-60c05e308ca74.jpg)
টিকটকার হৃদয় বাবু
টিকটক, লাইকি ভিডিও তৈরির আড়ালে নানা অপরাধের তথ্য বেরিয়ে আসছে। দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মারামারি, হামলা, চুরি, ভয়ভীতি দেখানো ও হুমকি দেয়ার মতো অভিযোগ ছিল আগেই। নতুন করে নারী পাচার, যৌন নির্যাতন, মাদক সেবন করে তরুণ-তরুণীদের বিপথগামী করার অভিযোগ উঠেছে।
টিকটকের কারণে অল্প সময়ে অনলাইন তারকা বনে যাচ্ছে অসংখ্য কিশোর। জনপ্রিয়তা পাওয়া টিকটকারদের বেশির ভাগের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছর। তাদের ফলোয়ার সংখ্যা লাখ লাখ। অনেকের এর থেকেও বেশি। পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাংলাদেশে জনপ্রিয় টিকটকারদের বেশির ভাগই অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত। কেউ সেলুনে কাজ করে, কেউ দিনমজুরের কাজ করে। কেউবা কোনো দোকানের বিক্রয়কর্মী। এর বাইরে স্কুল, কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা টিকটকে নিজেদের বিলিয়ে দিচ্ছে।
টিকটকের সূত্র ধরে তারকা হওয়ার নেশায় বিভোর কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। জনপ্রিয়তার নিরিখে তৈরি হয় এলাকাভিত্তিক গ্যাং। এই গ্যাং খোলা জায়গায়, ফুটপাতে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে একত্র হয়ে ভিডিও কন্টেন্ট তৈরির নামে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, ইভ টিজিং, পথচারীদের গতিরোধ, বাইক মহড়াসহ বিভিন্ন অসৌজন্যমূলক আচরণ করে থাকে। এমনকি কবরস্থানের মতো স্পর্শকাতর জায়গায় টিকটক করতে এরা পিছপা হয় না। রাজধানীর রায়েরবাজারে অবস্থিত বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে গেলে এসব চিত্র অহরহ চোখে পড়ে। কখনো কখনো এক এলাকার গ্যাংয়ের সঙ্গে অন্য এলাকার গ্যাংরা বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় ঠুনকো বিষয়কে কেন্দ্র করে খুনের মতো ঘটনা ঘটছে অহরহ।
সম্প্রতি ভারতের কেরালায় একটি হোটেলে নারী নির্যাতন করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে নড়েচড়ে বসে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী। তারপর একের পর এক অভিযানে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।
অভিযানে টিকটকের মডেল বানানো ও উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভনে নারী পাচারকারী চক্রের অন্যতম মূলহোতা আশরাফুল মন্ডল ওরফে বস রাফিসহ চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাব। সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী দাবকপাড়া কালিয়ানী এলাকা থেকে ৩ জনকে গ্রেফতার করে তেজগাঁও বিভাগ পুলিশ। এর মধ্যে দোষ স্বীকার করে মেহেদি হাসান পুলিশকে জানিয়েছে, ওই কিশোরীসহ প্রায় দেড় হাজারের বেশি নারীকে ভারতে পাচার করেছে তারা।
ডিএমপির তেজগাঁও জোনের ডিসি মো: শহীদুল্লাহ বলেন, সম্প্রতি ভারতে বাংলাদেশী এক তরুণীকে যৌন নির্যাতন ও পরবর্তী সময়ে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কুরুচিপূর্ণ ভিডিও বানিয়ে অশ্লীলতা ছড়ানোর অভিযোগে প্রায় শতাধিক টিকটকারকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, তাদের কর্মকাণ্ড কিশোরী কিংবা তরুণী পাচার করার মধ্য দিয়ে শুরু হয়। মূলত তাদের মডেল কিংবা স্টার বানানোর প্রলোভন দেখানো হয়। যা আমরা প্রথম থেকেই লক্ষ্য করেছি। কিন্তু ভুক্তভোগীর অভিযোগ না পাওয়ায় তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তবে এখন শুধু পুলিশই নয়, পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট এ বিষয়ে বিশেষভাবে কাজ করছে। যারা টিকটকের নামে অশ্লীল ভিডিও তৈরি, নারী পাচারের সাথে জড়িত তাদের সবাইকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
সম্প্রতি এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ‘এসব অ্যাপ সহজলভ্য হওয়ায় যুবসমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তারা কী সব অশ্লীল ও উদ্ভট ভিডিও বানাচ্ছে, যেগুলো আরো অনেককে খারাপ পথে টেনে নিচ্ছে। গোটা একটি প্রজন্ম শেষ হয়ে যাচ্ছে। টিকটক ও লাইকি যারা করছে, তাদের বিষয়ে নজরদারি করা হচ্ছে। এসব অ্যাপ বন্ধ করার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে সরকার।’
আলোচিত এসব অ্যাপ বন্ধের প্রসঙ্গে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘বিষয়টি আমরা জেনেছি। এর খারাপ প্রভাব আছে। বিষয়টি উদ্বেগের। র্যাবপ্রধান আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা হয়ে যদি মনে করেন টিকটক বন্ধ করা দরকার, তাহলে এ বিষয়ে আমাদের চিঠি দিয়ে জানালে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হবে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, টিকটক-লাইকিসহ বিতর্কিত অ্যাপগুলো নিষিদ্ধ করার সময় এসেছে। গত শনিবার রাজধানীতে ‘কিশোর অপরাধ বৃদ্ধিতে সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার’ নিয়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। র্যাব মহাপরিচালক জানান, টিকটক-লাইকিসহ বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপ ব্যবহারকে কেন্দ্র করে সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের অপরাধীদের তালিকা করা হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, ‘টিকটক সমাজের ক্যানসার হয়ে দেখা দিয়েছে। এই মাধ্যমটি শুরু থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা উচিত ছিল। এই ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ায় আমরা চিন্তিত। এটি বিকৃত একটি মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। ফলে চরম সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় ঘটছে কিশোরদের মধ্যে। ক্ষমার অযোগ্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।’
এই অপরাধ বিশ্লেষক আরও বলেন, ‘এভাবে কিশোর-কিশোরীরা এ ধরনের অপসংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এই তরুণরা তো আগামী দিনের নেতৃত্ব দেবে। তারা যদি এ ধরনের অসুস্থ সংস্কৃতির ভেতর বড় হয়, তাহলে তারা নেতৃত্ব দেবে কীভাবে? বাংলাদেশের টিকটক কালচার অনেক দূর এগিয়েছে। তবে সার্বিকভাবে প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে। সরকার যদি এখনই এর বিরুদ্ধে স্থায়ী পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে সামনে ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে।’