আন্তর্জাতিক এক দিনের (ওয়ানডে) ম্যাচের যাত্রা শুরু ১৯৭১ সালে। ৪ বছরের মাথায়ই ১৯৭৫ সালে আয়োজন করা হয় প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপ। সেই থেকে এ পর্যন্ত ১২টি ক্রিকেট বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই প্রতিবেদনে আমরা জানব কোন আসরে কোন দল কীভাবে ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন’-এর শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট মাথায় তুলেছে।
১৯৭৫ বিশ্বকাপ : ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাজিমাত
প্রথম বিশ্বকাপের আসর বসে ক্রিকেটের জন্মভূমি ইংল্যান্ডে। তার আগে বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া দলগুলো খুব বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগই পায়নি। সর্বোচ্চ ১৬টি ওয়ানডে খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে বিশ্বকাপে নামে ইংল্যান্ড। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭টি ওয়ানডে খেলার অভিজ্ঞতা ছিল অস্ট্রেলিয়ার। ওয়েস্ট ইন্ডিজ খেলেছিল মাত্র ২টি ওয়ানডে, ১৯৭৩ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ক্লাইভ লয়েডের নেতৃত্বে সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজই অবিশ্বাস্য নৈপুণ্যে জিতে নেয় ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন’-এর মুকুট। ৮ দলের টুর্নামেন্টে নিজেদের ৫ ম্যাচেই জিতে চ্যাম্পিয়ন হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
শিরোপার পথে ফেবারিট অস্ট্রেলিয়াকে দুবার হারায় ক্যারিবীয়রা। একবার গ্রুপপর্বে, আরেকবার ফাইনালে। গ্রুপপর্বে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর পর সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে সহজেই হারিয়ে ফাইনালে উঠে ক্লাইভ লয়েডের দল। ২১ জুন লর্ডসের ফাইনালে অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েডের ঝড়ো সেঞ্চুরির (৮৫ বলে ১০২) সুবাদে ৬০ ওভারে ৮ উইকেটে ২৯১ রান করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। জবাবে অস্ট্রেলিয়া ২৩৩ রানেই ৯ উইকেট হারিয়ে ফেলে। এরপরও অস্ট্রেলিয়াকে জয়ের স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন শেষ দুই ব্যাটসম্যান জেফ থম্পসন ও ডেনিস লিলি। দুজনে দশম উইকেটে ৪১ রানের জুটি গড়ে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। তবে থম্পসনের রানআউটের মাধ্যমে ২৭৪ রানে অলআউট হয় অস্ট্রেলিয়া। ১৭ রানে ম্যাচ জিতে ক্যারিবীয়রা উৎসবে মাতে বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দে। সেঞ্চুরির সুবাদে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জেতেন ক্যারিবীয় অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড।
১৯৭৯ বিশ্বকাপ : শিরোপা ধরে রেখে ওয়েস্ট ইন্ডিজের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা
৪ বছর পর দ্বিতীয় ক্রিকেট বিশ্বকাপও অনুষ্ঠিত হয় ইংল্যান্ডে। এবারও ৫ ম্যাচেই জিতে টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এবার ফাইনালে তারা হারায় স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে। গ্রুপপর্বে নিউজিল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ভারতকে হারানোর পর সেমিফাইনালে পাকিস্তানকে হারিয়ে ফাইনালে উঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২৩ জুন লর্ডসের ফাইনাল জিতে ক্লাইভ লয়েডের দল ধরে রাখে শিরোপা-মুকুট। প্রতিষ্ঠিত করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব। ভিভ রিচার্ডসের ১৩৮ ও কলিস কিংয়ের ৮৬ রানের ইনিংসে ক্যারিবীয়রা গড়ে ৯ উইকেটে ২৮৬ রানের পুঁজি। ২৮৭ রানের লক্ষ্য তাড়ায় ইংল্যান্ড উদ্বোধনী জুটিতেই করে ১২৯ রান। তারপরও মাত্র ১৯৪ রানে গুঁড়িয়ে গিয়ে ইংলিশরা ম্যাচ হারে ৯২ রানে। ইংলিশদের সর্বনাশটা করেন জুয়েল গার্নার, ৩৮ রানে ৫ উইকেট নিয়ে। ম্যাচসেরার পুরস্কারটি ওঠে ভিভ রিচার্ডসের হাতে।
১৯৮৩ বিশ্বকাপ : স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে যায় কপিল দেবের ভারত
এবারও বিশ্বকাপের আসর বসে ইংল্যান্ডে। দলসংখ্যাও ৮টি। তবে ম্যাচসংখ্যা ১৫ থেকে বেড়ে হয় ২৭। গ্রুপপর্বে প্রতিটি দল একে অন্যের বিপক্ষে দুইবার করে মুখোমুখি হয়। আধিপত্য বজায় রেখে এবারও ফাইনালে উঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেই ক্লাইভ লয়েডের নেতৃত্বে। ফাইনালে ক্যারিবীয়রাই ছিল ফেবারিট; কিন্তু ১৯৮৩ সালের ২৫ জুন লর্ডসের ফাইনালে ক্রিকেটপ্রেমীদের হতবাক করে দিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় কপিল দেবের পুঁচকে ভারত। ওই সময়ে ভারত দল হিসেবে দুর্বলই ছিল। অথচ কপিল দেবের সেই দলটিই টুর্নামেন্টে দুইবার হারায় মহাপ্রতাপশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। ভারত, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া পড়েছিল একই গ্রুপে। প্রথম সাক্ষাতেই ক্যারিবীয়দের ৩৪ রানে হারিয়ে চমক দেখায় ভারত। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফিরতি লেগে প্রতিশোধ নিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই উঠে সেমিফাইনালে। সেখানে পাকিস্তানকে হারিয়ে ফাইনালেও উঠে। অন সেমিফাইনালে ভারত হারায় ইংল্যান্ডকে। ক্রিকেটপ্রেমীরা ধরেই নেয়, ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ টানা তৃতীয় বিশ্বকাপ জিততে যাচ্ছে। সেই বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয় ভারত মাত্র ১৮৩ রানে অলআউট হওয়ায়; কিন্তু কি আশ্চার্য! মহিন্দর অমরনাথ, মদন লাল ও বালবিন্দর সিং সান্ধুর অবিশ্বাস্য বোলিং নৈপুণ্যে দুর্ধর্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ মাত্র ১৪০ রানে গুঁড়িয়ে যায়। ১২ রান দিয়ে ৩ উইকেট নেওয়া মহিন্দর অমরনাথ হন ম্যাচসেরা। মদনলালও নেন ৩ উইকেট, বালবিন্দর সিং নেন ২ উইকেট।
১৯৮৭ বিশ্বকাপ : অস্ট্রেলিয়ার প্রথম শিরোপা উৎসব
ইংল্যান্ডের সীমানা পেরিয়ে এবারের বিশ্বকাপ আসর বসে ভারত উপমহাদেশে। যৌথভাবে আয়োজন করে ভারত ও পাকিস্তান। টুর্নামেন্টের দলসংখ্যা এবং ফরম্যাট ১৯৮৩-এর মতোই। ৬০ ওভারের পরিবর্তে ম্যাচ নেমে আসে ৫০ ওভারে। এই আসরের সবচেয়ে বড় চমক ছিল-আগের তিনবারই ফাইনালে ওঠা ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবার গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নেয়। বি গ্রুপ থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে টপকে সেমিফাইনালে উঠে পাকিস্তান ও ইংল্যান্ড। এ গ্রুপ থেকে শেষ চারে যায় ভারত ও অস্ট্রেলিয়া। স্বাগতিক হওয়ার ফায়দা তুলে ভারত, পাকিস্তান নিজ নিজ গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন হয়; কিন্তু সেমিতে দুই দলই হেরে যায়। পাকিস্তানকে হারিয়ে অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতকে হারিয়ে ফাইনালে উঠে ইংল্যান্ড। ৮ নভেম্বর কলকাতার ইডেন গার্ডেনসের ফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পায় অ্যালান বোর্ডারের অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়ার ৫ উইকেটে ২৫৩ রানের জবাবে ইংল্যান্ড আশা জগিয়েও শেষ পর্যন্ত করতে পারে ৮ উইকেটে ২৪৬ রান। ৭ রানের জয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে রাজত্বের বীজ বুনে অসিরা। ৭৫ রানের ইনিংস ম্যাচসেরার পুরস্কার দেয় অস্ট্রেলিয়ার ডেভিড বুনকে।
১৯৯২ বিশ্বকাপ : ভাগ্য আর শেষের চমকে পাকিস্তানের স্বপ্ন পূরণ
অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মাটির বিশ্বকাপে পাকিস্তান ফেবারিট তালিকায় ছিল না। তারপরও পাকিস্তান চ্যাম্পিয়ন হয় ভাগ্য আর শেষের চমকে। পাকিস্তান বিশ্বকাপটা শুরু করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ১০ উইকেটের হার দিয়ে। দ্বিতীয় ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জিতলেও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তৃতীয় ম্যাচে মাত্র ৭৪ রানে অলআউট হওয়ার লজ্জায় ডুবতে হয় পাকিস্তানকে। জবাবে ইংল্যান্ড ৮ ওভারে ১ উইকেটে ২৪ রান করে ফেলে। এরপরই পাকিস্তানের জন্য সৌভাগ্যের ফুল হয়ে বৃষ্টি ঝড়ে। বৃষ্টিতে ম্যাচটি ভেস্তে যাওয়ায় নিশ্চিত হারা ম্যাচে মহামূল্যবান একটি পয়েন্ট পায় পাকিস্তান। শেষ পর্যন্ত সেই পয়েন্টটিই পাকিস্তানকে নিয় যায় সেমিফাইনালে। ইংল্যান্ড ম্যাচের পর ভারতের কাছেও হারে পাকিস্তান। তারপরও সেমিফাইনালে উঠতে আরও একবার সৌভাগ্যের ছোঁয়া পায় পাকিস্তান। সমীকরণ ছিল এমন- গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে আগেই বিদায় নিশ্চিত হওয়া অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জিতলে বা ম্যাচটা পরিত্যক্ত হলে সেমিফাইনালে উঠবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তানকে নিতে হবে বিদায়; কিন্তু মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়া ৫৩ রানে জিতে পাকিস্তানকে তুলে দেয় সেমিফাইনালে। বাকিটা ইতিহাস। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম সেমিফাইনালে ইনজামাম-উল-হকের ৩৭ বলে ৬০ রানের ইনিংস পাকিস্তানকে অবিশ্বাস্যভাবে তুলে দেয় ফাইনালে। ২৫ মার্চ মেলবোর্নের ফাইনালে আবার দেখা হয় সেই ইংল্যান্ডের সঙ্গে। মেলবোর্নের ফাইনালে অধিনায়ক ইমরান খান (১১০ বলে ৭২), জাভেদ মিয়াঁদাদ (৯৮ বলে ৫৮), ইনজামাম (৩৫ বলে ৪২) ও শেষ দিকে ওয়াসিম আকরামের ঝড়ে (১৮ বলে ৩৩) পাকিস্তান ৯ উইকেটে করে ২৪৯ রান। জবাবে ওয়াসিম আকরাম (৩ উইকেট), মুস্তাক আহমেদ (৩ উইকেট), আকিব জাভেদদের দুর্দান্ত বোলিংয়ের মুখে ইংল্যান্ড করতে পারে ২২৭ রান। ২২ রানের জয়ে পাকিস্তান পায় প্রথম এবং একমাত্র বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ। অল-রাউন্ড নৈপুণ্যে ম্যাচসেরার পুরস্কার পান ওয়াসিম আকরাম।
১৯৯৬ বিশ্বকাপ : শ্রীলঙ্কার রূপকথা
এক আসরের ব্যবধানে বিশ্বকাপ আবার ফিরে উপমহাদেশে। এবার আয়োজন করে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা মিলে। তিন স্বাগতিকের মধ্যে বাজিমাত করে শ্রীলঙ্কা, টুর্নামেন্ট শুরুর আগে যাদেরকে কেউ গণনাতেই ধরেনি; কিন্তু নিজেদের প্রথম ম্যাচেই অন্যতম ফেবারিট অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়াকওভার পায় শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কায় খেলতে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়ে স্বেচ্ছায় ওয়াকওভার দেয় অসিরা। মাঠে না নেমেই পাওয়া সেই জয় আন্ডারডগ শ্রীলঙ্কাকে এতটাই উজ্জীবিত করে যে, পরের সবকয়টি ম্যাচ জিতে শতভাগ জয় নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। লাহোরের ফাইনালে সেই অস্ট্রেলিয়াকেই ৭ উইকেটে হারিয়ে প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পায় লঙ্কানরা। এখনো পর্যন্ত সেটিই তাদের একমাত্র শিরোপা হয়ে আছে। ওই আসরেই সনাত জয়াসুরিয়া ও রমেশ কালুভিথারানার ভয়ংকর উদ্বোধনী জুটির আবির্ভাব ঘটে। সঙ্গে অরবিন্দ ডি সিলভা, অর্জুনা রানাতুঙ্গা, গুরুসিংহে, হাসান তিলকারত্নেদের নৈপুণ্যে স্বপ্ন ছোয় শ্রীলঙ্কা। ফাইনালে অধিনায়ক মার্ক টেইলরের ৭২, রিকি পন্টিংয়ের ৪৫ ও মাইকেল বেভানের অপরাজিত ৩৬ রানের ইনিংসে ৭ উইকেটে ২৪১ রান করে অস্ট্রেলিয়া। জবাবে অরবিন্দ ডি সিলভার অপরাজিত সেঞ্চুরি (১০৭), গুরুসিংহের ৬৫ ও অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গার অপরাজিত ৪৭ রানের ইনিংসের সুবাদে শ্রীলঙ্কা ২২ বল ও ৭ উইকেট হাতে রেখেই ছুঁয়ে ফেলে লক্ষ্য (২৪৫/৩)। ব্যাটিংয়ের আগে বল হাতেও ৩ উইকেট নেওয়া অরবিন্দ ডি সিলভা হন ম্যাচসেরা। টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কারটি জিতেন তারই সতীর্থ অবিশ্বাস্য ব্যাটিং ঝড়ের মাধ্যমে নিজেকে ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা জয়াসুরিয়া।
১৯৯৯ বিশ্বকাপ : অস্ট্রেলিয়ার একচ্ছত্র রাজত্বের শুরু
১৯৯৬-এর ফাইনালে হারার জ্বালা অস্ট্রেলিয়ানরা জুড়ায় ১৯৯৯-তে চ্যাম্পিয়ন হয়ে। তবে স্টিভ ওয়াহর দল চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা ছিল সৌভাগ্যের ছোঁয়ার ফসল। পাশাপাশি ১৯৯২ ও ১৯৯৬ মতো ১৯৯৯ আসরেও দক্ষিণ আফ্রিকানদের জন্য লেখা হয় আক্ষেপের গল্প। পাকাপাকিভাবে জোটে ‘চোকার’ অপবাদ। সুপার সিক্সের শেষ ম্যাচে হার্সেল গিবস অসি অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহর সহজ ক্যাচ ফেলে অস্ট্রেলিয়াকে তুলে দেয় সেমিফাইনালে। সেমিফাইনালেও আবার সেই অস্ট্রেলিয়ারই মুখোমুখি হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকানরা, লেখে আনাড়িপনায় রানআউট হয়ে হাতের মুঠোয় এসে যাওয়া জয় হাতছাড়া করার চির আক্ষেপের গল্প। শেষ ৪ বলে ১ রানের সমীকরণ মেলাতে গিয়ে রানআউট খড়্গে কাটা পরে ম্যাচ টাই করে! অসিরা জয় পেয়ে যায় আগের সাক্ষাতে জয়ী হওয়ায়! পরপর দুই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে সৌভাগ্য ও প্রতিপক্ষের ভুলে ফাইনালে উঠে অস্ট্রেলিয়া। ওদিকে ওয়াসিম আকরামের পাকিস্তান ফাইনালে ওঠে পুরো টুর্নামেন্টে অবিশ্বাস্য নৈপুণ্যে; কিন্তু হায়! ২০ জুন লর্ডসের ফাইনালে ভাগ্যের ছোঁয়ায় টেনে-টুনে ফাইনালে ওঠা অস্ট্রেলিয়ার কাছে পাত্তাই পায়নি পাকিস্তান। শেন ওয়ার্ন, গ্লেন ম্যাকগ্রাদের বোলিং তোপে ১৩২ রানে গুঁড়িয়ে যায় পাকিস্তান। অস্ট্রেলিয়া ২ উইকেট হারিয়ে ২০.১ ওভারেই ছুঁয়ে ফেলে লক্ষ্য (১৩৩/২)। অসিরা পায় দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ, শুরু করে অবিশ্বাস্য রাজত্বের। ফাইনালসেরা হন ৩৩ রানে ৪ উইকেট নেওয়া শেন ওয়ার্ন। টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার উঠে কপাল পোড়া দক্ষিণ আফ্রিকার ট্র্যাজিক-নায়ক ল্যান্স ক্লুজনারের হাতে।
২০০৩ বিশ্বকাপ : সেই অস্ট্রেলিয়ানই শিরোপা উৎসব
দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ের মাটির এই বিশ্বকাপে আর ভাগ্যের চাকায় চড়ে নয়, ব্যাটে-বলে মাঠে একচ্ছত্র রাজত্ব দেখিয়েই টানা দ্বিতীয় এবং সব মিলে তৃতীয়বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় অস্ট্রেলিয়া। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে নিজেদের ১১ ম্যাচেই জিতে অসিরা। টুর্নামেন্টের সেরা দুটি দলই ফাইনালে উঠে। শচীন টেন্ডুলকারের বিস্ময়কর ব্যাটিং জাদুতে ভারতও দুর্দান্ত দাপট দেখিয়েই উঠেছিল ফাইনালে; কিন্তু ২৩ মার্চ জোহানেসবার্গের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ধরাশায়ী হয় সৌরভ গাঙ্গুলির ভারত। ফাইনালে দুই দলের মধ্যে পার্থক্যটা গড়ে দেয় অসি অধিনায়ক রিকিং পন্টিংয়ের অপরাজিত ১৪০ রানের ইনিংস এবং ডেমিয়েন মার্টিনের সঙ্গে তার ২৩৪ রানের জুটি। মার্টিন করেন অপরাজিত ৮৮ রান। তৃতীয় উইকেটে পন্টিং-মার্টিনের বিশাল এই জুটির সুবাদে ২ উইকেটে ৩৫৯ রানের পাহাড় গড়ে অস্ট্রেলিয়া। ৩৬০ রানের অসম্ভব লক্ষ্য তাড়ায় ভারত ২৩৪ রানেই গুটিয়ে যায়। ম্যাচসেরার পুরস্কার পান পন্টিং। টুর্নামেন্ট সেরা হন রেকর্ড ৬৭৩ রান করা টেন্ডুলকার। এখনো পর্যন্ত বিশ্বকাপের এক আসরে সেটাই ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড।
২০০৭ বিশ্বকাপ : অস্ট্রেলিয়ার শিরোপার হ্যাটট্রিক
প্রথম দুটি বিশ্বকাপ জয়ের পর ১৯৮৩ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে সুযোগ ছিল বিশ্বকাপ জয়ের হ্যাটট্রিক করার। ফাইনালে উঠেও সেই কীর্তি গড়তে পারেনি ক্লাইভ লয়েডের দল। তবে রিকি পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়া প্রথম এবং একমাত্র দল হিসেবে ঠিকই শিরোপা জয়ের হ্যাটট্রিক করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে। আগের আসরের মতো এবারও অস্ট্রেলিয়া নিজেদের সব ম্যাচই জিতে টানা তৃতীয় ও সব মিলে চতুর্থ শিরোপা জিতে। ১৯৯৯-তে পাকিস্তান, ২০০৩-এ ভারতের পর ২০০৭-এর ফাইনালে উপমহাদেশের আরেক দল শ্রীলঙ্কাকে। মাহেলা জয়াবর্ধনের শ্রীলঙ্কা যোগ্যতর দল হিসেবে ফাইনালে উঠেছিল; কিন্তু ২৮ এপ্রিল ব্রিজটাউনের ফাইনালে তারা পাত্তাই পায়নি অসিদের কাছে। অ্যাডাগ গিলক্রিস্টের ১০৪ বলে ১৪৯ রানের ঝড়ে ৩৮ ওভারে ৪ উইকেটে ২৮১ রান করে অস্ট্রেলিয়া। পরে বৃষ্টি আইনে ৩৬ ওভারে ২৬৯ রানের লক্ষ্য তাড়ায় নেমে শ্রীলঙ্কা ৮ উইকেটে করতে পারে ২১৫ রান। বৃষ্টি আইনে ৫৩ রানে জিতে অস্ট্রেলিয়া শিরোপার হ্যাটট্রিকের পাশাপাশি ১৯৯৬-এর হারের প্রতিশোধের জ্বালাও মেটায়। পন্টিং ও ম্যাকগ্রা গড়েন টানা ৪টি ফাইনাল খেলার রেকর্ড। আর কারও এই কীর্তি নেই। এ ছাড়া পন্টিং, ম্যাকগ্রা ও গিলক্রিস্ট গড়েন তিনটি বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ড। এই কীর্তিও আর কারো নেই। স্বাভাবিকভাবেই ফাইনাল সেরা হন গিলক্রিস্ট। টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার উঠে গ্লেন ম্যাকগ্রার হাতে, ১১ ম্যাচে সর্বোচ্চ ২৬ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড গড়ার সুবাদে। ম্যাকগ্রার এই রেকর্ড ২০১৯ আসরে ভেঙে দিয়েছেন তারই উত্তরসূরি মিচেল স্টার্ক, ২৭ উইকেট নিয়ে।
২০১১ বিশ্বকাপ : মহারথী শচীন টেন্ডুলকারের স্বপ্ন পূরণ
আইসিসির ঘূর্ণায়মান নিয়মে বিশ্বকাপের আয়োজক অধিকার আবার আসে উপমহাদেশে। ১৯৯৬-এর মতো ২০১১-তেও শিরোপা থাকে উপমহাদেশেই। ফাইনালে সহ-স্বাগতিক শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জেতে ভারত। পূরণ হয় শচীন টেন্ডুলকার নামের এক ক্রিকেট মহারথীর বিশ্বকাপ জয়ের আজন্ম স্বপ্ন, ষষ্ঠবারের প্রচেষ্টায়। ফাইনালের আগে সেমিফাইনাল ভারত হারিয়েছিল পাকিস্তানকে। ভারত-শ্রীলঙ্কা, দুই ফাইনালিস্টই নিজ নিজ গ্রুপে দ্বিতীয় হয়ে পা রাখে কোয়ার্টার ফাইনালে। ২ এপ্রিল মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে দুই দলের ফাইনালটাও ছিল জমাট লড়াইয়ের প্রদর্শনী। মাহেলা জয়াবর্ধনের ১০৩ রানের ইনিংসে শ্রীলঙ্কা ৬ উইকেটে ২৭৪ রান করে। জবাবে গৌতম গম্ভীরের ১১২ বলে ৯৭ ও অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির ঠান্ডা মাথার ৭৯ বলে অপরাজিত ৯১ রানের ইনিংসে চড়ে ভারত ৮ বল বাকি থাকতে ৪ উইকেটে করে ফেলে ২৭৭ রান। ম্যাচসেরার পুরস্কার উঠে ধোনি হাতে। টুর্নামেন্ট সেরা হন চ্যাম্পিয়ন ভারতেরই যুবরাজ সিং।
২০১৫ বিশ্বকাপ : আবার অস্ট্রেলিার শিরোপা উৎসব
মাঝে এক আসর গ্যাপ দিয়ে আবার বিশ্বকাপ জয়ের উৎসব বসে অস্ট্রেলিয়ায়। যেটি তাদের পঞ্চম বিশ্বকাপ শিরোপা। এবারের আসরের যৌথ আয়োজক ছিল অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। এই দুই স্বাগতিক দলই মুখোমুখি হয় ফাইনালে। যোগ্যতর দল হিসেবেই ফাইনালে ওঠে তারা। কিন্তু ১৯ মার্চ মেলবোর্নের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার অভিজ্ঞতার কাছে সহজেই হার মানে প্রথমবার বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলতে নামা নিউজিল্যান্ড। মিচেল জনসন, জেমস ফোকনার ও মিচেল স্টার্ক-অস্ট্রেলিয়ার তিন পেসারের তোপে মাত্র ১৮৩ রানে গুটিয়ে যায় নিউজিল্যান্ড। গ্র্যান্ট ইলিয়ট (৮৩) ও রস টেলর (৪০) বাদে নিউজিল্যান্ডের বাকি সবাই ছিলেন ব্যর্থ। পরে অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্কের ৭৪, স্টিভেন স্মিথের অপরাজিত ৫৬ ও ডেভিড ওয়ার্নারের ৪৫ রানের ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া ৩৩ ওভারে ৪ উইকেট হারিয়েই করে ফেলে ১৮৬ রান। ম্যাচসেরা হন জেমস ফোকনার। টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার উঠে মিচেল স্টার্কের হাতে। অস্ট্রেলিয়ার পঞ্চম শিরোপার আসরটি বাংলাদেশের জন্যও সর্বোচ্চ সাফল্যের স্মৃতি হয়ে আছে। এই আসরেই প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে উঠার কৃতিত্ব দেখায় মাশরাফি বিন মুর্তজার বাংলাদেশ।
২০১৯ বিশ্বকাপ : সৌভাগ্যের চাকায় ইংলিশদের আজন্ম আক্ষেপের অবসান
ইংল্যান্ড ক্রিকেটের জন্মভূমি। অথচ তাদেরই বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ৪৪ বছর আর ১২টি আসর! প্রথম তিনটি বিশ্বকাপসহ ৪ বার স্বাগতিক হয়েও শিরোপা স্বপ্ন অধরাই থেকে যায় ইংলিশদের। তিন বার ফাইনালে ওঠে তিনবারই নীল হতে হয় পরাজয়ের বেদনায়। অবশেষে ইংলিশরা আজন্ম আক্ষেপ মুছে ফেলেছে ২০১৯ সালে নিজেদের ঘরের মাটিতে, পঞ্চম বারের মতো স্বাগতিক হওয়ার মাধ্যমে। পরম আরাধ্য শিরোপাটা ইংলিশরা পায় সৌভাগ্যের ছোঁয়া। যোগ্যতর দল হিসেবেই ফাইনালে উঠেছিল স্বাগতিক ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড। যেটি ছিল বিশ্বকাপে ইংলিশদের চতুর্থ ফাইনাল, কিউইদের টানা দ্বিতীয়। ১৪ জুলাই লর্ডসের ফাইনালে নিউজিল্যান্ডের সামনে সুযোগ এসেছিল আগের আসরের শিরোপা বঞ্চিত হওয়ার আক্ষেপ মুছে প্রথম বিশ্বকাপ জেতার। কিন্তু সেই সুযোগ তারা পায়ে ঠেলেছে নিজেদের ভুলেই! মহানাটকীয় ফাইনালে প্রথমে ব্যাট করে ৮ উইকেটে ২৪১ রান করেছিল নিউজিল্যান্ড। জবাবে ইংল্যান্ডও ঠিক ২৪১ রানে অলআউট হয়। প্রথম প্রচেষ্টাতেই বেন স্টোকসকে রানআউট করতে পারলে ১ রানে জিতে চ্যাম্পিয়ন হতো নিউজিল্যান্ড; কিন্তু বেন স্টোকসকে তারা প্রথম প্রচেষ্টায় রানআউট করতে পারেনি। ভাগ্যগুণে পাওয়া রানে ম্যাচ টাই করে ফেলে ইংল্যান্ড। কিউইদের মিস ফিল্ডিংয়ের সুবাদে জয়সূচক রানের জন্যও প্রচেষ্টা চালায় বেন স্টোকস ও মার্ক উড। তবে এবার আর তারা রান পূর্ণ করতে পারেননি। রানআউট হয়ে যান মার্ক উড। ফলে খেলা গড়ায় সুপার ওভারে। সেখানেও নাটক। শেষ বলে কিউইদের দরকার ছিল ২ রান। কিন্তু প্রথম রান পূর্ণ করলেও দ্বিতীয় রানটি নিতে গিয়ে রানআউট হন মার্টিন গাপটিল। মানে সুপার ওভারেও টাই! ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন হয় মূল ম্যাচে বেশি বাউন্ডারি মারায়! অপরাজিত ৮৪ রানের ইনিংসের সুবাদে ম্যাচসেরা হন বেন স্টোকস। টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার উঠে নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনের হাতে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh