
শিল্পী কামাল উদ্দিনের আঁকা ছবি অবলম্বনে
‘কুম কুম চন্দন চুয়া বাটা ভরা পান গুয়া
রাঙ্গামুখ রাঙ্গা হবে রাগে।’
একসময় ছিল যখন প্রতিটি বাঙালি বাড়িতে মজুদ করা থাকত পানের বাটা। বাড়িতে অতিথি এলে এগিয়ে দেওয়া হতো পানের ডাবর। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর পান চুন আর খয়েরের রসে ঠোঁট রাঙিয়ে বিশ্রামালাপ করতেন বাড়ির গৃহিণীরা। পানের বাটা ঘিরে চলা সে আলাপের ডালপালা অযুত নিযুত।
ধামা ভরা আছে ধান বাটা ভরা পান।
ধনী লোকের আছে ধন মানি লোকের মান ॥
পান নিয়ে পুরাণে অনেক গল্পকথার উল্লেখ পাওয়া যায়। পুরাণকালে ব্রাহ্মণ এবং অতিথিদের বিদায় করার সময় অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে পান দেওয়ারও রীতি ছিল। তাই অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় পঞ্চপাণ্ডব হস্তিনাপুর ছাড়িয়ে পানের খোঁজে তোলপাড় করে ফেলেন। কিন্তু কোথাও তারা পানের খোঁজ পান না। খুঁজতে খুঁজতে একসময় একদল পাতালপুরীতে পৌঁছে যান। সেখানে ছিল নাগ রানির বাস। সেই নাগকুলের সঙ্গে পাণ্ডবদের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। আর সেই কারণেই নাগ রানি তার নিজের কনিষ্ঠ আঙুলটি কেটে নিয়ে সেই পান খুঁজতে আসা দলের হাতে দেন। এবং সেই আঙুলটি মাটিতে পুঁতে দিতে বলেন। সেই আঙুল মাটিতে পোঁতার পর সেখান থেকে জন্ম নেয় পানের বল্লরী। ফুল-ফলবিহীন সবুজ কচিপাতা সমৃদ্ধ সেই বল্লরীকে এ কারণেই সংস্কৃত ভাষায় নাগবল্লরী বলা হয়ে থাকে।
এ ছাড়াও আরও একটি পৌরাণিক আখ্যান আছে, সেখানে বলা হয়েছে যখন সমুদ্রমন্থনের সময় বিষের ভাণ্ডার উঠেছিল, তখন দেবাদিদেব মহাদেব সেই বিষ তার কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন। এর পর কিছুক্ষণের জন্য তিনি মূর্ছা গিয়েছিলেন। সেই সময় তার কপালে আর শরীরে জমা ঘাম আর ময়লা একটা তামার পাত্রে জমানো হয়। আর সেই মিশ্রণ থেকে জন্ম নেয় এক সুদর্শন পুরুষ এবং নারায়ণ তার নাম রাখেন তাম্বুলপুত্র। জন্মানোর পর সেই সুদর্শন পুরুষ নাগলোকে চলে যান, এবং তার রূপে মুগ্ধ হয়ে নাগকন্যা তাকে বিবাহ করে এবং তার ফলে জন্ম নেয় পানরূপী নাগবল্লরী।
যাত্রাপাটন পালায় লাউসেনের বাটার পান প্রসঙ্গ-
নানা পরিবন্ধ করি লাউসেন চিয়ান।
গা তল রাজার ব্যাটা খাও বাটার পান ॥
পট্টবস্ত্রের সাথে বাটা ভরা পান সংসারের ভবানী পূজার জন্য উপকরণের উল্লেখ-
বাটা ভরা কাটা গুয়া বিড়া বান্ধা পান।
পট্ট বস্ত্র অমূল্য রতন বিদ্যমান ॥
মৈমনসিংহ গীতিকায় উল্লেখ আছে লং এলাচ ইত্যাদি সহযোগে বাটা ভরা সাঁচি পান সাজিয়ে দিচ্ছে ঘরের পাঁচ পুত্রবধূ-
বাটা ভরা সাচি পান লং এলাচ দিয়া।
পাঁচ ভাইয়ের বউ দিচ্ছে পান সাজাইয়া ॥
অন্যত্র বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে আহ্বান আছে যে, বাটার পান খেতে খেতে তাকে পড়ান জুড়ানো বাতাস করা হবে তাল পাতার পাখায়-
আইস আইস বন্ধু খাওরে বাটার পান।
তালের পাঙ্খায় বাতাস করি জুড়াকরে পরান ॥
মেয়েলি ছড়ায় আছে জামাইকে বাটার পান দেয়ার কথা-
জামাই আইছে আনন্দে।
খাওগো বাটার পান
সুন্দরীরে করব দান।
সিলেটের জামাই মানে দামানকে খাটে বসে পান খেতে বলা হচ্ছে আর সোনার বাটায় পান সাজিয়ে বউ প্রদান করা হবে-
আইছো দামান বওরে খাটো
খাওরে বাটার পান
সোনার বাটায় পান সাজাইয়া
করবো বিবি দানগো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ছড়ায় আছে-
‘ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি ঘুমের বাড়ি যেয়ো
বাটা ভরে পান দেব, গাল ভরে খেয়ো।’
মৈমনসিংহ গীতিকায় বন্ধুকে বাটা ভরা পান বানিয়ে অপেক্ষমাণ চোখের জলে ভাসছে-
বাটা ভরি বানাইয়া পানরে বন্ধু তার দিতে লাজ বাসি।
আপনার চক্ষের জলে আরে বন্ধু আপনি যাই ভাসি ॥
অন্যত্র আছে, সোনার পাতে সাইল চালের ভ্যাট খাইয়ে বাটা ভরা পান সুপারি হাতে তুলে দেবার বাসনা-
বাটা ভরা পান গুয়া তুইল্যা দিব হাতে।
চিকন সাইলের ভাত খাইবা সোনার পাতে ॥
আরেক পালায় আছে গোয়ালিনী বাটার পান সব খেয়েছে চুন ছাড়া-
তবেত কারকুন শুনি গোয়ালিনীর গুণ।
খাইয়া বাটার পান না লইয়া চুন ॥
পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর অঞ্চলে বৃষ্টির প্রার্থনায় ডাকা হচ্ছে-
আইস মেঘা বইস কাছে
খাও বাটাৎ পান
তোমার জন্য বাটাৎ পান
সাজাইয়া রাখছি
বরসিয়া খাওরে।
পান ও বাটার বিভিন্ন রকম তাৎপর্যপূর্ণ ব্যবহার লক্ষ করা যায় বাঙালি সমাজে। বাঙালি হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েই বিয়ের একাধিক আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে এখনো জুড়ে আছে পান। যেমন পানকড়াল, পানখিলি, পানচিনি, পান-পত্তর, পান-বাতাসা, পানশল্লা, পানের আলাপ ইত্যাদি। বাটা ভরা পানের কয়েকটি খিলির মধ্যে লঙ্কা পুরে দিয়ে ঝাল পান খাইয়ে নতুন জামাইকে নাকের জলে-চোখের জলে করার রেওয়াজ তো ছিলই।
আবার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো মায়ের ভাষ্যে-
‘দপানের সজ্জা পানের ডাবর পান মশলার বাটি,
কন্যারে পাঠালাম আমি করি পরিপাটি।’
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আমাদের বাংলার ঠাকুরমা-দিদিমারা পানের বাটায় বিপ্লবীদের নাম লিখে রাখতেন। আগেকার দিনে পান মাউথ ফ্রেশনারের কাজ করত।
‘রক্ত উৎপল লাজে জলান্তরে বৈসে
তাম্বুল রাতুল হৈল অধর পরশে।’
পান খেলে ঠোঁট লাল হয় কিন্তু এখানে ‘ঠোঁটের পরশে পান লাল হয়ে যাওয়ার কথা। পদ্মাবতীর ঠোঁটের স্পর্শে খোদ পানই লাল হয়ে যাচ্ছে!’
কেহ কৃষ্ণ পাদপদ্ম সংবাহন করে
কেহ বা তাম্বুল দেয় বদন ভিতরে।
এই পান খিলি কি হাতে করে আনা হয়েছিল? কী ছিল এই পান খিলিতে? বলাই বাহুল্য, এই পান বহনকারী বা তাম্বুল সেবিকা কারুকার্য খচিত বাটায় বা পানদানে করে পান এনেছিল এমনটা আন্দাজ করা যায়। বাংলায় পানের আতিথেয়তা জুড়ে আছে নানা সৃজন কারুকাজ। তা পানের খিলি তৈরি থেকে পান সমাদরের নানা পর্যায় পর্যন্ত। পানের পিক ফেলার জন্য যে পাত্র ব্যবহার করা হতো তাও কোনো সাদামাটা পাত্র নয়! এই পাত্রের নাম পিকদান। তাতেও থাকে নকশা কারুকাজ।
সাধারণত যে পাত্রে করে পান পরিবেশন করা হয় তাকে পানদানি বলা হয়। এই পানের বাটায় কেটে রাখা সুপারি, সুপারি কাটার জাঁতি, চুনের কৌটা সাজিয়ে রাখা হয়। থাকে জর্দা, কিমা, তামাক পাতাও। পান যেখানে রাখা হয় তাকে বলে তাকে বলে ডাবর বা বাটা। ডাবর শব্দটির অর্থ দভ্র বা সাগর। যেখানে পান ধুয়ে লাল সালু কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়, যাতে শুকিয়ে না যায়। পেতলের অথবা রুপো দিয়ে তৈরি হয় এই বাটা। তবে এদের আকার আকৃতি বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন হয়।
‘বাটা ভরা পান দিব
দিব মিঠা গুয়া
দোক্তা দিব মুঠো মুঠো
মাখা তাতে চুয়া।’
পানসুপারির মূল্য বৃদ্ধিতে গান হয়েছে, সেখানে পানের বাটার অবস্থা বর্ণনা-
ওগো সজনী গুয়া গাছো
টেকসো লাগিলনি
বাটার উপর পড়লো ঠাটা
গাল ভরি পান খায়তায়নি?
গৃহস্থ বাড়ির এই তৈজস ইতিহাসে ধরা থাকে পরম্পরার কথা। পান বাটা, পানের ডিবেও তৈজস স্মৃতিতে পূর্ব প্রজন্ম প্রচ্ছন্ন সোহাগে জড়িয়ে থাকে উত্তর প্রজন্মের যাপনে। যা পারিবারিক এক স্নিগ্ধ নকশাকাটা ইতিহাস।
পানের বাটা তৈরি হতো কী দিয়ে? উপকরণ হিসেবে তামা, পিতল, কাঠ, মৃৎপাত্র তো আছেই-লোকসাহিত্যে আরও নানা উপকরণের পান বাটার বর্ণনা দেখতে পাওয়া যায়। সোনার, রুপার, এমনকি হীরার বাটার উল্লেখ-
বড় ঝারি ছোট ঝারি গুটি পাঁচ সাত,
দিব্য পিতলের বাটা পাকা পান তাত।
প্রচলিত গীতে সোনার বাটার উল্লেখ আছে-
তার উপর থইলা পান বসনে ঢাকিয়া
সুনার বাটায় ধান্য দূর্বা হীরার বাটায় লইয়া ॥
সাধারণের পানবাটা পানদান তো ছিলই, অভিজাতদের অন্দরে রুপার খান্দানি পানদান-
এককালে নগরে ছিল এক নবাব বেগম
খানদানি পানদানটি ছিল রুপার গড়ন।
ময়মনসিংহ গীতিকায় আছে আচমনের পানি ও পান বাটা সোনার তৈরি-
সোনার ঝাড়ি ভইরা রাখে আচমনের পানি।
তাম্বুলে সাজায় কন্যা সোনার বাটা খানি ॥
দেশে দেশে পানের বাটার আরেকটি আলাদা বিশেষ চরিত্র আছে। পানের বাটায় ফুটিয়ে তোলা হয় নানা নকশা। পিতল হোক বা রুপা তার গায়ে খোদাই করা নানা নকশা দেখতে পাওয়া যায়। সমাজের নানা পরিবারের বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পানের বাটায় নামধাম লেখারও রেওয়াজ ছিল।
এইখানে করিলাম শেষ বারমাসী গান।
বাটা ভইরা জামাইর মা দেও গোয়া পান ॥