টাইমড আউটের লঙ্কাকাণ্ডে উত্তপ্ত বিশ্বকাপ

মরমি সাধক ফকির লালন শাহ গেয়েছিলেন, ‘সময় গেলে সাধন হবে না।’ বাউল সম্রাট সৃষ্ট অবিস্মরণীয় গানের লাইনটির সঙ্গে ইচ্ছে করলেই মেলাতে পারেন অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউজের ‘টাইমড আউট’ হওয়ার ঘটনাকে; যা নিয়ে পুরো ক্রিকেট দুনিয়া হয়ে পড়েছে দ্বিধা-বিভক্ত। উঠছে নীতিবোধ আর ক্রীড়াসুলভ আচরণের প্রশ্ন। ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে ম্যাথিউজের সঙ্গে রয়েছেন সাকিব আল হাসান।

ভারতের মাটিতে চলমান আইসিসি বিশ্বকাপের ৩৮তম ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ আর শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশকে হারালে শ্রীলঙ্কার সেমিফাইনাল স্বপ্ন বেঁচে থাকত। আর ২০২৫ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলার আশা জিইয়ে রাখতে বাংলাদেশের সামনেও জয়ের কোনো বিকল্প ছিল না। ম্যাচটি বাংলাদেশ জিতেছে ৩ উইকেটে। যার অর্থ শ্রীলংকার বিশ্বকাপ সেমির স্বপ্নের ইতি। ৮ ম্যাচে সমান ৪ পয়েন্ট নিয়ে লংকানরা এখন টাইগারদের সমান্তরালে।

কিন্তু বাংলাদেশ আর শ্রীলংকার ম্যাচ যেন পড়ে গেছে ‘শেষ হয়েও হলো না শেষ’-এর ঘূর্ণাবর্তে। ম্যাচের জয়-পরাজয় ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম ‘টাইমড আউট’ হওয়া ম্যাথিউজ। ঘটনা শ্রীলংকার ইনিংসের ২৫তম ওভারে। সাকিবের বলে সাদিরা সামারাবিক্রমা আউট হওয়ার পর ক্রিজে আসেন ম্যাথিউজ। আইসিসির নিয়ম অনুয়ায়ী, একজন ব্যাটার আউট হওয়ার পর দুই মিনিটের মধ্যে অপর ব্যাটারকে ক্রিজে এসে বল মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। কিন্তু ম্যাথিউজ যে হেলমেট নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন, খুব সম্ভবত তার ফিতা ছেঁড়া ছিল। পরে তার সতীর্থ আর একটি হেলমেট এনে দেন তাকে। কিন্তু ততক্ষণে দলের একজন ফিল্ডারের পরামর্শে আম্পায়ারের কাছে ‘টাইমড আউটের’ আবেদন করেন টাইগার অধিনায়ক সাকিব। দুই ফিল্ড আম্পায়ার আলোচনা করে লংকান অলরাউন্ডারকে আউটের সিদ্ধান্ত দেন। বিষয়টা নিয়ে সাকিব আর মাঠের আম্পায়ারদের  সঙ্গে তর্ক-আলোচনা করেও ব্যর্থ ম্যাথিউজ হতবাক হয়ে বেরিয়ে যান।

ম্যাচ শেষেও ম্যাথিউজের আউটে রুষ্ট শ্রীলংকান দল বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের সঙ্গে সৌজন্যমুলক করমর্দন করেননি। উল্টো ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। ট্র্যাজেডির নায়ক ম্যাথিউজ বলেন, ‘এ ম্যাচের পর বাংলাদেশের প্রতি তাদের আগের মতো সম্মান নেই। সাকিব ও বাংলাদেশ যা করেছে, তা অসম্মানজনক।’ ম্যাথিউজ সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ‘এক্স’-এ একটি পোস্টের মাধ্যমে নিজেকে ‘নির্দোষ’ বলে দাবি করেছেন । প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, আইন মোতাবেক ৫ সেকেন্ড সময় বাকি থাকতেই তিনি হেলমেট সমস্যার সমাধান করেছিলেন। ম্যাথিউজের বক্তব্য সত্যি হলেও সাকিব নির্দোষ। তিনি আইসিসি আর এমসিসির আইন কাজে লাগিয়েছেন। হোক সেটা অপ্রচলিত। তবু আইন তো! ভুল কেউ করে থাকলে মাঠের আম্পায়াররা করেছে। হ্যাঁ, প্রশ্ন উঠতে পারে খেলায় জেন্টলম্যান অ্যাপ্রোচ নিয়ে। যেমন সমালোচনা করা হয় ‘মানকাড’ আউট নিয়ে। সাকিব জানিয়েছেন, এই আউটের জন্য তাকে দোষ না দিয়ে আইসিসির নিয়ম পরিবর্তনের আবেদন করা উচিত।

যা-ই হোক, টাইমড আউটের ঘটনা বাদ দিলে চলমান বিশ্বকাপের সবটুকু আলো এখন বিরাট কোহলির ওপর। তিনি ছুঁয়ে ফেলেছেন ওয়ানডে ক্রিকেটে শচীন টেন্ডুলকারের সর্বোচ্চ ৪৯টি সেঞ্চুরির রেকর্ড। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে কোহলির ব্যাট থেকে আসে অপরাজিত ১০১ রান। ৫ নভেম্বর নিজের জন্মদিনটি কোহলি রাঙিয়েছেন শচীনকে ছুঁয়ে। চলতি বিশ্বকাপে ভারতের পর সবচেয়ে ধারাবাহিক দক্ষিণ আফ্রিকা। হল্যান্ডের বিপক্ষে অঘটন ছাড়া পুরো আসরে রেকর্ডের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন প্রোটিয়া ক্রিকেটাররা। কিন্তু ভারতের কাছে বিস্ময়করভাবে তারা হেরে গেছে ২৪৩ রানে!

আর ভারত ছুটছে উল্কার গতিতে। আট ম্যাচে আট জয়। প্রতিপক্ষ ভারতের সামনে এলেই মুখ থুবড়ে পড়ছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে শ্রীলংকাকে ৫৫ আর দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৮৩ রানে গুটিয়ে দিয়েছে ভারতীয় বোলাররা। মোহাম্মদ শামি মাত্র চার ম্যাচ খেলেই নিয়েছেন ১৬ উইকেট! ৮ ম্যাচ খেলা জশপ্রিত বুমরাহ ১৫ আর রবীন্দ্র জাদেজা ১৫ উইকেট শিকার করেছেন। ভারতের ব্যাটাররা যে মাঠে রানের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন, সেখানেই টিম ইন্ডিয়ার বোলারদের সামনে অসহায়ের মতো আত্মসমর্পণ করছে প্রতিপক্ষ ব্যাটিং লাইন আপ!

ভারতের একচেটিয়া দাপট দেখে পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার হাসান রাজা সরাসরি অভিযোগ করে বসেছেন, ভারতীয় বোলারদের সুবিধা দিতে বিশেষ ধরনের বল দেওয়া হচ্ছে। এমনকি ডিআরএসের (ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম) ক্ষেত্রেও কারচুপি করছে ভারত। ফলে বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন রোহিত শর্মারা! হাসান রাজার অভিযোগ প্রমাণিত না। তবে ভারতের দাপট দৃশ্যমান। ভারতের প্রতিটা ডিপার্টমেন্ট খেলছে একাত্ম হয়ে। তাতে ভারতের সামনে যে কোনো প্রতিপক্ষকে মনে হচ্ছে অতিসাধারণ। ভারত ছাড়া পুরো আসরে ধারাবাহিক নয় কোনো দল। আবার ভারত আর দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়া সেমির ভাগ্য ঝুলে আছে অন্যদের। নিউজিল্যান্ড প্রথম চার ম্যাচে জয়ের পর পথ হারিয়ে ধুঁকছে। টানা চার পরাজয়ে তাদের সেমিফাইনাল অনিশ্চিত। কিউইরা অবশ্য নিজেদের দুর্ভাগা ভাবতেই পারে। পাকিস্তানের বিপক্ষে ৪০১ রান করেও তাদের হারতে হয়েছে ডাকওয়ার্থ অ্যান্ড লুইস সমীকরণে। বৃষ্টির সৌভাগ্যে পাকিস্তান ম্যাচে জিতেছে ২৩ রানে। তাতে পাকিস্তান আর নিউজিল্যান্ড ৮ ম্যাচে ৮ পয়েন্ট নিয়ে ঝুঁকিতে। নিউজিল্যান্ডের শেষ ম্যাচ শ্রীলংকার বিপক্ষে, পাকিস্তানের লড়াই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। সমীকরণ বলছে, নিজেদের শেষ ম্যাচে পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডকে জিততেই হবে। 

এদিকে অস্ট্রেলিয়া আফগানিস্তানকে হারিয়ে নাম লিখিয়েছে সেমিতে। আফগানদের ছুড়ে দেওয়া ২৯২ রানের টার্গেট ৩ উইকেট হাতে রেখে ছুঁয়েছে অজিরা। অথচ এক পর্যায়ে ৯১ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে ছিল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু অষ্টম উইকেট জুটিতে গ্লেন ম্যাক্সওয়েল আর প্যাট কামিন্স অবিচ্ছিন্ন ২০২ রান যোগ করে দলকে এনে দেন অবিশ্বাস্য জয়। যেখানে কামিন্সের অবদান ছিল ৬৮ বলে মাত্র ১২ রান। আর চলতি বিশ্বকাপের প্রথম ডবল সেঞ্চুরি তুলে নিয়ে ম্যাক্সওয়েল করেন অপরাজিত ২০১ রান, সেটাও মাত্র ১২৮ বলে। তার ব্যাট থেকে আসে ২১টি চার আর ১০টি ছক্কা। এতে টানা ছয় জয়ে তাদের সেমি নিশ্চিত। হেরে যাওয়া আফগানিস্তান ৮ ম্যাচে ৮ পয়েন্ট নিয়ে আছে সেমির লড়াইয়ে। নিউজিল্যান্ড আর পাকিস্তানের মতো  আফগানদেরও শেষ ম্যাচ জিততে হবে। সেই ক্ষেত্রে পড়তে হবে সমীকরণের মারপ্যাঁচেও। 

১০ দলের বিশ্বকাপের শেষ রাউন্ডে নির্ধারিত হবে আফগানিস্তান, নিউজিল্যান্ড আর পাকিস্তানের ভাগ্য। এ ছাড়া বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, নেদারল্যান্ডস ও ইংল্যান্ডের আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির হিসাব মেলানোও বাকি। তাই বিশ্বকাপের লিগ পর্বের শেষ রাউন্ডের প্রতিটা ম্যাচের থাকছে আলাদা গুরুত্ব। শুধু মাঠের খেলা না, সমীকরণ মেলাতে প্রয়োজন হবে কাগজ-কলমের।

ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স বিবেচনায় ‘ম্যান অব দ্য সিরিজ’ লড়াইয়ে শামিল হয়েছেন একাধিক ক্রিকেটার। ভারতের বিপক্ষে ব্যর্থ হলেও রান সংগ্রহে দক্ষিণ আফ্রিকার কুইন্টন ডি কক শীর্ষে। চার সেঞ্চুরিসহ ৮ ম্যাচে তার সংগ্রহ ৫৫০ রান। পিছিয়ে নেই কোহলিও। তিনি করেছেন ৫৪৩ রান। পাকিস্তানের বিপক্ষে চলতি বিশ্বকাপে নিজের তৃতীয় সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন রাচিন রবীন্দ্র। সেরা ব্যাটার তালিকার তিনে আছেন ৫২৩ রান নিয়ে। আর কেউ পাঁচ শতাধিক রানের কোঠা ছুঁতে পারেননি।

শ্রীলংকার দলগত পারফর্ম্যান্স ভালো না। কিন্তু দলটির মাদুশাংকা ২১ উইকেট নিয়ে শীর্ষে। অজি স্পিনার অ্যাডাম জাম্পা নিয়েছেন ৮ ম্যাচে ২০ উইকেট। দক্ষিণ আফ্রিকার মার্কো জেনসেন পেয়েছেন ১৭ উইকেট। অস্ট্রেলিয়া ও আফগানিস্তান ম্যাচ পর্যন্ত বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি হয়েছে ৩০টি। যার মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকানদের ব্যাট থেকেই এসেছে আট সেঞ্চুরি। যার আবার অর্ধেক মানে চারটি হাঁকিয়েছেন একা ডি কক। দক্ষিণ আফ্রিকা সেমিতেও উঠেছে। তাতে ল্যান্স ক্লুজনারের পর ডি ককের কাছে বিশ্বকাপের ‘ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট’ হওয়ার সুযোগ এসেছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //