
তুরস্কের সানলিউরফা অঞ্চলে গোবেকলি টেপে। ছবি: সংগৃহীত
পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার ইতিহাসে মিশরীয় আর মেসোপটেমীয় সভ্যতাগুলোর নাম প্রথমেই আসে। তাদের রেখে যাওয়া স্থাপত্যকীর্তি আজও আমাদের বিস্মিত করে। কিন্তু গত শতাব্দীর মাঝের দিকে তুরস্কের সানলিউরফা অঞ্চলে গোবেকলি টেপে (তুর্কি ভাষায় ‘পেটমোটা পাহাড়’) নামের এক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা আবিষ্কৃত হয়েছে, যা প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা থেকেও সাত হাজার বছর এবং ইংল্যান্ডের স্টোনহেঞ্জ থেকে ছয় হাজার বছর পুরোনো।
যখন গোবেকলি টেপে নির্মিত হয়েছিল, মানুষ ছিল যাযাবর, ছোট ছোট দলে ঘুরে বেড়াত খাবারের সন্ধানে। কিন্তু এই যাযাবর মানুষই তৈরি করেছিল এমন বিশাল স্থাপত্য, যা আজও বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করে।
গোবেকলি টেপে প্রাগৈতিহাসিক আচার-অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তার জন্য বিশেষভাবে নির্মিত মানবসৃষ্ট মেগালিথিক স্থাপনার প্রাচীনতম উদাহরণগুলোর মধ্যে অন্যতম।
আপার মেসোপটেমিয়ায় অবস্থিত এই অঞ্চলে বিশ্বের প্রাচীনতম মানববসতির চিহ্ন পাওয়া যায়। এখানে পাওয়া গেছে টি-আকৃতির বিশাল চুনাপাথরের স্তম্ভ, যার কিছু ৫.৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা। এসব স্তম্ভে খোদাই করা আছে বিভিন্ন জীবজন্তু ও মানুষের প্রতীকী চিত্র, যা থেকে তৎকালীন মানুষের জীবনযাত্রা ও বিশ্বাস সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়।
গোবেকলি টেপের স্তম্ভগুলোতে খোদাই করা চিত্রগুলো মূলত প্রতীকী এবং অনেকটা গুহাচিত্রে পাওয়া চিত্রগুলোর মতোই। এখানে শূকর, শিয়াল, গাধা, ষাঁড়, পাখি (বিশেষত শকুন), সাপ, পোকামাকড় এমনকি মাকড়শারও চিত্র খোদাই করা আছে। কিছু স্তম্ভে মানুষের হাত এবং কোমরবন্ধনীর চিত্রও দেখা যায়।
একটি স্তম্ভর হাইরোগ্লিফিক চিহ্ন বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো সৌর ক্যালেন্ডারের সন্ধান পেয়েছেন। এ ছাড়া এখানে দুটি কেন্দ্রীয় স্তম্ভে খোদাই করা সিংহের মূর্তি দেখা যায়, যা থেকে এই স্থানটির গুরুত্ব বোঝা যায়।
গোবেকলি টেপের খননকার্য শুধু বিশাল স্থাপত্যের উন্মোচনই করেনি, বরং প্রাগৈতিহাসিক মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও তুলে ধরেছে। এখানে পাওয়া গেছে অসংখ্য ফ্লিন্ট সরঞ্জাম, যা মূলত পাথর দিয়ে তৈরি। এই সরঞ্জামগুলো থেকে তৎকালীন মানুষের প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও জীবনযাত্রার আভাস পাওয়া যায়।
১৯৬৩ সালে, প্রথম খননকালে তিন হাজারের বেশি পাথরের সরঞ্জাম পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে ছিল ফ্লেক, চপার, ব্লেড, বুরিন, স্ক্র্যাপার এবং তীর বা বল্লমের ফলা। এই বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম গোবেকলি টেপের বাসিন্দাদের উন্নত সামাজিক কর্মকাণ্ডের প্রমাণ দেয়।
স্পেস ১৬ (প্রতীকী) নামক স্থানে, প্রায় ৭০০টি সরঞ্জাম পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে স্ক্র্যাপার, চকচকে বস্তু, ছিদ্র করার সরঞ্জাম উল্লেখযোগ্য।
খাদ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহৃত সাত হাজারেরও বেশি গ্রাইন্ডিং স্টোন (শস্য পেষণ করার পাথর) সাইটজুড়ে পাওয়া গেছে। মাটিতে পাওয়া ফাইটোলিথ থেকে জানা যায়, এই পাথরগুলো শস্য পেষণের কাজে ব্যবহৃত হতো। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, এই শস্য কি প্রাকৃতিক ছিল নাকি চাষ করা? এই প্রশ্নের উত্তর এখনো প্রত্নতত্ত্ববিদদের কাছে অধরা। এই বিষয়ে আরো গবেষণা প্রয়োজন। কিন্তু গ্রাইন্ডিং স্টোনগুলোর উপস্থিতি থেকে এটা স্পষ্ট যে, গোবেকলি টেপের মানুষ খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে দক্ষ ছিল।
টি-আকৃতির স্তম্ভগুলো সংলগ্ন চুনাপাথর মালভূমি থেকে খোদাই করা হয়েছিল এবং স্থাপত্য ও প্রকৌশল প্রযুক্তির প্রাচীনতম উদাহরণ। এগুলো স্থাপত্য কারিগরদের এবং মানবসমাজের আরো শ্রেণিবদ্ধ রূপের উদ্ভবের সাক্ষ্য বহন করে।
গোবেকলি টেপের সবচেয়ে বড় স্তম্ভটির ওজন ১৬ টন। বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন যে, কোনো চাকা, ধাতব সরঞ্জাম বা পশু ব্যবহার না করে কিভাবে এত ভারী পাথর খণ্ডগুলো খাদান থেকে তুলে এনে স্থাপন করা হয়েছিল। ওই সময়ে এ রকম কিছুর অস্তিত্ব যে থাকতে পারে তা ছিল বিজ্ঞানীদের ধারণার বাইরে।
১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে সাইটে ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে গবেষণা ও প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চলছে। গোবেকলি টেপে ১৯৮৭ এবং ২০০৪ সাল থেকে ‘সংশোধিত সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক সম্পত্তি সুরক্ষা ২৯৬৩/১৯৮৩ আইন’ দ্বারা আইনত সুরক্ষিত।
২০০৫ সালে, ডিয়ারবাকির কাউন্সিল ফর কনজারভেশন অব কালচারাল অ্যান্ড ন্যাচারাল হেরিটেজের সিদ্ধান্তে, গোবেকলি টেপেকে প্রথম শ্রেণির প্রত্নসতাত্ত্বিক সংরক্ষণ স্থান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
গোবেকলি টেপে শুধু প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন নয়, এটি মানব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের প্রতিচ্ছবি। এখানকার স্থাপত্য, সরঞ্জাম ও চিত্রকর্ম থেকে তৎকালীন মানুষের জীবনযাত্রা, বিশ্বাস ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। গোবেকলি টেপে যেন মানবসভ্যতার শৈশবের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি, যা আজও বিজ্ঞানীদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।