Logo
×

Follow Us

অন্যান্য

প্রকৃতির দানবগর্ত সিংকহোল

Icon

এহতেশাম শোভন

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১০:১১

প্রকৃতির দানবগর্ত সিংকহোল

দেশে দেশে সিংকহোল। ছবি: সংগৃহীত

প্রকৃতিকে আমরা যতটা সুন্দর রূপে দেখি মাঝে মাঝে তার ততটাই ভয়ঙ্কর রূপ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাধ্যমে ফুটে ওঠে। প্রকৃতি প্রায়শই এমন বিরূপ আচরণ করে যে তার প্রতিফলন দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। তেমনই একটি বিষয় হচ্ছে সিংকহোল। যাকে অনেকেই প্রকৃতির দানবগর্ত বলে থাকে। প্রকৃতিতে সৃষ্টি হওয়া রহস্যময় ঘটনাগুলোর মধ্যে সিংকহোল অন্যতম একটি। সিংকহোল মূলত প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হওয়া এক ধরনের গর্ত। কোনো স্থানের মাটি হঠাৎ দেবে গিয়ে একটি বিশাল গর্ত সৃষ্টি হয়ে যাওয়ার ঘটনাটাকেই সিংকহোল বলে।  

যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্য মতে, সিংকহোল প্রকৃতিতে হঠাৎ করে সৃষ্টি হওয়া একটি বিশালাকার গর্ত। কোনো ধরনের পূর্বাভাস ছাড়াই সিংকহোল সৃষ্টি হতে পারে। যার ব্যাস কয়েক ফুট থেকে কয়েক শত ফুট পর্যন্ত হতে পারে। ধারণা করা হয়, দৈত্যাকার সিংকহোল যার গভীরতা প্রায় ২০০০ ফুট। এর ভিতরে দুটি আইফেল টাওয়ার অনায়াসেই ঢুকে যেতে পারে।  

বিভিন্ন সময়ে সিংকহোল নামক প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিভিন্ন দেশে দেখা দিয়েছে। সিংকহোল আজ থেকে প্রায় শত বছর আগেও ছিল; কিন্তু তখন এটি এতটা ভয়াবহ আকারে ছিল না। সম্প্রতি ঝড়-বৃষ্টি, ভূমিধ্বসের মতো বিভিন্ন দেশে সিংকহোলের পরিমাণ বাড়ছে। সিংকহোল যে কোনো জায়গায় হতে পারে। সেটি সাগরের তলদেশে যেমন হতে পারে; তেমনি রাস্তা, খেলার মাঠ, ফসলি জমি কিংবা জনবসতিপূর্ণ এলাকায়ও হতে পারে। পৃথিবীর যে সকল স্থানে সিংকহোল হওয়ার প্রবণতা বেশি সেসব স্থানের একটা নাম আছে। এদেরকে বলে karst terrain। 

দেশে দেশে সিংকহোল

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সিংকহোল তৈরি হয় যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে। এর পরের অবস্থানেই তুরস্কের কোনিয়া। মাত্র এক বছরে দ্বিগুণ হয়েছে দেশটির দানবগর্ত। সম্প্রতি সেখানে সন্ধান মিলেছে ৬ শতাধিক সিংকহোলের। চীন আর রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চলেও বিশালাকার গর্ত আছে বেশ কিছু। জানা গেছে, একেক এলাকায় সিংকহোলের আকার বা গভীরতা একেক রকম। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সিংকহোলের সন্ধান পাওয়া গেছে সাইবেরিয়ায়। সেখানে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তৈরি হয়েছে এমন দানবগর্ত।

উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, বর্তমানে সবচেয়ে বড় ও গভীর সিংকহোলের একটি রয়েছে চীনে যার প্রস্থ ১৭৬২ ফুট এবং এর গভীরতা প্রায় ২২০০ ফুট। ৩০ মে ২০১০ সালে গুয়েতামালা সিটিতে প্রায় ৬৫ ফুট প্রস্থের এবং প্রায় ৩০০ ফুট গভীরতার একটি সিংকহোল সৃষ্টি হয় যা একটি তিনতলা বাড়িকে পুরোপুরি গিলে নেয়। এতে ১৫ জন নিহত হয়। ২০০৭ সালে গুয়েতামালা সিটিতে ৩৩০ ফুট গভীর একটি সিংকহোল তৈরি হয়েছিল। ২০১৬ সালে ফ্লোরেন্সের আর্নো নদীর তীরে ৭০০ ফুট গভীর একটি সিংকহোল দেখা গিয়েছিল। সম্প্রতি চিলিতে Tierra Amarilla নামক যে সিংকহোলটি দেখা গেছে তার গভীরতাও প্রায় সাতশ ফুট।

The Great Blue Hole নামক আরেকটি গভীর সিংকহোল আছে মধ্য আমেরিকার দেশ বেনিজে। এটি ১০৪৩ ফুট ব্যাসের ৪০৭ ফুট গভীর একটি সিংকহোল যা প্রাকৃতিকভাবেই সৃষ্টি হয়েছিল।  কয়েক বছর আগে এক ভূমিকম্পের পর একশর বেশি সিংকহোল তৈরি হয় ক্রোয়েশিয়ায়। এ ছাড়া তুরস্ক, ইতালি, মেক্সিকো, ইসরায়েলের পর ভারতেও তৈরি হয়েছে সিংকহোল। চুকুইচামাতা সিংকহোলটি চিলিতে অবস্থিত। এটি এখন কপার খনি হিসেবে ব্যবহার হয়। ২৭৯০ ফুট গভীর সিংকহোলটি সৃষ্টি হয়েছে ১৯১০ সালে।

চীনের জিয়াঝাই তিয়ানকেং হচ্ছে সবচেয়ে গভীরতম সিংকহোল, যার গভীরতা ৬৬২ মিটার এবং প্রশস্ততা ৬২৬ মিটার।  বাহামাসের লং আইল্যান্ডে ডিনস ব্লু হোল অন্যতম বড় একটি সিংকহোল। এর গভীরতা ৬৫০ ফুট। 

সম্প্রতি চীনের লেই কাউন্টিতে আবিষ্কৃত হয়েছে ১৯২ মিটার গভীর একটি সিংকহোল। গবেষকরা ধারণা করছেন, এই দানবীয় গর্তের মধ্যে রয়েছে অন্য আরেকটি দুনিয়া। সেখানে থাকতে পারে প্রাগৈতিহাসিক এবং অচেনা অনেক প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ। দক্ষিণ চীনের গুয়াংশি ঝুয়াং অঞ্চলের কাছেই অবস্থিত এই সিংকহোলটি আবিষ্কার করেছেন অভিযাত্রীরা। এই সিংকহোলের আছে নিজস্ব একটি বন। গত ৬ মে সেই বনে অভিযান চালান চেন লিকশিন নামের এক অভিযাত্রী। এই বিশাল গর্তটি ভেতরে ৩০৬ মিটার লম্বা এবং ১৫০ মিটার প্রস্থের। এর ভেতরে আরও তিনটি গুহা খুঁজে পেয়েছেন অভিযাত্রীরা। এর মধ্যে আছে অনেক প্রাচীন গাছ যা ৪০ মিটার লম্বা!

কীভাবে তৈরি হয় সিংকহোল?

যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস বলছে, সিংকহোল প্রকৃতিতে হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া বিশালাকার গর্ত। সাধারণত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হলে মাটির অভ্যন্তরে ফাঁপা জায়গা তৈরি হয়। এরপর বৃষ্টি হলে মাটির উপরিতলের পানি মাটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এরপর সেখানে একটি স্তরে পানি জমা থাকে। সেই পানি কোনো কারণে উত্তোলন করা হলে, নিচের স্তরের মাটি ভূমির উপরের চাপ নিতে পারে না। তখনই উপরিভাগের মাটি ধসে তৈরি হয় বিশালাকার গর্ত। 

তবে শুধু পানি উত্তোলনের জন্য নয়, যেসব এলাকায় মাটির অভ্যন্তরে কঠিন শিলা রয়েছে সেখানে মাটির উপরিভাগের পানি নিচে প্রবেশ করে। সেখানে থাকে লবণ, চুনাপাথর, কপার ও জিপসামের মতো খনিজের স্তর। এসব স্তরের খনিজ তোলা হলেও মাটির অভ্যন্তরে ফাঁপা জায়গা তৈরি হতে থাকে। এরপর নির্দিষ্ট সেই এলাকায় মাটি ধসে তৈরি হয় সিংকহোল। 

সিংকহোল সাধারণত দুটি প্রক্রিয়ায় হয়ে থাকে। প্রথমটি কার্স্ট প্রসেস (বিভিন্ন আকরিক শিলার রাসায়নিক ভাঙন), অপরটি সাফোসন প্রসেস (একটি ভৌগোলিক প্রক্রিয়া যেখানে পানি কিংবা অন্য কোনো তরল পদার্থের কারণে ভূগর্ভস্থ মাটি বা শিলা ক্ষয় হয়ে সরে যায়)।  তবে কোনো এলাকার মাটির গঠন বিশ্লেষণ করে, ঐ এলাকায় সিংকহোল হওয়ার আশঙ্কা কতটুকু তা যাচাই করা যায়। 

সিংকহোল তৈরির কারণ?

প্রকৃতিতে হঠাৎ সিংকহোল তৈরির ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু সংকটের সরাসরি প্রভাবের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সিংকহোল সৃষ্টিতে দায়ী কারণগুলোর মাঝে রয়েছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, তীব্র খরা, মাটি ক্ষয়, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, মিথেন গ্যাসের প্রভাবসহ মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক আরও কারণ। অপরিকল্পিত ভূগর্ভস্থ সুয়ারেজ লাইন বা মাটির নিচে নির্মাণ কাজকেই মনে করা হচ্ছে শহরে সিংকহোল বৃদ্ধির কারণ।

কয়েক দশক, এমনকি শতাব্দী লাগে একটি সিংকহোল তৈরি হতে। তবে প্রকৃতিতে এমন দানবীয় গর্ত তৈরির ঘটনা নতুন নয়। যুগে যুগে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা গেছে বিভিন্ন দেশে। তবে সম্প্রতি অনেকটা বেড়েছে এর হার।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫