
ডেরিনকুয়ু পাতাল শহর। ছবি: সংগৃহীত
ডেরিনকুয়ু, তুরস্কের কেপ্পাদোকিয়া অঞ্চলের অন্যতম রহস্যময় ও ঐতিহাসিক পাতাল শহর, যা পৃথিবীজুড়ে এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে পরিচিত। এটি একটি অত্যন্ত সুপরিকল্পিত এবং গভীরভাবে নির্মিত প্রাচীন শহর, যা মাটির তলায় গড়ে ওঠে এবং এখনো মানুষের মাঝে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। এই পাতাল শহরটির ভেতর অনেক অবাক করা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা আধুনিক প্রযুক্তির চেয়েও উন্নত মনে হতে পারে। আসুন আরো বিস্তারিতভাবে জানি ডেরিনকুয়ু শহরের অতীত, এর গঠন এবং তার রহস্যময় দিকগুলো সম্পর্কে।
ডেরিনকুয়ু শহরের আবিষ্কার এবং ইতিহাস
ডেরিনকুয়ু শহরটি ১৯৬০-এর দশকে তুরস্কের কেপ্পাদোকিয়া অঞ্চলের এক কৃষকের জমিতে আবিষ্কৃত হয়। এটি দীর্ঘকাল ধরে মাটির তলায় লুকিয়ে ছিল এবং বহু বছর ধরে স্থানীয়দের কাছে অজানা ছিল। প্রাচীন এই শহরের খোঁজ পাওয়া গেলেও, এর সঠিক সময় এবং নির্মাণের উদ্দেশ্য নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা চলছে।
ডেরিনকুয়ু, কিছু গবেষকের মতে, হিটাইট সভ্যতার সময়ে নির্মিত হতে পারে, যদিও এর সঠিক সময়কাল সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এটি এমন একটি স্থান হতে পারে, যা প্রাচীন মানবসভ্যতা কর্তৃক শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিল। অন্যদিকে কিছু বিশেষজ্ঞের মতামত হলো, এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক কেন্দ্র হতে পারে, যেখানে বাসিন্দারা পরম আত্মরক্ষার জন্য আশ্রয় নিয়েছিল।
শহরের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা
ডেরিনকুয়ু শহরটি প্রায় ৮০ মিটার (২৬০ ফুট) গভীরতার মধ্যে বিস্তৃত এবং বহু তলাবিশিষ্ট। এটি একটি বিশাল শহর, যার মধ্যে ১৮ তলা পর্যন্ত পৌঁছানো যেতে পারে, যদিও বর্তমানে বেশির ভাগ খোঁজ পাওয়া অংশ ৮-১০ তলা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। প্রতিটি তলা সংযুক্ত ছিল এবং একটি নলিকাল পদ্ধতিতে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত ছিল, যার ফলে বাসিন্দারা শত্রুদের আক্রমণের সময় সহজে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করতে পারত।
শহরের ভেতর রয়েছে-
বিভিন্ন তলা ও কক্ষ: প্রতিটি তলা বিভক্ত ছিল ছোট ছোট কক্ষে, যা বাসস্থান, খাদ্য সংরক্ষণ, প্রার্থনা এবং অন্যান্য কার্যকলাপের জন্য ব্যবহৃত হতো।
সামরিক ব্যবস্থা: শহরের অন্দরমহলে যুদ্ধের সময় শত্রুদের আক্রমণ ঠেকানোর জন্য বিভিন্ন ঘন পথ এবং টানেল তৈরি করা হয়েছিল। এটি একটি সুরক্ষিত আশ্রয়স্থল ছিল, যা শত্রুদের আক্রমণের সময় অন্তত কিছুদিন স্থিতিশীল থাকার সুযোগ দিত।
প্রবেশপথ ও নিরাপত্তাব্যবস্থা: শহরের বিভিন্ন প্রবেশপথ ছিল একেবারে গোপন এবং খুব সংকীর্ণ, যেগুলো সহজেই নিরাপত্তার জন্য বন্ধ করা যেত। গোলাকার পাথরের দরজা ব্যবহার করে, এই প্রবেশপথগুলো পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব ছিল।
বিশাল কক্ষ ও জলাধার: শহরে পানির সংকুলান নিশ্চিত করতে বেশ কয়েকটি বড় জলাধার এবং কুয়া রয়েছে। এসব জলাধার থেকে পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা হতো, যা দীর্ঘ সময় ধরে শহরের বাসিন্দাদের সাহায্য করত।
আজকের দিনেও রহস্যময়
ডেরিনকুয়ু শহরের প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং এটি কীভাবে নির্মিত হয়েছিল, তা আজও একটি রহস্য। যদিও অনেকেই মনে করেন এটি শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নির্মিত, তবে এর সঠিক উদ্দেশ্য এখনো নিশ্চিত নয়। শহরের কৌশলগত গঠন এবং এর বিশাল আকার দেখে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে এটি শুধু একটি সামরিক আশ্রয়স্থল ছিল না, বরং পূর্ণাঙ্গ সভ্যতার অংশ ছিল।
বায়ুপ্রবাহ এবং পানি সরবরাহ
ডেরিনকুয়ু শহরের অন্দরমহলে বসবাসকারী মানুষের জন্য সঠিক বায়ুপ্রবাহ ও পানির ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটি নিশ্চিত করার জন্য শহরের ভেতরে এক বিশেষভাবে নির্মিত এয়ারভেন্টিলেশন সিস্টেম ছিল, যা নিশ্চিত করত যেন বাতাসের গতি থাকে এবং বাসিন্দারা শ্বাস-প্রশ্বাসে কোনো অসুবিধায় না পড়ে। এটি বিশেষভাবে মাটির গভীরে অবস্থান করার কারণে প্রয়োজনীয় ছিল। শহরের ভেতরে টানেলগুলোর মধ্যে বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা এবং বৃহৎ শাফটগুলোও ছিল।
পানির জন্য, শহরের বিভিন্ন স্থানজুড়ে কিছু গভীর কুয়া এবং জলাধার খোঁড়া হয়েছিল, যা বেশির ভাগ তলার জন্য পানি সরবরাহ করত। পাশাপাশি খাবারের সরবরাহও খুবই চিন্তাশীলভাবে পরিকল্পিত ছিল, যাতে মানুষ দীর্ঘ সময় পর্যন্ত শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়ে বেঁচে থাকতে পারে।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দিক
ডেরিনকুয়ু শহরের মধ্যে একটি বড় গির্জা এবং অন্যান্য ধর্মীয় স্থাপত্য রয়েছে, যা প্রমাণ করে যে এখানকার বাসিন্দারা ধর্মীয় উদ্দেশ্যেও এই স্থান ব্যবহার করতেন। এটি স্থানীয় ধর্মীয় প্রথা এবং বিশ্বাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। গির্জাটি বিশেষভাবে পাথরের তৈরি এবং গোপন প্রার্থনার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ধর্মীয় স্থাপনাগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল, যাতে শত্রুর আক্রমণের সময় এগুলোর কার্যক্রম কোনোভাবেই বিঘ্নিত না হয়।
এ ছাড়া কিছু গবেষক মনে করেন, ডেরিনকুয়ুর বাসিন্দারা সম্ভবত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, প্রার্থনা এবং অন্যান্য সামাজিক কর্মকাণ্ডের জন্যও এই শহর ব্যবহার করতেন। এটি কেবল একটি সামরিক আশ্রয়স্থল ছিল না, বরং এটি সামাজিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করেছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় ও পর্যটন
ডেরিনকুয়ু শহরটি আজকাল তুরস্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। সারা বিশ্ব থেকে পর্যটকরা এখানে আসেন শহরের রহস্যময় গঠন এবং ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে জায়গাটি দেখতে। এখানে এসেও বিজ্ঞানীরা আরো গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন, যাতে এই শহরের পুরোপুরি ইতিহাস জানা যায়।
ডেরিনকুয়ু পাতাল শহর মানব সভ্যতার এক চমকপ্রদ দৃষ্টান্ত, যা প্রাচীন কৌশল, শিল্প এবং জীবনধারার এক বিশাল মিলনস্থল। এর স্থাপত্য, নিরাপত্তা, পানির ব্যবস্থা এবং ধর্মীয় কেন্দ্র প্রমাণ করে যে, প্রাচীন মানবসভ্যতা কীভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নিজেদের বাঁচানোর জন্য এমন এক অপূর্ব স্থাপত্য নির্মাণ করেছিল। এটি একটি ঐতিহাসিক সম্পদ, যা আগামী প্রজন্মের জন্যও একটি মূল্যবান শিক্ষা।