
উপমহাদেশের প্রথম ছাত্র-যুব বিদ্রোহ। ছবি- সংগৃহীত
কোটা সংস্কারের দাবিতে যে ছাত্র আন্দোলনের জোয়ার শুরু হয়েছিল তারুণ্যের দুরন্ত শক্তিতে-তার শেষটা হয়েছে বহু প্রাণ আর রক্তের বিনিময়ে, ইন্টারনেটবিহীন কারফিউতে স্থবির হয়ে যাওয়া দেশে। এ দেশ যুগে যুগে অনেক ছাত্র আন্দোলনের সাক্ষী থেকেছে, একটু সহজ করে বললে ‘বিদ্রোহ’।
এ ভূখণ্ড সর্বপ্রথম যে ছাত্র-যুব বিদ্রোহের সাক্ষী হয়েছে তা সংঘটিত হয়েছে ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল, সংগ্রামের পুণ্য ভূমি বীর চট্টলা খ্যাত চট্টগ্রামে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অপশাসনে তখন রোজ পদদলিত হচ্ছে ভারতবাসী। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তথাকথিত নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চলছে দেশের প্রতিটি কোণে, তাদের পাশাপাশি গুপ্ত বিপ্লবী দলগুলোও স্বল্প সামর্থ্যে অস্ত্রের ভাষায় জবাব দিচ্ছে ইংরেজদের। ঠিক এমন সময় দীর্ঘ দুই বছরের গোপন প্রস্তুতি শেষে
ছাত্র-যুবদের কাছে মাস্টারদা নামে পরিচিত স্কুল শিক্ষক সূর্য সেনের নেতৃত্বে স্কুল-কলেজ পড়–য়া একদল কিশোর-তরুণ চট্টগ্রাম রেলওয়ে অস্ত্রাগার, দামপাড়া পুলিশ রিজার্ভ ব্যারাক আক্রমণ করে দখল করে নেয়। রেললাইন উপড়ে ফেলা এবং টেলিফোন-টেলিগ্রাফ অফিস ধ্বংস করাতে চট্টগ্রামের সঙ্গে সারা দেশের সব রকম যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়, ফলে চট্টগ্রাম চার দিন মুক্ত থাকে ব্রিটিশ শাসনের কবল থেকে।
সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে, মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে এই যুব বিদ্রোহে অংশ নেওয়া ৬৩ জন বিপ্লবীর অধিকাংশই রাইফেল চালাতে জানতেন না!
সূর্য সেনের দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন চট্টগ্রামের পূর্ণেন্দু দস্তিদার, কলকাতায় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুবাদে সেখানেই চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের অর্থ ও নতুন সদস্য সংগ্রহের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তার লেখা ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম’ বইতে বিপ্লবীদের রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণের বিষয়ে লিখেছেন, ‘বিপ্লবীরা বয়সে তরুণ। সর্বকনিষ্ঠের বয়স চৌদ্দ থেকে পনেরো। রাইফেল শিক্ষা তাদের ১৮ এপ্রিলের পূর্বে পাওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ বেসরকারি কোনো ব্যক্তিকে তখন রাইফেলের লাইসেন্স দেওয়া হতো না। বিপ্লবীদের অস্ত্রশিক্ষা সীমাবদ্ধ ছিল পিস্তল, রিভলবার, কার্তুজ বা গাদাবন্দুক আর বোমানিক্ষেপ শিক্ষার মধ্যে। ১৮ এপ্রিল রাতে পাহাড়তলী ও পুলিশ ব্যারাক অস্ত্রাগার দুটি দখল করার পরই এই ছাত্র ও যুবকদের নিয়ে গঠিত বিপ্লবী বাহিনীর রাইফেলের হাতেখড়ি হয়।’
এর পর জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধের আগে চার দিন অন্যান্য পাহাড়ে লুকিয়ে থাকার সময়ও তারা রাইফেল দিয়ে গুলি চালানোর কোনো অনুশীলন করতে পারেনি। কিন্তু সেদিন ইংরেজ বাহিনী যখন লুইস গান থেকে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করছিল তখন তীব্র দেশপ্রেম আর আত্মত্যাগের গভীর সংকল্পে এই বিপ্লবীরা রাইফেল চালানোর স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণকে সম্বল করে অসম এক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল।
জালালাবাদ পাহাড়ের অসম যুদ্ধে সম্পূর্ণ সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ইংরেজ বাহিনীর আনুমানিক সত্তর থেকে একশ জন সদস্য মারা যায়। অন্যদিকে বিপ্লবীরা অম্বিকা চক্রবর্তীসহ ১৩ জন সহযোদ্ধাকে মৃত ভেবে জালালাবাদ পাহাড়ে রেখে যায়। কিনÍ এদের মধ্যে অম্বিকা চক্রবর্তী, অর্ধেন্দু দস্তিদার ও মতি কানুনগো জীবিত ছিলেন। পরদিন ইংরেজ বাহিনী পাহাড়ে এসে মতি কানুনগো ও অর্ধেন্দু দস্তিদারকে আবারও গুলি করে, এতে মতি কানুনগো ঘটনাস্থলে এবং অর্ধেন্দু দস্তিদার হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। জ্ঞান ফিরলে ইংরেজ বাহিনী আসার শব্দ পেয়ে আহত অম্বিকা চক্রবর্তী ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে বেঁচে যান। এভাবেই উপমহাদেশের প্রথম ছাত্র-যুব বিদ্রোহের ইতি ঘটে। কিন্তু দশকের পর দশক ছাত্র-যুবরা যখনই সামগ্রিক অধিকার আদায়ের যৌক্তিক আন্দোলন তথা বিদ্রোহে অবতীর্ণ হয়েছে, চট্টগ্রামের ছাত্র-যুব বিদ্রোহ তাদের অনুপ্রেরণা হয়ে থেকেছে।