
চুপাকাবরা
বড় বড় চোখ, ধূসর লোমবিশিষ্ট, শক্ত নখর, চার থেকে পাঁচ ফুট লম্বা দুটি পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই ভয়ঙ্কর প্রাণীটি দেখে যে কেউ শিউরে উঠবে। এমন এক ভিনগ্রহের প্রাণীর দেখা মিললো ল্যাটিন আমেরিকার শহরে। মেডেলিন তলেন্তিনো হটাৎ একদিন তার জানালার সামনে দেখতে পান এই ভয়ঙ্কর প্রাণীটিকে। তিনি ছিলেন কানোভানাস শহরের অধিবাসী।
ওই মুহূর্তে হঠাৎ করে পুয়ের্তো রিকোর বিভিন্ন অঞ্চলে রক্তহীন মৃত প্রাণীর লাশ পাওয়া যেতে থাকল। এ ঘটনার জন্য দায়ী করা হলো নতুন রহস্যময় এই প্রাণীটিকে। খবরটি ছড়িয়ে পড়লো সারাবিশ্বে। জানা গেলো, এটি ছিলো চুপাকাবরার প্রথম প্রজন্ম।
চুপাকাবরা নামটার মধ্যেই এর অর্থ অন্তর্নিহিত রয়েছে। এটি এক ধরনের কিংবদন্তি প্রাণী যা ছাগল, গরু, মহিষ, মেষ বিভিন্ন গৃহপালিত পশুর রক্ত পান করে। এর আক্ষরিক অর্থ ‘ছাগলচোষা’। স্প্যানিশ ভাষায় ‘চুপা’ মানে ‘চোষা’। আর ‘কাবরা’ অর্থ ‘ছাগল’। এটি একটি আরবান লিজেন্ড। ১৯৯৫ সালে ল্যাটিন আমেরিকার দেশ পুয়ের্তো রিকোতে এর প্রথম দেখা মেলে।
পরবর্তীতে ২০০৪ সালের দিকে নতুন করে ছড়াতে শুরু করলো চুপাকাবরার খবর। ঠিক আগের মতোই যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রক্তহীন মৃত গবাদিপশুর লাশের পাশাপাশি মৃত চুপাকাবরার সন্ধান পাওয়া গেলো। তবে এবার নতুন প্রজাতির চুপাকাবরার দেখা মিললো। বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার করা প্রাণীগুলোর লাশ দেখতে কালচে ও লোমহীন। প্রথম প্রজন্মের চুপাকাবরা দেখতে ভয়ঙ্কর হলেও দ্বিতীয় প্রজন্মের চুপাকাবরার আকৃতি কুকুরের মতো।
চুপাকাবরার গুজব শুরুর পর থেকে মানুষ যেকোনো অদ্ভুত প্রাণী দেখলেই তাকে চুপাকাবরা বলে আখ্যায়িত করতে শুরু করলো। কিন্তু এসব কিছুর অবসান ঘটালো আধুনিক বিজ্ঞান।
টেক্সাসে কুকুরসদৃশ যেসব প্রাণীর মৃতদেহ পাওয়া যায়, সেগুলো নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হলো। বেঞ্জামিন রেডফোর্ড নামের একজন লেখক ও গবেষক চুপাকাবরার উপর দীর্ঘ পাঁচ বছর গবেষণা চালান।
রেডফোর্ড বলেন, ‘মৃতদেহ পাওয়া মানে অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলা। ডিএনএ নমুনা, অস্থির নমুনা, অঙ্গসংস্থানবিদ্যা- এসবের সাহায্য নিয়ে অনেক তথ্যই উদঘাটন করা সম্ভব।’
ডিএনএ পরীক্ষায় দেখা গেলো মৃতদেহগুলো ছিলো মূলত কুকুরসদৃশ একধরনের প্রাণি র্যাকুন পার্থিব জীবের।
ডাক্তারি পরীক্ষায় জানা গেলো, মৃত প্রাণীগুলো কচ্ছু তথা সার্কোপটিক মাঞ্জ (Sarcoptic mange) রোগে ভুগছিল। সার্কোপটেস স্ক্যাবি (Sarcoptes scabiei) নামক পরজীবীর আক্রমণে চর্ম রোগ হয়। শরীরের চামড়ায় আক্রমণ করার ফলে প্রাণীর দেহের সব লোম পড়ে যায়। পরবর্তীতে এদের শরীরের বাহ্যিক গঠন এমন হয় যে প্রাণীটিকে দেখে ভয়ঙ্কর কোনো দানব বলে মনে হয়। যেসব মৃতপ্রাণীগুলোকে চুপাকাবরা ধারণা করা হয়েছিল, সেগুলো আসলে সাধারণ প্রাণীর মৃতদেহ।
তাহলে গলায় ছিদ্রবিশিষ্ট ও রক্তশূন্য গবাদিপশুগুলোর মৃতদেহ এলো কোথা খেকে? এমন একটা প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে সবার মাঝে। তবে এর একটি সহজে বর্ণনা দেয়া হয়েছে-
সাধারণত ছাগল, ভেড়া, মুরগি বিভিন্ন গবাদিপশুর ক্ষেত্রে দেখা যায়, কুকুর ঘাড়ে কামড় দেয়, এরপর শিকারকে ছেড়ে চলে যায়। তখন শিকার অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের ফলে মারা যায়। যার করণে বাইরে থেকে কেবল দাঁত বসানোর চিহ্ন ছাড়া আর কোনো আঘাতের চিহ্ন দেখা যায় না।
বেঞ্জামিন রেডফোর্ডের মতে, যখন একটি প্রাণী মারা যায় তখন তার হৃদপিণ্ড ও রক্তচাপ থেমে যায়। ধীরে ধীরে রক্ত শরীরের নিম্নভাগে চলে যায় ও ক্রমশ জমাট বাঁধতে থাকে। যার কারণে রাতের বেলা কোনো প্রাণী মারা গেলে, পরেরদিন এর শরীর কেটে ফেললেও শরীর থেকে এক ফোঁটা রক্ত বের হয় না।
সুতরাং এই অবস্থা দেখে গ্রামীণ কৃষকেরা হয়তো ধারণা করেছিলেন, তাদের পশুগুলোর রক্ত কোনো রহস্যময় প্রাণী খেয়ে গেছে।
১৯৯০ সালের দিকে পুয়ের্তো রিকোর একটি রেইনফরেস্টে আমেরিকানরা গোপন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করেছিলেন। অনেকেই ধারণা করেন চুপাকাবরা সেই গবেষণা থেকে এসেছে। তবে চুপাকাবরাকে অনেকে ভিন্ন গ্রহের প্রাণী হিসেবেই মনে করেন।
১৯৯৫ সালে প্রথম যখন চুপাকাবরা দেখা গিয়েছিল সেই সময় স্পিসিজ নামে একটি হলিউড সায়েন্স ফিকশন সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল। সিনেমাটি পুয়ের্তো রিকোতেও দেখানো হয়েছিল। আর সিনেমায় দেখানো ভিন্ন গ্রহের প্রাণীর (এলিয়েন) সাথে চুপাকাবরার সম্পূর্ণ মিল দেখা যায়। মেডেলিন তলেন্তিনোও ছবিটি দেখেছেন বলে জানিয়েছেন। যার ফলে অনেকেই ধারণা করেন তিনি কোনো সাধারণ প্রাণীকে ভালোভাবে চিহ্নিত না করার কারণেই হয়তো সিনেমায় দেখা ভিন্ন গ্রহের প্রাণীর মতো ভেবে বসেছিলেন।
চুপাকাবরা বিগফুট ও লকনেস মনস্টারের পরে এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত কল্পদানব। ঘটনাটি ইন্টারনেটের মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার কারণে রেডফোর্ড চুপাকাবরাকে ‘প্রথম ইন্টারনেট কল্পদানব’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
রেডফোর্ড তার অভিজ্ঞতা থেকে চুপাকাবরার রহস্যভেদকারী একটি বই লিখেছেন। ২০১১ সালে প্রকাশিত ট্র্যাকিং দ্য চুপাকাবরা: দ্য বিস্ট ইন ফ্যাক্ট, ফিকশন, অ্যান্ড ফোকলোর এই বইয়ে তিনি বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন চুপাকাবরার আদ্যোপান্ত।