আয়নাঘর: এক ভয়ংকর গোপন কারাগার

আয়নাঘর। শুনতে সাদামাটা মনে হলেও এর পিছনে রয়েছে লোমহর্ষক নির্যাতনের ঘটনা ও হাজারো রহস্যের বেড়াজাল। এটা এমন এক স্থান যেখানে বন্দিদের নিয়ে চরম নির্যাতনের ঘটনা ঘটত। গণ-আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই শুরু হয় ‘আয়নাঘর’ নিয়ে চর্চা। 

শেখ হাসিনার শাসনামলে গুমের ঘটনা বিশেষভাবে পরিচিত ছিল। গুম হওয়া ব্যক্তিরা প্রত্যেকেই আওয়ামী সরকারের বিরোধিতা করেছিলেন এবং প্রকাশ্যে শেখ হাসিনার সমালোচনা করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ঠিক যেভাবে নাৎসি বাহিনী কর্তৃক জার্মানিতে বিরোধী পক্ষকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে আটক রাখা হতো, সেই আঙ্গিকেই  চলত আয়নাঘর, এমনটাই জানিয়েছেন সেখান থেকে বেরিয়ে আসা বন্দিরা। 

২০২৪ সালের হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনার পতন পর্যন্ত বাংলাদেশে ৬০০টিরও বেশি গুমের ঘটনা ঘটে। এদের সবাইকেই জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ ছিল। যাদের মধ্যে কিছু মানুষকে মুক্তি দেওয়া হয়, বেশ কিছু মানুষকে হত্যা করা হয় এবং খুব অল্প সংখ্যক মানুষকে  বিচারের জন্য আদালতে তোলা হয়। যাদের গ্রেপ্তার করা হয় তাদের খাতা কলমে কোনো তথ্য রাখা হতো না। আর যারা শেখ হাসিনার আস্থাভাজন ছিলেন তারাই আয়নাঘরের দায়িত্ব পেতেন। আয়নাঘরের বন্দিদের সঙ্গে তাদের পরিবারের সদস্যদের দেখা করা বা যোগাযোগের কোনো আইন ছিল না।

নেত্র নিউজের প্রতিবেদন 

২০২২ সালের ১৪ আগস্ট সুইডেন ভিত্তিক স্বাধীন নিউজ পোর্টাল ‘নেত্র নিউজ’ এক তদন্তমূলক প্রতিবেদনে প্রথম দাবি করে, ‘আয়নাঘর’ নামে এক গোপন কারাগারে আকস্মিকভাবে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মানুষদের আটক রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে। ‘নেত্র নিউজ’ সেই কারাগারের সম্ভাব্য অবস্থানও জানিয়েছিল। তাদের এই দাবির ভিত্তি হিসেবে তারা সেখানে ২০১৮ সালে আটক হাসিনুর রহমান এবং ২০১৬ সালে আটক থাকা শেখ মোহাম্মদ সেলিমের বয়ান প্রকাশ করে। 

নেত্র নিউজ সেই সময় বেশ কিছু ছবি প্রকাশ করে দাবি করে, সেগুলো ‘আয়নাঘর’-এর। তাদের দাবি, ছবিগুলো সেখানে কর্মরত সামরিক কর্মকর্তাদেরই তোলা। তারা আরও দাবি করে, বাংলাদেশের কাউন্টার-টেররিজম ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো এবং ডিজিএফআই ‘আয়নাঘর’-এর দায়িত্বে রয়েছে। নেত্র নিউজ জানায়, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার কোনো একটি ভবনে এই গোপন কারাগারটি তৈরি করা হয়েছে।

কী হয় আয়নাঘরে?

মনে করা হয় দেশে একাধিক আয়নাঘর আছে। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাউন্টার-টেররিজম ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি) দ্বারা পরিচালিত একটি আয়নাঘরে কমপক্ষে ১৬টি কক্ষ রয়েছে যেখানে একসঙ্গে ৩০ জন বন্দি রাখার সক্ষমতা রয়েছে।  এখানে সাউন্ডপ্রুফ ইনভেস্টিগেশন সেলে বন্দিদের নির্যাতন করা হতো। বাইরের আওয়াজ ভেতরে যেত না এবং ভেতরের আওয়াজ বাইরে যেত না। সেলে কোনো জানালা নেই, একটি উঁচু সিলিং ছিল যেখানে কেবল একটি আলো জ্বলত। জোরে শব্দ করে একটি বিশাল এক্সজস্ট ফ্যান চলত। এই ফ্যানের আওয়াজ ঘরের প্রতিটি শব্দকে ঢেকে দিত। তবে প্রতিদিন নিয়ম করে একটি সময়ে ৩০-৪০ মিনিট এই ফ্যানটি বন্ধ রাখা হতো। ওই সময় চাপা কান্নার আওয়াজ পাওয়া যেত বলে জানিয়েছেন সেখান থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিরা।

সম্প্রতি গোপন এই বন্দিশালা  থেকে মুক্ত হয়েছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বরখাস্ত) আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আহমাদ বিন কাসেম (আরমান)। মধ্যরাতে তাদের রাজধানীর দিয়াবাড়ীতে ছেড়ে দেওয়া হয়। দীর্ঘ ৮ বছর পর তারা মুক্ত হন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়  মানবতাবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে তাদের ‘আয়নাঘর’-এ আটকে রাখার অভিযোগ তোলেন। 

এদিকে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) কথিত আয়নাঘর থেকে মুক্তি পেয়েছেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) নেতা মাইকেল চাকমা। ইউপিডিএফ এ তথ্য জানিয়ে বলেছে, রাষ্ট্রীয় গুমের শিকার হওয়া ইউপিডিএফের সংগঠক মাইকেল চাকমা দীর্ঘ পাঁচ বছর তিন মাস পর অবরুদ্ধদশা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। আয়নাঘরে যারা বন্দি থেকেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ মোবাশ্বার হাসান, সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ কুমার রায়, কার্টুনিস্ট কবির কিশোরসহ আরও অনেকেই।

সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে ‘আয়নাঘর’ নিয়ে কথাবার্তা প্রকাশ্যে আসছে। বহু নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবারই আশা করছে, তারা ফিরে আসবেন। গত ৭ আগস্ট ডিজিএফআই সংবাদমাধ্যমকে জানায় যে, এই মুহূর্তে আর কোনো ব্যক্তি আটক নেই। 

২০১১ সালে আতাউর রহমান নামে মাদারীপুরের এক ব্যক্তি নিখোঁজ হয়ে যান। জাতীয় এক সংবাদমাধ্যমকে তার স্ত্রী নাদিরা সুলতানা জানান যে, তিনি তার স্বামীকে ফিরিয়ে আনতে চান। নাদিরার মতো বহু মানুষই এখন নিখোঁজ পরিজনের ফিরে আসার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। তবে তারা সকলেই জীবিত রয়েছেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //