Logo
×

Follow Us

তথ্যকোষ

যদিও আরব বসন্ত ফুল নিয়ে আসেনি

Icon

বখতিয়ার আবিদ

প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২৪, ১৬:১৮

যদিও আরব বসন্ত ফুল নিয়ে আসেনি

তিউনিসিয়ার স্বৈরশাসকের পতনের পর আরব বসন্তের যে জোয়ার শুরু হয় তার ধাক্কা এসে লাগে মিশরে। ছবি: সংগৃহীত

বাঙালির কাছে বসন্ত এক রঙিন ঋতু। মণিমালা, মহুয়া, রুদ্রপলাশ, শিমুলসহ হরেক ফুল গাছের শোভা বাড়ায় এ কালে। ২০১১ সালে বাঙালির ঋতুরাজ বসন্ত আরবে এসেছিল। তবে তা-মহুয়া-পলাশের পসরা কিংবা বসন্ত উৎসবের আমেজ নিয়ে নয়। সরকার উৎখাতের একেকটি রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থান বয়ে যেতে থাকে আরব দেশগুলোতে। মরুভূমির বালির ঝড়ে যেমন ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সামনে থাকা সবকিছু, তেমনি গণ-অভ্যুত্থানের সামনে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে থাকে একের পর এক আরব স্বৈরশাসক। 

তিউনিসিয়া থেকেই শুরু

আরব বসন্তের শুরুটা হয়েছিল ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর। স্নাতক পাস করে বুয়াজিজি কোনো চাকরি না পেয়ে স্থানীয় বাজারে সবজি বিক্রি করতেন। ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ সকালবেলায় তিউনিসিয়ার শহর সিদি বাওজিদে ফল বিক্রি করছিলেন বুয়াজিজি। সেদিন নারী পুলিশ ইন্সপেক্টর ফাইদা হামদি ঘুষ চাওয়ায় তার সঙ্গে কথা কাটাকাটি বেধে যায় বুয়াজিজির, এক পর্যায়ে ইন্সপেক্টর বুয়াজিজির সকল পণ্যসহ ঠেলা গাড়িটি আটক করে নিয়ে যায়। বুয়াজিজি অনেক অনুনয়-বিনয় করেও তার পণ্যসহ গাড়ি ফেরত পেতে ব্যর্থ হন। এর প্রতিবাদে বুয়াজিজি বাজার থেকে জ্বালানি কিনে এনে সিদি বাওজিদের রাস্তায় নিজেকে জ্বালিয়ে দেন। ১৮ দিন ধরে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ৪ জানুয়ারি মারা যান মোহাম্মদ বুয়াজিজি। এরপর দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে সরকারবিরোধী গণ-অভ্যুত্থান। ১৪ জানুয়ারি ২০১১-তে প্রায় এক মাস চলা এ অভ্যুত্থানে পতন ঘটে স্বৈরশাসক জয়নাল আবেদিন বিন আলির। অবসান হয় ২৩ বছরের শাসনের। 

পতনের দ্বিতীয় ধাক্কা মিশরে

তিউনিসিয়ার স্বৈরশাসকের পতনের পর আরব বসন্তের যে জোয়ার শুরু হয় তার ধাক্কা এসে লাগে মিশরে। ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি ব্যাপক আকারে হোসনি মোবারকবিরোধী গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয়। গণ-অভ্যুত্থান ঠেকাতে প্রায় ৮০০ মানুষকে হত্যা করে হোসনি মোবারক সরকার। অভ্যুত্থানকারী লক্ষাধিক মিশরীয় জনগণ কায়রোর তাহরির স্কয়ারে সমবেত হয়ে হোসনি মোবারকের পদত্যাগ দাবি করতে থাকেন। শুরুতে রাজি না হলেও আন্দোলনের ১৮তম দিনে ২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করেন মোবারক। তার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে মিশরে ৩০ বছর ধরে চলে আসা স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। 

নিহত হলেন গাদ্দাফি 

আরব বসন্তে পতন হওয়া স্বৈরশাসকদের মধ্যে লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফি একমাত্র শাসক যিনি অভ্যুত্থানকারীদের হাতে নিহত হয়েছিলেন। যদিও গণ-অভ্যুত্থানটি তখন সশস্ত্র ছিল। প্রায় নয় মাস ধরে লিবিয়ায় গণবিক্ষোভ ও সশস্ত্র লাড়াই চলে। ২০১১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বেনগাজিতে গাদ্দাফিবিরোধী প্রথম গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয়। সেখানে অভ্যুত্থানকারী জনতার বেশ কয়েকজন নিহত হন। 

কিন্তু ওই গণ-অভ্যুত্থানকে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে কঠোরভাবে দমনের চেষ্টা করেন গাদ্দাফি। পরবর্তী সময়ে এই গণ-অভ্যুত্থান গণবিদ্রোহে রূপ নেয়। ফলে তা দেশটিকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়।

একপর্যায়ে পশ্চিমা যৌথবাহিনী এবং পরে ন্যাটোর নেতৃত্বে হামলা চলতে থাকে গাদ্দাফি সমর্থিত বাহিনীর ওপর। ন্যাটোর বিমান হামলা ও বিরোধী ন্যাশনাল ট্রাঞ্জিশনাল কাউন্সিলের (এনটিসি) হামলার মুখে ২২ আগস্ট রাজধানী ত্রিপোলির দখল হারান গাদ্দাফি। ২০ অক্টোবর গাদ্দাফির জন্মশহর সিরতের দখল নেয় এনটিসির যোদ্ধারা। সেদিন প্রথমে গাদ্দাফিকে আটকের খবর শোনা গেলেও পরে দেখা যায় গাদ্দাফি বিদ্রোহীদের গুলির আঘাতে নিহত হয়েছেন। কে বা কারা তাকে গুলি করেছিল তাদের পরিচয় জানা যায়নি। 

ইয়েমেন দিয়ে শেষ

নিজের ক্ষমতা আজীবন সুসংহত করতে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লাহ সালেহ সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেন। ফলে অস্থিরতা দেখা দেয় ইয়েমেনে। ২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারি। আরব বসন্তের ঢেউ এসে পৌঁছাল ইয়েমেনে। রাজধানী সানার রাস্তায় নেমে এলো হাজার হাজার মানুষ। গণ-অভ্যুত্থান ঠেকাতে গিয়ে ওই বছরের মার্চের ১৮ তারিখ শুধু রাজধানী সানাতেই সেনাবাহিনী এবং প্রেসিডেন্ট সালেহর অনুগতদের গুলিবর্ষণে অন্তত ৫০ জন নিহত হয়। এ ছাড়াও দেশটির বিভিন্ন প্রান্তে সরকারের দমন-পীড়নে শত শত মানুষ প্রাণ হারায়। ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থানের মুখেও অনড় অবস্থান ধরে রাখেন আলি আবদুল্লাহ সালেহ। কিন্তু ২০১১ সালের নভেম্বর মাসের শেষ দিকে ‘কোনো রকম বিচারের সম্মুখীন হতে হবে না’­শর্তে ইয়েমেনের প্রতিবেশী দেশগুলো আলি আবদুল্লাহ সালেহকে পদত্যাগ করতে রাজি করায়। এভাবেই শেষ হয় ইয়েমেনের স্বৈরশাসক আলি আবদুল্লাহ সালেহর ৩৩ বছরের শাসনকাল। 

তিউনিসিয়ায় স্বৈরশাসকের পতনের মধ্য দিয়ে যে আরব বসন্ত শুরু হয়েছিল, ইয়েমেনের স্বৈরশাসকের পতনের মাধ্যমে তার শেষ হয়। ইয়েমেনে আজও রক্তের নদী বয়ে চলেছে, একই নদী সিরিয়া আর লিবিয়াতেও বয়ে যাচ্ছে। দশকের পর দশক জেঁকে থাকা স্বৈরশাসকের পতনের দিকে তাকালে মনে হতেই পারে আরব বসন্ত সফল। কিন্তু গণতন্ত্র আর আইনের শাসনের যে স্বপ্ন আরবের মানুষ দেখেছিলেন, তা আজও অধরাই রয়ে গেছে। সাফল্য আর ব্যর্থতার হিসেবের বাইরে-এখন শুধুই আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির মোড়লদের এক ক্রীড়াক্ষেত্র রুক্ষ, শুষ্ক, ধুলো ওঠা আরবের ময়দান।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫