকেট নেওয়া স্পিনারদের মধ্যে প্রথমে জায়গা করে নিয়েছেন জাম্পা। সব মিলে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ৮০ ম্যাচ খেলে তুলে নিয়েছেন ১৩২ উইকেট। আছে বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতাও। ২০১৯ বিশ্বকাপে ৪টি ম্যাচ খেলে নিয়েছিলেন ৫টি উইকেট। ভারতের মাটির বিশ্বকাপেও তার ঘূর্ণিপ্রতিপক্ষদের মাথাব্যথার কারণ হতে পারে।
রশিদ খান, আফগানিস্তান
আফগান ক্রিকেটের পোস্টারবয় রশিদ খান। মাঠে কিংবা মাঠের বাইরে সবসময় আলোচনায় থাকেন এই বোলিং অল-রাউন্ডার। তবে সবকিছুর পরেও সচেতন নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে। গত এক বছরে ১০টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন। ২৯.৫০ গড়ে ১৪টি উইকেট তুলে নিয়েছেন। সব মিলে ৯৪ ওয়ানডেতেই নিয়েছেন ১৭২ উইকেট। গড় মাত্র ১৪.৮০! তবে বিশ্বকাপ মঞ্চে নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারেননি আফগান ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা। প্রথমবারের মতো ২০১৯ বিশ্বকাপে খেলা রশিদ খান দলের হয়ে নিজেদের ৯টি ম্যাচেই খেলেছিলেন। ৯ ম্যাচে উইকেট নিয়েছেন ৬টি, ব্যাট হাতে রান করেছেন ১০৫। তবে এবার যেহেতু বিশ্বকাপ ভারতের মাটিতে, যেখানে আইপিএল মাতিয়েই বিশ্ব তারকা হয়ে উঠেছেন, কাজেই আগের আসরের আক্ষেপ মুছে এবার বিশ্বকাপটা নিজের রঙেই রাঙাতে পারেন রশিদ খান।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : মুস্তাফিজুর রহমান বাংলাদেশ শাহীন শাহ আফ্রিদি পাকিস্তান বিরাট কোহলি ভারত ওয়ানডে বিশ্বকাপ বিশ্বকাপ ক্রিকেট
© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh