প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ: এক দেশপ্রেমিকের প্রতিকৃতি

মফিজুর রহমান লালটু
প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২৪, ১৫:৩২

শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। ইলাস্ট্রেশন: দেশকাল পত্রিকা
তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ মারা গেছেন। আজ শুক্রবার (৯ আগস্ট) বাংলাদেশ সময় সকাল ৬টায় যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর। গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আন্দোলনে শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ঐতিহাসিক ও অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছেন। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী কণ্ঠ হারালো।
প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে নিয়ে তথ্যনির্ভর এই লেখাটি ত্রৈমাসিক দেশকাল পত্রিকার ২য় বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৯ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। সেটি হবহু তুলে ধরা হলো:
শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ- ফার্মগেটের এক আটপৌরে অফিসে বসে কাজ করেন। নাম শহীদুল্লাহ অ্যান্ড নিউ অ্যাসোসিয়েটস্। দেশের নামি নির্মাণ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। অফিসে এসির ব্যবস্থা নেই। তার বাড়িতেও নেই। ইচ্ছা করলেই লাগাতে পারেন- লাগাননি। খরচ করার আর্থিক স্বচ্ছলতা তাঁর আছে। এমনটাও নয় যে তিনি কৃপণ। বরং এর উল্টোটাই সত্যি- আর্থিক ব্যাপারে খুবই উদার। বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং এ জাতীয় কর্মকাণ্ডে তার মতো উদারহস্তে সহযোগিতা করার লোক এদেশে কমই আছে। এসির ব্যবস্থা কেন করেন না- এ প্রশ্নে তিনি বললেন, 'দেশের জনগণ এসির বেনিফিট পায় না। এসি ব্যবহার না করলে আমার কিছু কষ্ট হয় বটে, কিন্তু এর মধ্য দিয়ে সাধারণ জনগণ যেভাবে জীবনযাপন করেন তার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করি।'
চলতি বছরের (২০১৯) ৩১ জুলাই তাঁর বয়স ৮৮ পূর্ণ হলো। ক'দিন আগে পর্যন্ত তিনি তাঁর বাসা মহাখালী অথবা আসাদ গেট থেকে হেঁটেই নিয়মিত অফিসে আসতেন বেশ সকালে। তাঁর ব্যক্তিগত এবং অফিসের গাড়ি আছে। কাজের প্রয়োজনে এমনকি সাংগঠনিক কাজেও সেগুলো ব্যবহার করতে দেন অবলীলায়। তিনি শরীরের প্রতি যেমন যত্নশীল, তেমনি ভীষণরকম কষ্টসহিষ্ণু, আত্মবিশ্বাসী। কঠোর নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলেন। পায়ের ব্যথার কারণে আগের মতো হাঁটতে পারেন না, ধীরে ধীরে হাঁটেন, তবুও হেঁটেই অফিসে আসতেন সময়মতো। সম্প্রতি অফিসে পড়ে গিয়ে অচেতন হয়ে পড়েন এবং আরও বেশি দুর্বল ও অসুস্থ হওয়ার কারণে নিতান্ত বাধ্য হয়ে গাড়িতে করে অফিসে আসেন। পেশাগতভাবে অসাধারণ মেধাবী এবং শতভাগ সৎ এক অনন্য ব্যক্তিত্ব শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। মাটির ছোঁয়া তাঁর জীবনাচরণে। পোশাক-আশাক-খাদ্যসহ অতি সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত নিরহংকারী এই গুণী পেশাগত উৎকর্ষতায়ও দেশের শীর্ষস্থানে পৌঁছেছেন। তাঁর আপসহীন সততার জন্য প্রতিষ্ঠানের কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে যেমন নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছেন, আবার পেশাগত বিশেষ যোগ্যতার কারণে বহু কাজ এমনিতেই তাঁর কাছে উপস্থিত হয়েছে। তাঁর ভাষায়- 'আমার জীবনের প্রধান ব্রত হচ্ছে সততা, যাকে আদর্শ বলে জানি, সেই আদর্শ অনুসরণ এবং তার জন্য সংগ্রাম। এই আদর্শের জন্য সংগ্রাম আমার চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য।'
পেশাগতভাবে উৎকর্ষিত শহীদুল্লাহ জাতীয় সংকটে হাতগুটিয়ে বসে থাকেননি। দেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন, তেল-গ্যাস-প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার আন্দোলনসহ নানা রাজনৈতিক আন্দোলনে সামনে থেকে লড়েছেন। জেল খেটেছেন, কিন্তু অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার করেননি, আপস করেননি। একেবারে ছাত্রজীবন থেকেই তিনি এই আদর্শে বড় হয়েছেন। কথা কম বলেন, বিশ্বাসী তিনি কাজে। ২০০২ সালের ২৩ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে পুলিশ ঢুকে ছাত্রীদের ওপর হামলা ও নির্যাতন চালায়। এই ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হয়ে ওঠে। আন্দোলনকারীরা ভিসি-প্রক্টরের পদত্যাগ, হামলাকারী দোষী পুলিশের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, ছাত্রীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যহার, শামসুন্নাহার হলে অবৈধভাবে দখলকৃত ছাত্রদল নেত্রীসহ বহিরাগতদের হল থেকে বহিষ্কার, বৈধ শিক্ষার্থীদের হলে সিট নিশ্চিত করা, প্রক্টরিয়াল আইন সংশোধন এবং অনুমতি ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ- এই ৭ দফা দাবি উত্থাপন করে। এই দুর্বার আন্দোলনের তৃতীয় দিন বিকাল থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা অবস্থান ও অনশন শুরু করে। এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সংগ্রাম ছিল এটি। তৎকালীন সরকারি বা বিরোধীদলীয় কোনো ছাত্র সংগঠন এ আন্দোলনে ঢুকতে পারেনি। অনেকেই উপস্থিত হয়ে সংহতি জানিয়েছেন। কিন্তু মঞ্চে এসে বক্তব্য প্রদানের সুযোগ পাননি। তারানা হালিম, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, আব্দুস সামাদ আজাদ, মতিয়া চৌধুরীরা এসেছিলেন অনশনরতদের দেখতে। মাইকে কথা বলার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেও সুযোগ পাননি। ছাত্রলীগের চাপ প্রয়োগেও কাজ হয়নি। ইডেন কলেজ, ঢাকা কলেজ, মিরপুর বাংলা কলেজসহ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল নিয়ে সংহতি জানিয়েছে। ঢাকা মেডিকেলের ডাক্তার ও শিক্ষার্থীরা চিকিৎসা কাজে প্রভূত সহযোগিতা করেছিলেন। বিদেশ থেকে অনেক সংহতি বার্তা এসেছে। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের মনোযোগ তখন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। শহীদ মিনারের উন্মুক্ত প্রান্তরে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বেশ কয়েকজন ছাত্রী অবস্থান করছেন। অবস্থান ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিন রাত ১০টার দিকে শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ শহীদ মিনারে আসলেন। কারো সঙ্গে তেমন কথা বললেন না। শহীদ বেদির এক পাশে বসে থাকলেন।রাত আরও বাড়লে মেঝেতে শুয়ে পড়লেন। সারারাত তিনি সেখানে থাকলেন। মনে হলো অভিভাবক হিসেবে তিনি মেয়েদের পাহারা দিলেন। সকালে চলে গেলেন। ছাত্রীরা সেখানে ৩/৪ দিন অবস্থান ও অনশনে ছিলেন। শিক্ষক- রাজনীতিকসহ সমাজের নানান্তরের লোকজন এসেছেন, সংহতি জানিয়েছেন, কিন্তু প্রকৌশলী শহীদুল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ সারারাত শহীদ মিনারে থাকেননি। যারা ছিলেন তারা ছাত্র-সাংস্কৃতিক নেতা-কর্মী, আন্দোলনের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কিত বা তাদের কেউ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। কথায় নয়, কাজের ভেতর দিয়েই তিনি তাঁর বিবেকের দায়বদ্ধতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার প্রমাণ দেন। তিনি যা বিশ্বাস করেন, সততার সঙ্গে সেই কাজ করেন- অকপটে তা বলেন, এমন কি ঝুঁকি হলেও। বিশ বছরের অধিক সময় তিনি বাংলাদেশের তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ তথা প্রাণ- প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। এই বয়সেও অসুস্থ শরীর নিয়ে সভাগুলোতে হাজির থাকেন। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় এক অনন্য ব্যক্তিত্ব শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। সম্প্রতি এই লেখকের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় তিনি তাঁর জীবনের বহু জানা-অজানা কথা তুলে ধরেছেন।
শৈশব- বেড়ে ওঠার গল্প
শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৩১ সালের ৩১ জুলাই খুলনার দৌলতপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শেখ মুহাম্মদ হানিফ ছিলেন দৌলতপুর মহসিন স্কুলের শিক্ষক। পিতা সম্পর্কে শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, 'তিনি আমার ক্লাসের শিক্ষক নন শুধু, জীবনেরও শিক্ষক। তিনি ছিলেন মেধাবী, সৎ, নির্মোহ, অধ্যবসায়ী, নিরহংকারী, কর্তব্যপরায়ণ ব্যক্তি। তাঁর আদর্শই গ্রহণ করেছি আমি। আমার যৎকিঞ্চিত মেধা, সততা, অধ্যবসায়- তাঁর কাছ থেকেই পেয়েছি উত্তরাধিকার সূত্রে। ওটাই আমার বড় পুঁজি। আমি বলব তিনি আমার জীবনের প্রথম ভিত্তি রচনা করেছেন। তারপর নিজে যা গঠন করেছি, সেটা সেই ভিত্তি থেকে এবং আমার নিজের পরিশ্রম থেকে। ফ্রেন্ডস, ফিলোসোফার ও গাইড বলতে যা বোঝায়, আমার বাবা ছিলেন তা-ই। তিনি সব সময় আমাদের অর্থাৎ আমি ও আমার বড় ভাইকে প্রকৃত মানুষ করার চেষ্টা করেছেন। আমার বড় ভাই ৩৫ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।'
তিনি বলে চলেন- 'ছোটবেলায় তিনি কোথাও গেলে আমাদের সঙ্গে নিতেন এবং আরও নিতেন তখনকার দিনের একটা উৎকৃষ্ট ইংরেজি গ্রামার বই- নেসফিল্ডের গ্রামার বই। এই বই থেকে ইংরেজি ভাষার গ্রামার আমাদের রপ্ত করাতেন। আর একটা জিনিস করাতেন, সেটা হলো- ক্যালেন্ডার চেক করা। আজকে এই তারিখ, এত বছর পর এই দিনে কত তারিখ হবে ইত্যাদি। এগুলো নির্ণয় করার পদ্ধতি মুখে মুখে বের করা। যেটি তিনি শিখিয়েছিলেন সেটি চেক করাতেন। এগুলো দেখে আমরা অবাক হয়ে যেতাম। বাড়িতে আমাদের ফ্যান ছিল না, খুব কাছে ঈদগাহ ছিল, শান বাঁধানো। এই সুবিধার কারণে তিনি গরম কালে আমাদের এই শান বাঁধানো ঈদগাহে নিয়ে যেতেন। এখানে যথেষ্ট ঠাণ্ডা ও খোলা বাতাস ছিল। পাটি পেতে পড়াশোনা করাতে করাতে তিনি ঘুমিয়ে যেতেন। কিন্তু আমরা অনেকক্ষণ পড়াশোনা করতাম। এটুকু বললাম এজন্য যে, তিনি কীভাবে আমাদের কোলে-পিঠে মানুষ করেছেন, পড়াশোনার জন্য চেষ্টা করছেন, তার অভিভাবকত্বে কীভাবে আমরা মানুষ হয়েছি- এটা বোঝানোর জন্য। আমাদের বাড়ি থেকে দেড় মাইল দূরে দেয়ানা গ্রামে প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন আমার চাচা শেখ ইসমাইল হোসেন। তিনিও শিক্ষাদরদী। পল্লীকবি হিসেবে তার খ্যাতি ছিল। প্রতিদিন তার সঙ্গে হেঁটে স্কুলে যেতাম ও আসতাম।' শৈশব থেকেই কষ্টসহিষ্ণু, পরিশ্রমী শেখ শহীদুল্লাহ বলেন, 'ছোটবেলা থেকেই আমি অসম্ভব দৈহিক পরিশ্রমে অভ্যন্ত ছিলাম। মা মরিয়ম খাতুন ছিলেন গ্যাসট্রিক আলসারের রোগী। বেশি কাজ করতে পারতেন না। মাঝে মাঝে কলকাতা যেতেন চিকিৎসা করাতে। সে সময় খুলনা থেকে কলকাতা যেতে ৪ ঘণ্টা লাগতো। অসুস্থতার কারণে মাকে সবসময় সাহায্য করতাম। রান্না-বান্না, ছাই দিয়ে থালাবাটি পরিস্কার করা, কোয়ার্টার মাইল দূরের টিউব ওয়েল থেকে কাঁধে করে খাবার পানি আনা, এগুলো করতাম। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ওয়াশিং সোডা দিয়ে লোহার কড়াইয়ে কাপড় সেদ্ধ করে সেগুলো পুকুরে নিয়ে তক্তার ওপর কাচার কাজটি আমি করতাম। বিএসসি পাশ করা পর্যন্ত আমি বাড়ির সব কাজ করেছি। আবার আব্বার কাজেও কিছু সহযোগিতা করতাম। বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগানো, মরিচের চারা লাগানো, যত্ন করা, এগুলো করতাম। বাড়ি থেকে আধা মাইল দূরে আমাদের একটা খেজুর বাগান ছিল। শীতের সময় এই গাছ অন্যেরা ভাগে করতো, রস অর্ধেক ভাগা ভাগি হতো। কোন দিন খেজুর গাছ কাটবে, সেটা পাহারা দেয়া থেকে সেখান থেকে ভোরবেলা রস আনা ইত্যাদি আমি করতাম। তখন আমার বয়স ৮/৯ বছর হবে। ছোটবেলায় কত যে কঠিন কাজ করেছি সেটা বলার নয়। বাবার শিক্ষকতার ব্যস্ততা, অসুস্থতার জন্য মাকে নিয়ে ঘনঘন কলকাতা যাওয়া এসব কারণে আমাকে পারিবারিক কাজ করতে হতো। এমনও হয়েছে, পরীক্ষার দিনও নিজে রান্না- বান্না করতে হয়েছে। একেবারে ছোটবেলা থেকে পরিশ্রম, অধ্যবসায়, কষ্ট সহিষ্ণুতা, নিয়মানুবর্তিতা এগুলোর যথেষ্ট ট্রেনিং হয়েছে। চাই আর না চাই, কষ্টসহিষ্ণুতা একটা বিরাট বড় অভ্যাস। অধ্যবসায় আমি বাবার কাছ থেকে পেয়েছি। তার চরিত্র আমার মধ্যে ট্রান্সফার হয়েছে। দিয়ানা প্রাইমারি স্কুলে ইনফ্যান্ট থেকে ক্লাস টু পর্যন্ত পড়েছি। এরপর বাড়ির কাছাকাছি ব্রজলাল কলেজের পাশে দৌলতপুর মহসিন ইংলিশ হাই স্কুলে ভর্তি হলাম। মহসিন স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ক্লাশে প্রতিবার আমি অথবা আমার ভাই ফার্স্ট অথবা সেকেন্ড হতাম। আমরা দুই ভাই একই ক্লাসে পড়তাম। একই বই (এক সেট) পড়তাম। এতে আব্বার পড়াতে সুবিধা হয়, একই বই দুই ছাত্রকে পড়ানো, দ্বিতীয়ত খরচও কম হয়। সে সময় রাত ১০টা পর্যন্ত কেউ জাগতো না, আমরা রাত ১২টা পর্যন্ত পড়তাম। আবার ভোরে আব্বা ডাকতেন। সকালে উঠে আবার আমাদের পড়তে হতো। আমি ক্লাসে দু'বার ডবল প্রমোশন পেয়েছিলাম।'
আইএসসি পর্যন্ত তাঁরা দুই ভাই এক সঙ্গে পড়েছেন। তারপর বড়ভাই চলে যান ঢাকায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি (সি.এ) পড়ার জন্য। একই সঙ্গে পাশ করলেও এবং দুজনকে ঢাকায় পড়ানোর ইচ্ছা থাকলেও আর্থিক সামর্থ্য না থাকার কারণে শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ খুলনায় থেকে গেলেন। ১৪ বছর ৭ মাস বয়সে ১৯৪৬ সালে প্রথম শ্রেণিতে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন এবং ১৯৪৮ সালে আইএসসি পরীক্ষায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৯তম স্থান আর ১৯৫০ সালে বিএসসিতে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন।
শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলতে থাকলেন- 'বাবার ইচ্ছা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হবে। আমাদের বাড়ি যশোর-খুলনা সড়কের ওপর দৌলতপুরে। বাবা দেখতেন জেলার পিডব্লিউডির নির্বাহী প্রকৌশলী গাড়িতে করে খুলনা থেকে সড়ক পথে আসা-যাওয়া করেন। নির্বাহী প্রকৌশলীর এই গাড়ি যাত্রা বাবাকে খুব আকৃষ্ট করে। ইঞ্জিনিয়ার না হয় ডাক্তার হতে হবে। এটাই তাঁর পছন্দ ছিল। বাবা ডাক্তারের চাইতে ইঞ্জিনিয়ার বেশি পছন্দ করলেন। কেননা, দৌলতপুর বাজারে পাঁচজন ডাক্তার ছিলেন, সবাই হিন্দু। কলকাতা থেকে এমবিবিএস পাশ করে এসেছেন। কিন্তু ওই সময় ৩০ মাইল দূরত্বের মধ্যে কেউ বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন না, হিন্দু হোক বা মুসলমান হোক। তাই এ বিষয়ে বাবার একটা মোহ ছিল। বাবা নিজেই ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তির ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়ে ফরম যোগাড় করেন।'
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি, অতঃপর
১৯৫০ সালে তৎকালীন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রথম হয়েছিলেন। সে সময় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তির জন্য লিখিত ও ভাইভা পরীক্ষা হতো। শিক্ষকরা ভাইভা পরীক্ষায় যে সব প্রশ্ন করেন এত বছর পরও তাঁর পরিষ্কার মনে আছে- 'তখন আমার মাত্র দুটো কাপড়ের সেট পাঞ্জাবি-পায়জামা। শীতকালে একটা চাদর। ভাইভাতে পাঞ্জাবি-পায়জামা পরেই গিয়েছি।' শিক্ষকের প্রশ্ন- তুমি এই পোশাকে কেন? বললাম, My parents cannot afford better dress than this. My father is a poor school teacher, I am here to fulfil his ambition of seeing me become an engineer. পরীক্ষকরা মনে হয় খুশি হলেন। 'তারপর একটা প্রশ্ন করলেন- How to build a road? এটা আমার জানা ছিল। প্র্যাকটিক্যাল কাজের অভিজ্ঞতাও ছিল। আমাদের বাড়ীর পাশে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে একটা রাস্তা তৈরিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলাম। সামাজিক কাজ হিসেবেই। কয়েকজন বন্ধু মিলে সে কাজ করেছিলাম। আবার যশোর-খুলনা মহাসড়ক তৈরির সময় দেখেছিলাম কিভাবে ভাঙা ইট বিছিয়ে তার ওপর রোলার টেনে রাস্তা শক্ত করা হয়। যা জানি তাই বললাম। তাঁরা খুশি হলেন। তখন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ছিল সবচেয়ে পছন্দের, কারণ এ বিভাগে চাকরি কনফার্ম। চাকরি প্রাপ্তির ব্যাপারে সিভিলের পরে ছিল ইলেকট্রিক্যাল, তারপরে ছিল মেকানিক্যাল তারপর ক্যমিক্যাল। এখন তো সিভিল অনেক পেছনে। সরকারি চাকরি না পেলেও স্ব-উদ্যোগে কিছু করা যায়। তাই দরিদ্র পরিবারের ছাত্ররা যাদের নিশ্চিত চাকরি প্রয়োজন, তারা সাধারণত সিভিল বিভাগে ঢুকতেন তখনকার দিনে। 'ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হলাম। আর্থিক সংকট প্রকট। খুব অল্প খরচে চলতাম। নাস্তা হিসেবে আখের গুড় দিয়ে ছোলা খেতাম। সে সময় সৈয়দপুর মহসীন এস্টেট নামে একটা ফান্ড থেকে খুলনার মেধাবী ছাত্রদের জন্য বৃত্তি দেওয়া হতো। বাবার চেষ্টায় মহসিন এস্টেট ফান্ড থেকে মাসিক ২৫ টাকা বৃত্তির ব্যবস্থা হলো। আর আমি মেরিট স্কলারশিপ পেয়েছিলাম মাসিক ২৫ টাকা। মোট ৫০ টাকায় কোনরকম চালানো যেত।'
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার সময় দুবার বহিষ্কারের সম্মুখীন হয়েছেন শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। কারণও বেশ মজার। দু'বারই তাঁর কোনো দোষ ছিল না। নানা অযৌক্তিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত শর্তও আরোপ করা হয়েছে তার ওপর। কিন্তু নৈতিকভাবে অটল থেকেছেন শর্তের কাছে পরাভূত হননি।
অংক আর স্মৃতিশক্তির জোর
শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী। বিশেষ করে অংকে তাঁর পারদর্শিতা অনন্য। অনেক সহপাঠীকে তিনি লেখাপড়ায় সহযোগিতা করেছেন। অংকের বিষয়ে কলেজে তাঁর বেশ নাম-ডাক ছিল। নানা ঘটনাও ঘটেছে। শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তেমন একটি ঘটনার কথা বললেন- 'আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের একজন অবাঙালি ছাত্র, যিনি অংকে নিজেকে খুব ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন বলে দাবি করতেন, বিশেষত মানসাংকের ব্যাপারে। তিনি একদিন আমাকে চ্যালেঞ্জ দিলেন। আমি বললাম- ঠিক আছে, আমি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করি না, আমি এমনি যা পারি তা-ই দেখাব। তার আগে আমি জানতাম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সোমেন বাবু নামে একজন ব্যক্তি নব্বই অংকের দুটি সংখ্যার গুণ করেছিলেন মধ্যবর্তী কোনো অংককষা ছাড়াই। সরাসরি বসিয়ে ছিলেন গুণফলটা। আমি বললাম আমি ষোল (১৬) অংক পর্যন্ত পারব। যোল অংকের যে কোনো সংখ্যার সঙ্গে ষোল অংকের অন্য যে কোনো সংখ্যার গুণফল মধ্যবর্তী কোনো লেখালেখি ছাড়াই সরাসরি বসিয়ে দিতে পারব। আপনি কতদূর পারবেন? তিনি হার স্বীকার করলেন। তার দৌড় খুব বেশি নয়, দুটি পাঁচ অংকের সংখ্যার গুণফল পর্যন্ত। বড় গুণফল লিখে যাবার একটি কৌশল আছে কঠিন নয় মোটেই। ওই কৌশলটি ও স্মৃতিতে অনেক অপারেশন ধরে রাখতে পারলে বড় সংখ্যার গুণ মুখে মুখে করার মধ্যে চমকপ্রদ কিছু নেই। আমার স্মরণশক্তি খুব ভালো ছিল। সাধারণত একবার দেখলেই মনে থাকত। আমি থাকতাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মেইন হোস্টেলে। আমাদের সিভিল ডিপার্টমেন্ট শুধু নয়, অন্য বিভাগের (ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল, কেমিক্যাল) ছাত্ররাও আমার কাছ থেকে তাদের কঠিন অংক করিয়ে নিয়ে যেতেন। ক'বছর আগে আমরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অনেক বন্ধু একত্র হয়েছিলাম- এতকাল পরেও সেখানে এই কথাটি তারা আলোচনা করেছে। আমার রুমমেট সিলেটের আইয়ুবুর রহমান চৌধুরী রোডস অ্যান্ড হাইওয়েতে যোগদান করেছিলেন এবং পরে বাংলাদেশের প্রথম প্রকৌশলী সচিব হয়েছিলেন। পরীক্ষার আগের দিন আমি আগে ঘুমিয়ে যেতাম। আমি কোনো সময় রাত জাগতাম না। আইয়ুবুর রহমান রাত জাগতেন। শুধু আইয়ুবুর রহমান নয়, হোস্টেলের সবাই পরীক্ষার আগের দিন রাত জাগতেন।
আর্থিক অস্বচ্ছলতা, ছাত্রজীবনে বিয়ে
শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ অর্থিক অনটনের কারণে তৃতীয় বর্ষে উঠে বিয়ে করতে বাধ্য হলেন। যদিও তখন তিনি মেরিট স্কলারশিপ ও অন্য একটি বৃত্তি পেতেন। ফ্রি স্টুডেন্টশিপ ছিল, বেতন দেওয়া লাগতো না, তা সত্ত্বেও তার বাবা পড়ার খরচ বহন করতে পারছিলেন না। শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন- 'ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের হলে মেস সিস্টেম ছিল। ছাত্রদের মধ্য থেকে ম্যানেজারের দায়িত্ব পড়তো, মাঝে মাঝে বদল হতো। মেস ক্লার্ক ছিলেন হারেস, তিনি পরখ করে দেখেন যে, আমার হিসাবে কোনো গণ্ডগোল নেই। আয়-ব্যায়ের প্রতিটি পয়সার হিসাব আছে নিখুঁতভাবে। তিনি তো দেখে অবাক, আগের ম্যানেজার তো এভাবে করতো না। কিছু টাকা মারার জন্য বেশি বেশি লিখতো। It is beyond my comprehention যে, আমি মেসের টাকা গণ্ডগোল করব। মেসের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন একজন প্রফেসর। একথা মেস ক্লার্ক প্রফেসরকে বললেন 'অসাধারণ সৎ একটা ছেলে পাওয়া গেছে। আগের যেসব ছাত্র মেস ম্যানেজার হয়েছে, তার থেকে আলাদা। কোনো পয়সা এদিক-ওদিক নেই। এই ছেলেটা সৎ এবং মেধাবী। এটা একেবারেই রেয়ার।' হারিস সাহেব আমার খোঁজখবর নিলেন। হারিস সাহেবের মাধ্যমে বিয়ের প্রস্তাব আসলো। আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের একজন শিক্ষক, তার নাম কবীর উদ্দীন মণ্ডল- তার একটা মেয়ে আছে। আমি বিয়ে করতে রাজি কি না। আর্থিক সুবিধা দিবেন, কত তাও বলে দিলেন। বাবাকে জানালাম তিনি রাজি হলেন, আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। থার্ড ইয়ার-ফোর্থ ইয়ার চলল। রেজাল্ট বের হলো। ফার্স্টক্লাস ফাস্ট উইথ্ অনার্স। ৭৫% এর বেশি নম্বর পেলেই অনার্স। আমি ৭৯% নম্বর পেয়ে গোল্ড মেডেলিস্ট। সেটা ১৯৫৪ সাল।'
শিক্ষক হওয়া হলো না
যোগ্যতা ও মেধা থাকার পরও শেখ মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষক হতে পারেননি- যা ছিল খুবই অন্যকাঙ্ক্ষিত। তিনি বললেন- 'একজন শিক্ষকের অসহযোগিতার কারণে শিক্ষক হতে পারলাম না। তিনি পরে আফসোস করতেন। তার নাম ড. এম এ রশীদ, তিনি ছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রিন্সিপাল। পরে উপাচার্য হয়েছিলেন। বুয়েটের প্রকৌশল শিক্ষাদানের ব্যাপারে তার অবদান চিরস্মরণীয়। সাধারণ মানুষের জন্য তিনি দরদী ছিলেন। তাকে ধরলাম আমাকে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে শিক্ষকতা চাকরির জন্য। তিনি আমাকে এমন কতগুলো শর্ত দিলেন, যা আমার পক্ষে পালন করা সম্ভব ছিল না। তিনি বললেন, তোমাকে কোনো বাসা দেব না। আমি বললাম, দেখেন আমার তো বিয়ে হয়েছে থার্ড ইয়ারে থাকতে, এখন একটা বাচ্চা হয়েছে। তাছাড়া আমার আব্বাও অনেক ঋণ করে ফেলেছেন, সেই ঋণ শোধ করতে তাকে সাপোর্ট দিতে হবে। বাসা ভাড়া নিয়ে লেকচারারগিরি করা, তা কি সম্ভব? তখন লেকচারারের বেতনের শুরু ছিল ২৭৫ টাকা। আপনার যত ফোরম্যান, অফিস স্টাফ তাদের বাসা দিচ্ছেন। একটা দীনহীন বাসা হলেও আমার একটা বাসা চাই। তিনি বললেন, তোমাকে একটা সাহায্য করতে পারি, সাউথ হোস্টেল যেটা আছে (আলিয়া মাদ্রাসার কাছে); সেটার সিঁড়িঘরের ওপর ল্যান্ডিংয়ের যে জায়গা আছে, সেখানে থাকতে পারো। আমি বললাম, ফ্যামিলি নিয়ে তো ওখানে থাকা যাবে না। ব্যাচেলর হিসেবে থাকতে হবে। তিনি বললেন, ব্যাচেলরই থাকবে। এভাবে উনি রীতিমতো নিরুৎসাহিতই করলেন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে শিক্ষকতা করতে। তখন আমি বললাম, এই বেতনে ফ্যামিলি নিয়ে বাইরে বাসা ভাড়া করে থাকা কি সম্ভব? তখন উনি বললেন, স্কুলের টিচাররা কত বেতন পায়? তার চেয়ে তো বেটার। আমি বললাম, স্কুলের শিক্ষকদের বেতনের বিষয়টি ধরলে তো আপনার বেতন নিয়েও প্রশ্ন আসে। তাহলে আপনি এত বেশি বেতন নেন কেন? তাহলে আপনার বেতনও কমান, সবারই সমান হোক। একজন ইয়াং লেকচারারকে বাসার সুযোগ দেবেন না, টিনের ঘর করে দিলেও তো হয়, আপনার তো আছে অনেক টিনের ঘর। He did not want my services at all.'
চাকরির খোঁজে কাপ্তাই যাত্রা
সংসারের ব্যয় নির্বাহ এবং সৎভাবে চলার সংগ্রামে দ্রুত শেষ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে বেশি বেতনের চাকরির সন্ধানে নামতে হলো। পরিবার-পরিজন রেখে ঢাকা থেকে সুদূর পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকরি করতে গেলেন। তাঁর ভাষ্য- 'আমি চলে গেলাম কাপ্তাই-এ কর্ণফুলি হাইড্রোইলেকট্রিক প্রজেক্টে। আর কোনো কারণ নেই, শুধু বেতন সেখানে বেশি সেজন্য। তখন কর্ণফুলি হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রজেক্টের কাজ সবেমাত্র শুরু হয়েছে। তখনকার দিনের অপূর্ব অভিজ্ঞতা। সেই চিটাগাং শহর, বাসে কালুর ঘাট তারপর লঞ্চে ৪ ঘণ্টা যাত্রা। আমাদের সঙ্গে আরেকজন লোক চাকরি পেয়েছিলেন। চাকরি পাওয়ার কায়দাটাও খুব অদ্ভুত। তার নাম ছিল এফ এম আব্দুল হাদী, বাড়ি বরিশাল, বর্তমানে প্রয়াত। তিনি খুব চালু লোক ছিলেন। তবে মেধাবী ছিলেন না। তিনি আমাকে ধরলেন, চল যাই কাপ্তাই যেয়েই চাকরি নেব। আমি বললাম, চাকরি কি সত্যিই হবে? উনি বললেন, চাকরি তো গেলেই হয়। তবুও কি একটা সনদ না নিয়ে যাওয়া যাবে? চল, তাহলে সার্কিট হাউসে যাই, সেখানে অবস্থান করছেন করাচি বসবাসকারী চিফ ইঞ্জিনিয়ার খাজা আজিমুদ্দিন। উনি থাকতেন করাচিতে, সপ্তাহে একদিন করে প্রজেক্টে আসতেন। এ সুবিধা দিয়েছেন তাকে আব্বাস খলিলী, তখনকার পাকিস্তান সরকারের ইন্ড্রাস্ট্রি সেক্রেটারি। তখনকার অবস্থা সামন্ততন্ত্রের যুগের মতোই। সে সময় যারা পাকিস্তানে বড় বড় চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন, তাদের কানেকশন খুব ভালো ছিল। তখন আমাদের চিফ ইঞ্জিনিয়ার যিনি ছিলেন, (তখন ওয়াপদা হয়নি, ছিল ইরিগেশন ডিপার্টমেন্ট) তাকে বাইপাস করে আলাদা চিফ ইঞ্জিনিয়ার করা হলো। তাকে সুবিধা দিলেন করাচি থেকে বিমানে ঢাকা আসা-যাওয়া করবে। ভাড়াও কম ছিল। করাচি থেকে ঢাকা ২৫০ টাকা ভাড়া। জেট বিমান না, ছিল প্রপেলার বিমান, নাম ছিল সুপার কনস্টেলেশন (Super Constellation) সপ্তাহে একবার এখানে আসত-যেত। আগেই বলেছি, তিনি আনুকূল্য পেয়েছেন ইন্ড্রস্ট্রি সেক্রেটারি আব্বাস খালিলীর। চিফ ইঞ্জিনিয়ার করাচি থেকে ঢাকা আসছেন। কালকে চলে যাবেন কাপ্তাই। কাপ্তাই ও কর্ণফুলী দুই নামই চালু। কর্ণফুলী নদীর ওপর প্রজেক্ট তাই প্রজেক্টের নাম নদীর নামে। নদী তো অনেক লম্বা কিন্তু প্রজেক্টের অবস্থান একটি গ্রামে। অতএব জায়গাটির নাম কর্ণফুলী বলা ঠিক নয়, বরং ৪ মাইল দূরে অবস্থিত কাপ্তাই ফরেস্ট রেঞ্জের নাম অনুসারে, ওটার নাম অনেকে কাপ্তাই বলতো। কিন্তু পরে নদীর নামেই নামকরণ হলো কর্ণফুলি হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রজেক্ট। কিন্তু কাপ্তাই নামটাই এখনো অনেকেই ব্যবহার করে। উনি সার্কিট হাউসে ছিলেন, স্লিপ দিলাম। তখন তো মানুষ খুব সরল ছিল, তিনি এসে দেখা করলেন, বললেন- কি চাই? বললাম, আমরা জাস্ট পাস করেছি, চাকরি চাই। বললেন, ঠিক আছে যাও, কাপ্তাই গেলেই চাকরি হবে। তিনি এতো সহজেই বলেছিলেন। তখন তো মাস্টার রোলের মতো চাকরি ছিল, ওটাকে বলত ওয়ার্কস চার্জড। এই চাকরিতে বেতন ভাতা প্রজেক্টের ব্যায়ের হিসাবে চার্জ হতো তাই বলা হয় ওয়ার্কস চার্জড। ওয়ার্কস চার্জড চাকরির কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। আমি বললাম, তাহলে তো আপনার লিখিত কিছু লাগবে। উনি সিগারেট খাচ্ছিলেন, সেই সিগারেটের খাপ বের করে সেখানে লিখে দিলেন 'শামসুদ্দিন, টেক দিজ বয়েজ।' শামসুদ্দীন সাহেব ছিলেন এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার। এখানে বেতন ৪৫০ টাকা। থাকার সুবিধাসহ সব ফ্রি, সার্ভেন্টও ফ্রি, ফলে খুব সঞ্চয় হতো। 'লঞ্চে আমাকে আব্দুল হাদী বলল, তুমি তো খুব পরিশ্রমী ছেলে, ওখানে তোমার শ্রমসহিষ্ণুতা দেখাতে যেও না। তাহলে তোমার ওপর সব কাজ চাপিয়ে দেবে। ফাঁকিবাজদের দেবে না, কারণ সে সময়মতো কাজ করবে না। আসলে তাই-ই হলো। এ উপদেশটা ঠিকই। তখন অনেক কাজই আমার ওপর চাপানো হতো। আমি সুযোগকে কাজে লাগালাম। বললাম আমাকে একটা ফ্যামিলি কোয়ার্টার দেওয়ার জন্য। আমার বস বললেন, ঠিক আছে ফ্যামিলি কোয়ার্টার দেয়া হবে, বেতনও বাড়িয়ে দেওয়া হবে। তবে একটি কাজ দেবো- একটি বড় পাহাড়ের জরিপ কাজ, এটি এক মাসে শেষ করতেই হবে। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম ও জিতলাম, ফ্যামিলি কোয়ার্টার পেলাম। যিনি আমাকে পাহাড় জরিপের কাজ দিয়েছিলেন, তিনি এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার মুশফিকুর রহমান খান বা এম আর খান। তিনি খুব ভালো উদার লোক ছিলেন। উনি আমাদের দেশেরই। ওই কর্ণফুলি প্রজেক্টে তখন একমাত্র এম আর খানই ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানি। আর সবাই পশ্চিম পাকিস্তানি। চিফ ইঞ্জিনিয়ার খাজা আজিমুদ্দিন আবার হায়দ্রাবাদের। হায়দ্রাবাদের ওসমানী ইউনির্ভাসিটির উর্দু মিডিয়ামে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া বহু প্রকৌশলীকে চাকরি দিয়েছিলেন।'
সরকারি চাকরিতে না যাওয়া বাবার ইচ্ছা থাকার পরও শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সরকারি চাকরিতে ঢোকার বিশেষ চেষ্টা করেননি, বেতন কম বলে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরির ক্ষেত্রে বাঙালিদের সঙ্গে কি রকম বৈষম্যমূলক আচরণ করা হতো, সেটাও তার এই কথায় উঠে আসে। তিনি বলেন- 'ইতিমধ্যে পাবলিক সার্ভিসে ঢোকার সুযোগ আসলো। আমি দেখলাম যারা সরকারি বিভাগে চাকরি করেন, তাঁদের চাইতে বাইরের চাকরিতে স্বচ্ছলতা বেশি। তবে ঘুষ খেতে আপত্তি না থাকলে সরকারি চাকরির স্বচ্ছলতা অনেক বেশি। যেহেতু অসৎ পথে যাব না, তাই শুধু স্বচ্ছলতা বিবেচনাতেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে থেকে গেলাম। এ সময় জহুর আহমদ নামে একজন ব্যবসায়ী ধরল যে ওনার সঙ্গে মিলে কনস্ট্রাকশন বিজনেস করি। চাকরিতে রিজাইন দিয়ে কনস্ট্রাকশন ফার্মে ঢুকলাম। ১৯৫৫ সালে কর্ণফুলী হাইড্রো ইলেকট্রিক প্রজেক্টে যোগদান করেছিলাম, আর বেরিয়ে আসলাম ১৯৫৮ সালে। তখন ঘুষের প্রচলনটা ছিল, তবে অত্যন্ত লঘু, পরিমাণ ২% থেকে ৫%। আমি সরকারি চাকরি করিনি অস্বচ্ছলতার জন্য। কারণ যে বেতন, তাতে যদি ঘুষ না খাই তাহলে আমার সংসার চলবে না। তবে সিইএস- পাকিস্তান সরকারের সেন্ট্রাল ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিস পরীক্ষা দিয়েছিলাম। সিইএস পরীক্ষায় পাস করলে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে চাকরি হয়। সেখানে বেতন ভালো। তাই সিইএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছি। পরীক্ষায় খুব ভালো নাম্বার পেয়েও আমাকে পাস করতে দিল না। তারা আমাকে ইংরেজিতে ফেল দেখাল। অথচ ইংলিশ আমি খুব ভালো করেছিলাম। ইস্ট পাকিস্তানের একজনও সেবার সিইএস-এ পাশ করেনি। সব পশ্চিম পাকিস্তানিরা পাস করেছে। সেই যুগে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি যত ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছিল সিইএস পরীক্ষাতে পূর্ব পাকিস্তানিদের ফেল করানো তার মধ্যে একটি। সিইএস পরীক্ষায় ফেল করাতে ড. রশিদ আমার প্রতি ক্ষুব্ধ হন, কারণ তিনি ভেতরের কারণ জানতেন না বা বিশ্বাস করতেন না- বহু বছর পর একটি কাজে দুজনে যুক্ত থাকার সময় আমার সম্বন্ধে তার ভুল ধারণা ভেঙে যায়। পতেঙ্গায় জেনারেল ইলেকট্রিক ম্যানুফাকচারিং (জিইএম) প্ল্যান্টে ড.আলিমুল্লাহ খানের প্রকৌশলী সংসদ ফার্মের ৬. হারুনুর রশীদকৃত Folded Plate ডিজাইনের একটি অত্যন্ত গুরুতর ভুল আমি ধরি ও পৃথক ডিজাইন করি। দুজনের একেবারে ভিন্ন ডিজাইন পরীক্ষা করে মতামত দানের জন্য ড. রশীদকে দায়িত্ব দেয়া হয়। ড. রশিদ আমার ডিজাইন সঠিক বলে রায় দেন। তবে ডিজাইন চেক করার জন্য আমার সাহায্য নেন। বইতে Folded Plate Gi Shear stress বের করার মেথড না থাকায় আমার শরণাপন্ন হন। আমি Fundamental Principle কাজে লাগিয়ে Shearing stress বের করে তার প্রশংসা অর্জন করি। আমাকে বললেন, তোমার বই লেখা উচিত।
'সরকারি চাকরি করার জন্য আব্বার পরামর্শ ছিল। একবার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে চিফ ইন্সট্র্যাক্টর হওয়ার জন্য একটা পজিশন হলো। সেখানে ড. রশিদ ছিলেন আমার ইন্টারভিউয়ার। আমি ড. রশিদকে বললাম, আপনি ইন্টারভিউতে যা ধরেছেন, তাতো ক্লাসে পড়াননি। আপনি কি সারপ্রাইজড হননি যে, আমি উত্তরটা সঠিক দিতে পেরেছি। সেখানে ইন্সট্রাক্টর হয়েছিলাম। কিন্তু দেখলাম যে, এটা করে বেশি দূর এগুনো যাবে না। ফলে ছেড়ে দিলাম। তাছাড়া বৃত্তি নিয়ে বিদেশে যাওয়ার জন্য একটা দরখাস্ত করলাম। পরে বিদেশও আর যাওয়া হয়নি। নেভাল আর্কিটেকচারের দরখাস্ত দিলাম, সেটা হয়নি। ফোর্ড ফাউন্ডেশন বাইরে পাঠাবে। সেজন্য একজন কর্মকর্তার কাছ থেকে সুপারিশ লাগবে। সে কর্মকর্তা ছিল পুরো তখন আমার বিরুদ্ধে। তার নাম ছিল শফিকুল হক। তিনি ছিলেন কর্ণফুলী প্রজেক্টের- Government Engineer Charge। তিনি সৎ ও যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন। তবে দাম্ভিক ছিলেন ও মানুষকে হেয় করতে পছন্দ করতেন। তিনি অনর্থক আমাকে হিংসা করতেন। তিনি আমাকে গ্রেটেন যাওয়ার দেখা করলেন, তুমি তো ওখানে ইন্টারভিউ দিয়েছ বিদেশ জন্য। আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আচ্ছা, যাবে। উনি না যাওয়ার সুপারিশ করলেন। তাঁর উল্টা সুপারিশের জন্য আর বাইরে যাওয়া হলো না। আর চেষ্টা করলাম না। এরই মধ্যে আরেকটা বাচ্চা হলো। তখন বুঝলাম যে, যাওয়া ঠিক হবে না। তারপর কনস্ট্রাকশন ফার্ম করলাম। কনস্ট্রাকশন ফার্ম করতে আমার কোনো অসুবিধা হয়নি। কোনো পুঁজি দিতে না পারায় আমার শেয়ার ৩৩.৫%, পুঁজিদানকারী ঠিকাদারের শেয়ার ৬৬.৫%। আমার নির্দিষ্ট বেতন ছিল ১৫৫০০ টাকা। ১৯৫৮ সালে ১৫০০ টাকা অনেক বেশি ছিল। ঠিকাদারের বাড়ি ছিল চট্টগ্রামে। পাঁচ বছর ধরে ফার্ম চললো লাভ হলো না কিছুই। একদিন ঢাকার রাস্তার আর্কিটেক্ট মাজহারুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, কি করছেন। আমি বললাম কন্ট্র্যাক্টরের ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছি। কিন্তু লাভ হচ্ছে না। উনি বললেন, আসেন কনসালট্যান্সি করি। আমি বললাম, আপনি তো সরকারি আর্কিটেক্ট, তিনি বললেন না, চাকরি ছেড়ে দেবো।
'শুরু করলাম। ১৯৬৪ সালের জুন মাস। ফার্মের নাম হলো বাস্তুকলাবিদ। বাস্তুকলা মানে আর্ট অব বিল্ডিং। বাস্তুকলাবিদ মানে স্পেশালিস্ট ইন আর্ট অব বিল্ডিং। উনিও সরকারি চাকরি ছেড়ে দিলেন। আমাদের অত টাকা-পয়সা লাগেনি। কেননা এটা কনসালট্যান্সি ফার্ম। আর একজন তৃতীয় ব্যক্তি ছিলেন তার নাম ছিল আজিমুদ্দিন। তিনি আমার চাচা শ্বশুর। আমাদের ফার্মে সামান্য যে পুঁজি লাগে, তা সম্পূর্ণটা তিনি দিয়েছিলেন। আমার বাবা ছিলেন স্কুল টিচার আর মাজহারুল ইসলাম সাহেবের পিতা ছিলেন সরকারি কলেজের প্রখ্যাত প্রফেসর। ইসলাম সাহেবের পিতার সঙ্গে ড. কুদরত-ই- খুদার ভালো সম্পর্ক ছিল। মাজহারুলের পিতার নাম ছিল ওমদাতুল ইসলাম। উনি ম্যাথমেটিক্সের প্রফেসর ছিলেন। এই যে সায়েন্স লাবরেটরি, এখানকার সব কাজ মাজহারুল ইসলাম সাহেবের ডিজাইনে করা। ড. কুদরত-ই-খুদা ছিলেন তখন ল্যাবরেটরির ডাইরেক্টর। কুদরত-ই-খুদা মাজহারুল ইসলাম সাহেবকে কাজ দেন। মাজহারুল ইসলাম আমার সঙ্গে বাস্তুকলাবিদ প্রতিষ্ঠার পর সম্ভবত বাস্তুকলাবিদ এর নামে ল্যাবরেটরিতে কোনো কাজ হয়নি। প্রথম কাজ পেলাম বোটানিক্যাল গার্ডেনের সার্ভে ও মাস্টার প্ল্যান করার। বোটানিক্যাল গার্ডেনের পরে পরপর অনেক কাজ পেয়েছি। জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি, চিটাগাং ইউনিভার্সিটির মাস্টার প্ল্যান করা ইত্যাদি। আমি ১৯৬৪ সালে শুরু করি বাস্তুকলাবিদ ফার্ম, ৫ বছর পর ১৯৬৯ সালে চলে যাই জেলে। ১৯৭০ সালে বাস্তুকলাবিদ ফার্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়।'
বস্তুবাদী চিন্তা থেকে মার্ক্সবাদী হয়ে ওঠা
প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর চিন্তার কিভাবে বিকাশ ঘটেছে, কিভাবে তিনি মার্ক্সবাদী হয়ে উঠলেন, সে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- '১৯৪৫ সালের দিকে বড় ভাই আনোয়ারুল ইসলাম কলকাতা থেকে আসা কয়েকজন কমিউনিস্টের সংস্পর্শে এসেছিলেন। তারা দূর সম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বড় ভাই তাঁদের নিয়ে যেসব কথা বলতেন তার অধিকাংশ বুঝতাম না, সরে থাকতাম। কিন্তু একটা কৌতূহল কাজ করত। আমি ধার্মিক ছিলাম না। বাবার সঙ্গে এ ব্যাপারে অনেক ঝগড়া করেছি। বাবা ধর্মপ্রাণ হয়েও একটু উদার ছিলেন। উনি কংগ্রেস করতেন। কলকাতা থেকে 'নবযুগ' নামে একটি পত্রিকা বের হতো। মাওলানা আহমদ আলী ছিলেন এটার সম্পাদক। বাড়ি ছিল আমাদের বাড়ির ৭ মাইল দূরে ডুমুরিয়া থানায়। আমার আব্বা ছিলেন আহমদ আলীর বড় ভক্ত। উনি লাহোর থেকে 'দি লাইট' নামে একটা পত্রিকা আনাতেন। পরে জানলাম এটা আহমদিয়াদের। আমার আরবি ভাষায় ভালো জ্ঞান ছিল। আরবিতে আমি লেটারও পেয়েছি। আমাদের স্কুলের হেড মৌলভী আব্দুর রহমান অত্যন্ত সুপণ্ডিত ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন। তিনি আমাদের আদর্শবাদী হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। যখন উনি শুনলেন যে, আমি মার্ক্সবাদী হয়ে গেছি এবং ধর্ম বিশ্বাস করি না, তখনও (১৯৬৪) তিনি স্কুলে হেড মৌলভী পদ অলংকৃত করে আছেন। বছরে একবার দুবার বাড়িতে বেড়াতে গেলে স্কুলে তাঁর সঙ্গে দেখা করে ফিরতাম। তিনি কখনোই আমাকে বলেননি যে, তুমি ভুল পথে যাচ্ছো। আমার বাবাও এ ব্যাপারে আমাকে কিছু বলেননি। বলেছেন, যেটা ভালো মনে কর, সেটা কর। '১৯৬৪ সালে আমি যখন মাজহারুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে 'বাস্তুকলাবিদ' করি, তখন আমাদের অফিস ছিল পরীবাগে। ন্যাপের মোজাফফর সাহেব (সদ্য প্রয়াত) ছিলেন মাজহারুল ইসলাম সাহেবের বন্ধু। উনি তখন প্রায়ই আসতেন, এসে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বোঝাতেন। আমি তার ভেতর কিছু খুঁত পেতাম। তাকে মন থেকে গ্রহণ করতে পারিনি। কিন্তু মাজহারুল ইসলাম সাহেব তাকে খুব ভালোবাসতেন। আমার বাসায় কমরেড সুখেন্দু দস্তিদার, কমরেড তোয়াহা ও কমরেড আব্দুল হক রাজনৈতিক আলোচনার জন্য প্রায়ই আসতেন। এই তিনজন পিকিংপন্থী ছাড়াও সিপিবির অনেকেই আমার বাসায় আসতেন। তাদের কর্মকাণ্ড শীতল মনে হলেও তাদের প্রতি আমার কিছু সহানুভূতি ছিল। সুখেন্দু দস্তিদারের সঙ্গে অনেকগুলো বৈঠকের পর মনে হলো- তারা বিপ্লবের জন্য সঠিক পথে আছেন। সেইভাবে ১৯৬৫ সালে পিকিংপন্থী মার্ক্সবাদীদের সঙ্গে চলে গেলাম। আমি কোনো সদস্য এমন কি প্রার্থী সদস্যও ছিলাম না। তাদের রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়াও কিছু আর্থিক ও বৈষয়িক সহায়তা করেছি।'
গ্রেফতার, নির্যাতনের নানা কায়দা
শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ নিষিদ্ধ পত্রিকা বহনের অভিযোগে ১৯৬৯ সালে গ্রেফতার হন এবং ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তি পান। জেলখানায় নানা চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে। স্মৃতির ভাণ্ডার থেকে তিনি বলতে থাকেন- 'তখন পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি 'মার্ক্সবাদী' বলে মাসিক পত্রিকা বের করত। তখন সেটা সাইক্লোস্টাইলে বের হতো। ১৯৬৯ সালের দিকে এর জনপ্রিয়তা খুব বেড়ে গেল। সাইক্লোস্টাইল করে পারা যায় না। এখন এটা প্রিন্ট করে ছাড়তে হবে। তাদের কোনো প্রিন্টিংয়ের ব্যবস্থা হচ্ছে না। আমাকে ধরলেন, প্রিন্টিংয়ের ব্যবস্থা করে দেওয়া যায় কি না। আমার বড় ভাইকে ধরলাম কী করা যায়। উনি ঘোড়াশালের চিফ অ্যাকাউনটেন্ট ছিলেন। ঢাকায় থাকতেন এবং আমার আগে থেকেই সমাজতান্ত্রিক লাইনে ছিলেন। বড় ভাই বললেন যে, এই প্রিন্টিংয়ের কাজ তো ছোট কোনো প্রেসে করতে পারো। তোমাদের কোম্পানিও তো করতে পারে। তাই হলো কাল। আমাদের ফার্ম বাস্তুকলাবিদের। স্টেশনারি ছাপার কাজ করত ভূতের গলিতে 'সেবা প্রিন্টিং প্রেস' নামের একটি ছোট ছাপাখানা। তাকে গিয়ে বললাম, সে দিব্যি রাজি হয়ে গেল। আমরা বলেছিলাম, এটা কিন্তু নিষিদ্ধ পত্রিকা, দেখেন পারবেন কি না। তারা বলল, 'হ্যাঁ, পারব।' পরে জেনেছি এদের সঙ্গে মিলিটারি ইনটেলিজেন্সের ভালো লাইন থাকে। এই ছোট প্রেসগুলো হলো ইনটেলিজেন্সের কন্টাক্ট বা সোর্স। 'মাসিক 'মার্ক্সবাদী' নামের এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন কমরেড আব্দুল হক। আমার বাসা ছিল ধানমণ্ডিতে। ১০ বা ১১ ডিসেম্বর ঈদ, সবাই ঈদের ছুটিতে যাচ্ছে। সুখেন্দু দস্তিদারও আমার বাসায় থাকতেন। জিনিসপত্র নিয়ে আমার বাসায় অপেক্ষা করছেন সুখেন্দু দস্তিদার। আমি প্রেস থেকে পত্রিকা নিয়ে গেলে তিনি তা মফস্বলে পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন। ১৯৬৯-এর ৯ ডিসেম্বর আমি তিন হাজার কপি ছাপা পত্রিকা নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি ধানমন্ডি ২ নম্বর রোড, অর্থাৎ তখনকার দিনে পিলখানা রোড, ওই পর্যন্ত যেতে পারেনি। একটা পুলিশের গাড়ি খুব স্পিডে এসে আমার গাড়ির গতিরোধ করে থামাল। আমার সঙ্গে আমার ড্রাইভার এরশাদ এবং সহকর্মী ডিপ্লোমা প্রকৌশলী আব্দুর রউফ ছিল। ভাগ্য ভালো যে, পুলিশ ধরে নেয়ার সময় আমার বন্ধু মীর মুস্তফা আলী নামে একজন আর্ট কলেজের শিক্ষক দেখে ফেলেন। উনি আমাদের মার্ক্সবাদী লাইনের ছিলেন এবং বাড়ি ছিল ঝিগাতলা। যে জায়গায় আমাদের ধরল, সেখান থেকে আমাদের বাসা বড়জোর কোয়ার্টার মাইল হবে। মীর মুস্তফা আলী দৌড়ে গিয়ে বাসায় খবর দিলেন। পুলিশ আমাদের গাড়ির লাগেজ বুট খুলে পত্রিকাগুলো নিয়ে নিল এবং আমাদের অ্যারেস্ট করে লালবাগ থানায় নিয়ে গেল। তারপর শান্তিনগর থানার পুলিশ এসে 'ফরিদপুর ভবন' নামে একটি দোতলা বাড়িতে নিয়ে গেল। সাতদিন ধরে আমাকে জেরা করেও কাবু করতে পারেনি। শুধু আমাকে নয়, আমার ড্রাইভার এরশাদ এবং সহকর্মী আব্দুর রউফকেও জেরা করেছে। মূলত আমার সঙ্গে কারা আছে তাদের নাম জানতে চাইল। সুখেন্দু দস্তিদার, কমরেড আব্দুল হক, কমরেড তোয়াহা, এদের আইডেনটিটি জানতে চায়। আমি খুব ট্যাক্টফুলি কথা বললাম। আমি বললাম যে, আমি যতটুকু জানি তারা টেক্ নাম ব্যবহার করে। তবে তাদের ফিজিক্যাল ডেসক্রিপশন বলতে পারি। তারা বিশ্বাস করল কি না তা জানি না। সেখানকার এসপি ছিলেন লোকমান হোসেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলীর ভাই। তাদের বাড়ি খুলনার পাইকগাছা আর আমার বাড়ি দৌলতপুর। কিন্তু উনি বিয়ে করেছেন দৌলতপুরের খুব কাছে। আমার একজন খুব বিশ্বস্ত সহচর ছিল, তার নাম আবুল। আবুল সব সময় চেষ্টা করত কীভাবে সাহায্য করা যায়। উনি লোকমান সাহেবকে ধরলেন এবং আমার কথা বললেন। লোকমান সাহেব খুব সৎ এবং সহৃদয় ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বললেন, আমি তো শহীদুল্লাহ সাহেবকে ভালো করে চিনি। ঠিক আছে তাঁর ওপর অযথা বেশি অত্যাচার যাতে না করতে পারে সেটি আমি দেখব।'
ইন্টারোগেশন নানা মাত্রায়
শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর আলোচনায় উঠে এসেছে ইন্টারোগেশনের নানা ধরন ও মাত্রা। তিনি বলেন- 'থানায় তিন শিফটে ইন্টারোগেশন হতো। ২০০ ওয়াট পাওয়ারের বাল্ব মুখের কাছে জ্বালিয়ে সারা রাত একই প্রশ্ন করত। কখন আসল কথাটা বলে ফেলি, এটার জন্য তারা অপেক্ষা করে। কারণ সত্য কথা বললে, সেটা যতবার জিজ্ঞেস করুক না কেন মিল থাকবেই। আর মিথ্যা বললে তো অমিল হবেই। লোকমান সাহেব আমাকে বললেন, আমাদের (পুলিশের) ইন্টারোগেশনের পরে মিলিটারি ইন্টারোগেশন আসবে। খুবই রাগী এবং বদমেজাজি অফিসার মেজর গনি। সেখানেও কিন্তু আপনাকে একই কথা বলতে হবে। কোনো অমিল হতে পারবে না। হয় দুটোই সত্য, না হয় দুটোই মিথ্যা অর্থাৎ সমান হতে হবে। আমি কতগুলো কল্পনা করলাম যে, কমরেডদের নাম কী, হাইট কত, রং কেমন, দাড়ি আছে কি না ইত্যাদি- যা বাস্তবের একেবারে বিপরীত। এগুলো মাথার মধ্যে সেট করে রাখলাম। জিজ্ঞাসাবাদে যতবার জিজ্ঞেস করল, ঠিক একই উত্তর পেল। আমার স্ত্রীর খালাতো বোনের স্বামী আমিনুল ইসলাম, উনি পরে এয়ারফোর্সে এয়ার ভাইস মার্শাল পর্যন্ত হয়েছেন। আমার কর্মকাণ্ড তখন অনেকেই জানত, তিনিও জানতেন। তিনি তখন ডিজিএফআইর অফিসার ছিলেন। আত্মীয় ধরে নিতে পারলে চাকরিতে প্রমোশন হয়। উনি সেই সুযোগটা নিলেন।
'রাতের শিফটকে লোকমান সাহেব বলে দিলেন আমাকে ঘুমাতে দেওয়ার জন্য। ১৬ ঘণ্টা ইন্টারোগেশনের পর রাতে ৮ ঘণ্টা ঘুম। বালিশ, চাদর, কিছুই নাই। একটা বড় টেবিল ছিল, সেই টেবিলে ঘুমাতাম। মিলিটারি ইন্টারোগেশনে মেজর গনি এসে খুব উদ্ধত কথা-বার্তা বললেন। শেষে কতগুলো কথা বললেন- আমিনুল ইসলাম একদিন তার বাসায় দাওয়াত করেছিল, গিয়েছিলাম। আমিনুল ইসলাম আমাকে (শহীদুল্লাহ) দেখেই বলেছিলেন, 'এই যে মেটেরিয়ালিস্ট ফিলোসফির লোক আসছে। আমাদের মিলাদ, দাওয়াতে তো উনার কোনো আগ্রহ নেই।' এভাবে কথাটা বললেন। এখন বুঝলাম যে, মেজর গনি আমার মেটোরিয়ালিস্ট ফিলোসফি সম্পর্কে জানেন।' 'মেজর গনি আমাকে বললেন, দেখেন আপনি কিন্তু কোনো লিডই দিচ্ছেন না, সত্য গোপন করছেন। আমি বললাম আমি যা জানি তাই বলছি। তিনি বললেন, আমি জানি কোনো চাকরি করে আপনার স্ত্রী আপনার ফ্যামিলি চালাতে পারবেন না। আপনার জেল হলে ফ্যামিলি কীভাবে চলবে? আমি তাকে যা উত্তর দেয়ার দিলাম। তখন বুঝলাম, মেজর গনি কিভাবে জানল আমার ওয়াইফের শিক্ষাগত যোগ্যতা কী, সংসার চালানোর যোগ্যতা তার আছে কি না! মেজর গনির তো জানার কথা নয়। মেজর গনি আমাকে অনেক জেরা করলেন। তখন শুনলাম আমার ড্রাইভারকে মাথা নিচে দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে। তাকে জিজ্ঞাসা করা হত সাহেবের কাছে কে কে আসত। ড্রাইভার বলত আমি তো দিনে ডিউটি করতাম, কাউকে তো তেমন দেখিনি। ওদের নাম পেল না। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর যখন জেল থেকে মুক্তি পেলাম, তখন সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি আমার বাসায় বেড়াতে আসলেন ও সহানুভূতি দেখালেন তিনি এই আমিনুল ইসলাম। আমার হাজতবাস কালে আমার স্ত্রীর ভাই সম্পর্কের এক ইঞ্জিনিয়ার গিয়েছিলেন আমিনুল ইসলামের কাছে এবং বললেন, 'আপনি তো বড় পজিশনে আছেন। দেখেন শহীদুল্লাহ সাহেবের জন্য কিছু করতে পারেন কি না।' তখন তিনি তাকে বলেছিলেন, 'আপনি তো ইঞ্জিনিয়ার। আপনাদের মধ্যে আর কে কে আছেন এই লাইনে আমাকে বলুন তো, তাদেরকেও ধরে দেই।' এ রকম ব্রুট ছিলেন তিনি।
'ব্রিগেডিয়ার মাজেদুল হক, মেজর জেনারেল হয়ে পরে অবসরে গিয়ে মাগুরা থেকে বিএনপির এমপি হয়েছিলেন। উনি আমার পার্টনার মাহজারুল ইসলাম সাহেবের আপন ভায়রা ভাই। আমার মুক্তির পরে উনি দাবি করেন, আপনার তো মিলিটারি কোর্টে পাঁচ বছর জেল হতো। আমি ব্যবস্থা করে সামারি কোর্টে এনে দিয়েছি, সেখানে সর্বোচ্চ সাজা এক বছর।'
মিলিটারি কোর্টের মুখোমুখি
কোনো বিচার ছাড়া হাজতে সাড়ে পাঁচ মাস কাটানোর পর শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর সামারি মিলিটারি কোর্টে বিচার হলো। মিলিটারি কোর্টের নানা বিতর্ক ও স্মৃতি তাঁর এখনো স্পষ্ট মনে আছে। তিনি বলেন- 'আমার জজ ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি মেজর আকরাম। তাকে আমি নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছি। সে জামায়াতপন্থী ছিল, তবে একদিক দিয়ে ভালো ছিল। তিনিই বললেন, আপনার ড্রাইভারকে তো সাড়ে পাঁচ মাস আটকে রাখা হয়েছে। আপনার ড্রাইভার তো আপনার মতো সমাজতন্ত্রী নয়। তৎক্ষনাৎ ড্রাইভারকে রিলিজ করার আদেশ দিল। আমি কিন্তু আমার সমাজতান্ত্রিক আদর্শে অটল থাকলাম। তিনি বুঝলেন যে, লোকটা খুবই সিনসিয়ার। তিনি ইংরেজি ভালো বলতে পারতেন না। ফলে ইংরেজি-উর্দু মিশিয়ে বলতেন। 'আপ তো ধোঁকা খা গায়া হ্যায়, আপ তো বহুত আচ্ছা আদমি হ্যায়, লেকিন আপ ধোঁকা খা গায়া হ্যায়।' তখন তিনি ইসলামের গল্প বলতেন, নিজের গল্প বলতেন, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বের গল্প শোনাতেন। তারপর একদিন জানতে চাইলেন, 'আপনি কেন কমিউনিস্ট হলেন?' আমি যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করতাম, সামজতন্ত্রই কেবল মানুষ কর্তৃক মানুষের অর্থনৈতিক শোষণের অবসান ঘটিয়ে শোষিতের তথ্য সকলের মুক্তি আনতে পারে। মেজর আকরাম বারবর আমাকে বিশ্বাস করানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল যে, ইসলাম হচ্ছে মানব জাতির মুক্তির একমাত্র সঠিক পথ। তিনি আমার সঙ্গে বিতর্কে খুব মজা পেয়েছিল। যে কারণে একমাস ধরে আমার সঙ্গে এ ব্যাপারে বিতর্ক করেই গেল। 'মেজর আকরাম যে মামলায় আমাকে জেরা করেছিলেন, সেটা যে ভুয়া তা প্রমাণ করে দিলাম। আসলে মামলা তো ঠিকই ছিল। কিন্তু সে টেকনিক্যালি একটু অপ্রস্তুত ছিল। ইনভেস্টিগেশন অফিসার মাঝখান থেকে বদলি হয়ে গেছে। যেহেতু সে জানে যে, যা ঠুকে দিব তাই হবে, কিছুই প্রমাণ করা লাগবে না। অতএব যে কোনো একজন এসে জিজ্ঞাসা করলেই হবে। হি স্টুড অব ইনভেস্টিগেশন অফিসার। আমি তাকে প্রশ্ন করে নাজেহাল করে দিলাম। আমি বললাম যে, গাড়ির রং কী ছিল, গাড়ি কোন দিকে মুখ করা ছিল, গাড়ির নং কত, গাড়িটি কোন জাতের? কিন্তু সে একটারও উত্তর করতে পারল না। ওরা উকিল তো নিতে দেয় না, নিতে দেয় ফ্রেন্ড। আব্দুল হক আমার কুষ্টিয়ার ফ্রেন্ড, ন্যাপ করত। শেষমেষ তাকেই ধরলাম। সে একটাও প্রশ্ন করতে পারেনি আইও-কে। মেজর আকরাম হাসে। অবশ্য ওতে তো কিছু যায় আসে না। ফলাফলটা সব সময় একই হয়। আসলে হলোও তা-ই। আমার এক বছরের জেল হলো। রউফকে দিলেন ডিভিশন। তাঁর সর্বোচ্চ ক্ষমতা উনি প্রয়োগ করলেন। আমাকে থার্ড ক্লাসে রাখলেন, ডিভিশন দিলেন না। আমি বললাম কি ব্যাপার, আমার কর্মচারীকে ডিভিশন দিলেন, আর আমাকে ডিনাই করলেন। মেজর আকরাম বললেন, আপনি তো কমিউনিস্ট, ও তো কমিউনিস্ট নয়। এ জন্য ওকে ডিভিশন দিলাম, আর সাধারণ কয়েদীদের সঙ্গেই তো আপনার থাকা উচিত।'
কমিউনিস্টি হওয়া শাস্তি কনডেমড সেল
শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, 'ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আমাকে কনডেমড সেলে রাখল। এখানে আটটা ফাঁসির সেল রয়েছে। এগুলোকে এইট সেল বা ফাঁসির সেল বলা হয়। ফাঁসির আসামিদের জন্য নির্দিষ্ট এই সেলগুলো। আমার সামনে দুই দণ্ডপ্রাপ্তের ফাঁসিও হলো। কয়েকদিন পর আইজি প্রিজন আমাকে ডেকে পাঠালেন। এটা সাধারণত হয় না। এমনকি রাজনৈতিক বন্দিদেরও ডাকা হয় না। সকালবেলা আইজি প্রিজনের রুমে নেওয়া হলো, বসতে দিলেন। তিনি বললেন, দেখেন আমার ছেলে ড. নুরুল উলা আপনার খুব গুণগ্রাহী। সে আপনাদের 'বাস্তুকলাবিদ'-এ বিদ্যুৎ প্রকৌশলী হিসেবে পার্টটাইম কনসালট্যান্সি করে। সে আমাকে বলেছে, আপনাকে যেন একটু দেখি। আপনার যাতে কোনো অসুবিধা না হয়। আমি বললাম, হ্যাঁ, ড. নুরুল উলা আমাদের ফার্মে পার্টটাইম কাজ করেন। বললাম, কিন্তু আপনি তো আমার ব্যাপারে কিছু দেখেন নাই। ফাঁসির আসামি না হওয়া সত্ত্বেও আমাকে কনডেমড সেলে ঢুকিয়েছেন। তিনি বললেন, এটা রাও ফরমান আলীর অর্ডার। বললাম, রাও ফরমান আলী আমার ব্যাপারে এতো আগ্রহী হবেন কেন, তার উত্তর না দিয়ে বললেন তাদের অর্ডার, তারা কারণ জানান না। পরবর্তীকালেও কোনো সময় তিনি সহানুভূতি দেখান নাই, আমিও চাইনি। বরং আমার কাছ থেকে কিছু পেশাগত সার্ভিস নিয়েছেন। কারাগার ঢাকা থেকে কাশিমপুর স্থানান্তর হবে, তার জন্য পিপি বা প্রজেক্ট প্রোফাইল করার জন্য ড্রয়িং লাগবে, সেই ড্রয়িং করানোর জন্য আমাকে খবর দিলেন। বললেন, আমাদের জেলখানা শিফট করতে হবে, আমরা এখান থেকে কাশিমপুরে যাব। আমি ফিজিক্যাল ডেসক্রিপশন দিচ্ছি আপনি একটু এঁকে দিন, স্কেচ হলেই চলবে। আমি বললাম ঠিক আছে, আপনি সেটস্কোয়ার, পেনসিল, কাগজ, মোটা কাগজ ইত্যাদি আনেন। উনি যেভাবে চেয়েছেন, আমি তিনদিনে এটা করে দিলাম। আমার কাছে সার্ভিস নিয়েছেন কিন্তু আমাকে কোনো সুবিধা দেন নাই, আমি চাইওনি। 'আমি কনডেমড সেলে থাকলাম। তিনটা সুতির কম্বল, একটা বিছানোর জন্য, একটা গোল করে বালিশ বানানোর জন্য, একটা গায়ে চাদর হিসাবে ব্যবহার করার জন্য। তখন ছিল শীতকাল আর ইটের ফ্লোর। অতএব সাংঘাতিক ঠাণ্ডা। ঠাণ্ডায় আমার জ্বর এসে গেল এবং ঠাণ্ডা থেকে কানে ব্যাথা শুরু হলো। ইনফেকশন হয়ে গেল। ইনফেকশনটা কানে গেল । তখন আমি জেলার নির্মল সেনকে বললাম, আমাকে স্যান্ডেল দেন এবং কিছু ভালো লেপ-তোষক দেন। তিনি বললেন, ডিআইজি ও সিভিল সার্জনের সাপ্তাহিক যুক্ত পরিদর্শনকালে তাদের কাছে চান। তাদের ক্ষমতা আছে বাড়তি সুবিধা দেবার। জেলার নির্মল সেন কিছুটা হেল্পফুল ছিলেন। উনি চিত্রনায়িকা চিত্রা সেনের ভাই। নির্মল সেন হ্যান্ডসাম চেহারার এবং ভালো লোক ছিলেন। জেল পাহারার যে লোকগুলো থাকে, তারা হলো জেল কর্তৃপক্ষের চামচা। চামচা মানে লয়াল। তারা সবাই গোয়েন্দাগিরি করে। এরা সার্ভিস দেয়, আমাদের দেখাশুনা, রোলকল, গণনা করা আবার গোয়েন্দাগিরিও করে। এদের বলে মেট, আর পাহারা। পাহারাগুলো সর্বনিম্ন আর মেট হলো তার উপরে। ওরা পায় স্যান্ডেল আর আমি স্যান্ডেল ছাড়া। জেলারকে বললাম জেলকোড দেখান। সেখানে কি বলা আছে? আমি স্যান্ডেল পাব না কেন? জেলকোডে কি বলা আছে পা নগ্ন রাখতে হবে? জেলার নির্মল সেন বললেন, জেল কোড সংশোধন করা হয়েছে। বললাম, জেলকোড সংশোধন করা হলো কেন? একজন লোক নাকি জেলারকে একদিন স্যান্ডেল ছুঁড়ে মেরেছিল। সেই থেকে স্যান্ডেল ব্যবহারের অনুমতি তুলে দেয়া হলো। আমি বললাম, তার জন্য তো আমি এ শাস্তি পেতে পারি না? আর স্যান্ডেল মারার পেছনেও উপযুক্ত কারণ ছিল নিশ্চয়। নির্মল সেন বললেন, এ থেকে মুক্তি আছে। প্রতি সপ্তাহে ডিআইজি প্রিজন যখন আসেন সিভিল সার্জনসহ, তখন আপনি চেয়ে নেবেন। খুব শীঘ্র এসে গেল সাপ্তাহিক পরিদর্শনের পালা। সাপ্তাহিক পরিদর্শনে ডিআইজি আসলেন। ভূঁইয়া নাম তার। তাঁকে বললাম আমার কিছু দরকার নেই, শুধু একজোড়া স্যান্ডেল পরার অনুমতি দেন। উনি ছিলেন ঘন দাড়িমণ্ডিত ও আহলে হাদিস। উনি বললেন, আপনি নামাজ পড়লে আপনাকে স্যান্ডেল দেবো। আমি বললাম, আপনি তো একজন সরকারি অফিসার। ন্যায্য সুবিধা দানের জন্য আপনার ক্ষমতা প্রয়োগ বিশেষ কোনো ধর্মের অনুশাসন মানার শর্তসাপেক্ষে করতে পারেন না। অন্য কোনো সঙ্গতকারণ থাকলে আমার অনুরোধ অগ্রাহ্য করতে পারেন। কিন্তু নামাজ পড়ার শর্ত তো দিতে পারেন না। তাছাড়া আমার সোশ্যাল স্ট্যাটাস বললাম। বলল, এতে কিছু হবে না। আপনি নামাজ পড়েন, তাহলে স্যান্ডেল দেবো। আমি বললাম, নামাজ পড়া আমার বিশ্বাস অনুসারে একটি নিষ্ফল পরিশ্রম। 'উনি যাওয়ার সময় আরেকটা কথা বললেন, 'আপনি যে এই কথাগুলো বলছেন, এগুলো কি বাইরেও বলেন?' বললাম নিশ্চয়ই, বাইরে যারা মুক্ত চিন্তায় বিশ্বাস করে তাদের কাছে বলি। আর যারা মুক্ত চিন্তা থেকে বঞ্চিত, যারা একথা শুনলে আমাকে মারতে আসবেন, তাদের কাছে বলি না। তখন ডিআইজি বললেন, 'আপনার মতো এ ধরনের কথা কবি নজরুলও একসময় বলতেন। পরে আল্লাহতায়ালা নজরুলের জবান স্তব্ধ করে দিয়েছেন।
আপনারও একদিন এই জিহ্বা স্তব্ধ হয়ে যাবে।' আমি বললাম মুশকিল হচ্ছে, আপনার কথায় তো কিছু হবে না। আপনার কথায় আল্লাহতায়ালা রিঅ্যাক্ট করবেন না। আমার এসব কথায় ডিআইজি গেলেন খেপে। তিনি ফিরে যেয়ে আমাকে পাগলা গারদে পাঠাবেন বলে স্থির প্রতিজ্ঞ হলেন। 'একদিন কয়েকজন সেন্ট্রি আসল, আমাকে নিয়ে যাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজে। আমি বললাম কী ব্যাপার, কী হয়েছে? আমাকে কেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে নেয়া হবে এ ব্যাপারে তারা মুখ খুললেন না। যেয়ে দেখি ফারহানা বেগমের চেম্বার, তিনি সাইকিয়াট্রিস্ট। তিনি আসলেন, ইন্টারভিউ শুরু করলেন। আমি প্রথমেই বললাম, দেখুন জেলে যে সিভিল সার্জন আছেন, তিনি একজন কুখ্যাত ডায়েট-চোর, সবার ডায়েট চুরি করেন এবং বিক্রি করেন। আপনার যে পেশা, সে পেশার একটা বদনাম হয়ে যাচ্ছে। সবাই ভাবছে ডাক্তাররা সবাই এই চরিত্রের। রোগীদের ইনপ্রুভড ডায়েটের বিধান থাকলেও তিনি সেগুলো দেন না। সিলেকটেড কাউকে কাউকে দেন, বাকিগুলো চুরি করেন। সমস্ত কারাগারের বন্দিরা তাঁর ওপর খুবই ক্ষুব্ধ। তার কাছে আমি স্যান্ডেল চেয়েছিলাম। কথায় কথা বাড়ে। তখন কথাটা প্রকাশিত হলো আমি কোনো ধর্মে বিশ্বাস করি না। তিনি ধর্মে বিশ্বাস করেন। আমাকে তো সরকার একটা শাস্তি দিয়েছেই। ধর্ম বিশ্বাসের কারণে উনি কারাগারে আমাকে আবার কেন শাস্তি দেবেন। স্যান্ডেলটা না দেওয়া একটা শান্তি। আমি তো আর কিছুই চাইনি। সির্ভিল সার্জনকে ডেকে জিজ্ঞেস করুন, ইমপ্রুভড ডায়েটও চাইনি। আমার সামনে বহু লোকে চায়, আমি কিন্তু চাইনি। আমি শুধু ঠাণ্ডার জন্য স্যান্ডেলটা চেয়েছি। এসব কারণেই আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে। আমি পাগল নই। কোনো জেরা করার দরকার নেই। 'তবুও তিনি বাপ, দাদা, ভাই-ল্যাটারালি, ভার্টিকালি, আপ- ওয়ার্ড, ডাউন-ওয়ার্ড সব বংশ পরিচয়ের তথ্য নিলেন। আমি বললাম আপনার প্রফেসরদের ভেতর আছেন এমন দুইজন লোকের কাছে খোঁজ নেন। তারা তো আপনাদের টিচার। ড. মুনিরুজ্জামান এমআরসিপি (ইংল্যান্ড), ডা. ফজলে রাব্বি (এফআরসিএস) আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারপর তিনি কনভিন্সড হয়ে গেলেন। তবুও আসার পর সেন্ট্রিদের আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। যে সেন্ট্রিরা নিয়ে গিয়েছিল ইন্টারভিউ শেষে কারাগারে ফিরে আসার সময় তারা আমাকে বলল, 'জানেন ডাক্তার কি জিজ্ঞেস করেছে আমাদের। বলেছেন, সাহেব কি ঠিকমতো ঘুমায়। আবার প্রশ্ন করেছেন, তিনি কি চিৎকার করেন বা বদমেজাজের কিছু করেন? আমরা বললাম, না। আবার প্রশ্ন করেছেন, খাওয়া- দাওয়া কি ঠিকমতো করেন? বললাম, ঠিকমতো এবং সর্বনিম্ন ডায়েট খান। খাওয়ার ব্যাপারে তাঁর কোনো কমপ্লেইন নেই।' পরদিন দেখি সাপ্তাহিক ভিজিটের দিন না হওয়া সত্ত্বেও সিভিল সার্জন এসে রুম খুলে বললেন, 'আপনার কি ইমপ্রুভড ডায়েট লাগবে?' আমি বললাম না তো। আমি তো এ ব্যাপারে কোনো কমপ্লেইন করিনি। 'তখন বললেন- 'না, আপনাকে ইমপ্রুভড ডায়েট নিতে হবে।' আমি বললাম, এত খাতির। স্যান্ডেল চেয়েছিলাম আর আপনি ইমপ্রুভড ডায়েট দিলেন। বললেন, 'স্যান্ডেল কাল থেকে পাবেন।' কিন্তু ডিআইজি সাহেবের ক্ষোভ স্তিমিত হলো না, বেড়ে গেল। তিনি এই সংবাদ রাষ্ট্র করলেন, পাবনা পাঠানো হচ্ছে। স্বভাবতই আমি ধরে নিলাম পাবনা পাগলা গারদে পাঠানো হচ্ছে। কেউ মুখ খুলছেন না। প্রকৃতপক্ষে পাবনায় পাঠানো হলো ঠিকই, তবে পাগলাগারদে নয়, পাবনা ডিস্ট্রিক্ট জেলে। একটি পুরা তৃতীয় শ্রেণির রিজার্ভ বগি করে ২০/২৫ জন সেন্ট্রির পাহারায় ঢাকা থেকে ট্রেনে ঈশ্বরদী রেলস্টশন। সেখান থেকে বাসে পাবনা বাস স্টেশন। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে পাবনা ডিস্ট্রিক্ট জেল'।
পাবনা জেলে দিনযাপন
'পাবনায় যিনি ডিসি ছিলেন, তার নাম নুরুল কাদের খান। উনি আমার পূর্বপরিচিত। আমার কথা শুনে নুরুল কাদের খান ভিজিট করতে আসলেন। এসেই বললেন, আপনি নাকি কমপারেটিভ রিলিজিয়নের ওপর বই লিখছেন? আমি বললাম না, কোনো রিলিজিয়নের সঙ্গে আমাদের রিলিজিয়নের কমপেয়ার করছি না। কেননা আমার অত পড়ার সময় নেই। বললাম শিখ ধর্ম বাদ দিলে ইসলাম সর্বশেষ ধর্ম। শিখ ধর্ম তো আবার মানব প্রণীত। পূর্ববর্তী ৩টি ধর্ম এবং ইসলাম ৪টি মাত্র ধর্ম ঈশ্বর থেকে অবতীর্ণ হওয়ার দাবিদার। অবতীর্ণ দাবিদার ধর্মগুলোর মধ্যে শুধু কিঞ্চিৎ পড়া আছে বাইবেল। বাইবেল ওল্ড টেস্টামেন্ট আর ইসলাম তো একই সূত্রে গাঁথা। ইসলাম আমার খুব ভালো করে পড়া আছে। উনি খুব এনকারেজ করলেন। বললেন যে, আপনার কোনো চাহিদা আছে? আমি বললাম, হ্যাঁ আছে। জেলগেটে পড়ে আছে সম্প্রতি বের হওয়া বদরুদ্দীন উমর-এর ভাষা আন্দোলনের ওপর বই। 'ক্যাপিটাল' বইটা আমার এক আত্মীয় পাঠিয়েছে, সেটাও জেলগেটে পড়ে আছে। আমাকে দেয় না। এগুলোর ভেতর কি আছে যে আমাকে পড়তে দেওয়া হয় না। পরদিনই বইগুলো পেলাম। পাবনা জেলে একটা বিরাট রুম শুধু আমার জন্য। একজন পারসোনাল অ্যাটেনডেন্ট দিলো। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পারসোনাল এটেনডেন্ট দিলো যে লোকটিকে, তার ইতিমধ্যে রিলিজ অর্ডার এসে গেল। দেখলাম, সে নামাজ পড়তে লাগল, কোরআন শরীফ খুব ভালোভাবে পড়তে লাগল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি জেল থেকে বেরুলে কি আর চুরি করবে না ঠিক করলে? সে বলল, কি যে বলেন হুজুর, চুরি না করলে আমার যে সংসার চলবে না। আমি প্রথমদিনেই চুরি করব। চুরি না করে বাড়ি যাব না।
আমি বললাম, তুমি তো কোরআন শরীফ পড়লে। সে বলল, 'আমি এত বড় গুনাহ করেছি আল্লাহর কাছে মাফ চাইতে হবে না?' জিজ্ঞেস করলাম তাহলে কেন আবার চুরি করবে? সে বলল, 'আমার জেলগেটে কী আছে- কিছুই নাই। এই যে আমার কাপড়-চোপড়। বউ ছেলে-মেয়েকে তো কিছু দিতে হবে।' এই বলে সে কেঁদে দিল। এই হলো দেশের সমাজ। চুরি তো তারা করে না। আমরা তাদের চুরি করতে বাধ্য করি।
'পাবনা জেলে থাকতেই আরেকটা ঘটনা ঘটল। মিলিটারি ইনটেলিজেন্স থেকে একটা ভিজিট হলো। সেখানে পুরা ব্লাস্ট করলাম। জেলার দাঁড়িয়ে আছে তার সামনেই বললাম জেলার একটা চোর। জিজ্ঞাসা করল, 'কী ধরনের চুরি করে?' বললাম, ধরুন আমি নাস্তা হিসেবে রুটি আর আখের গুড় খাই। অর্ধেক আখের গুড় চুরি করে বাকিটা পানি দিয়ে মিশিয়ে ঝোল বানিয়ে দেয়। আখের গুড় কোনোদিন ঐ ঝোল অবস্থায় কিনতে পাওয়া যায় না। আর রুটি যত দেবার কথা তা দেয় না সেখানেও চুরি। এখানে বাগানে যে সব্জি হয় তা কয়েদীদের প্রাপ্য, কিন্তু অধিক অংশ যায় অফিসারদের বাড়িতে। কয়েদীরা সামান্য পায়। ওদের ঘৃণ্য চুরির ফলে কয়েদীদের কত কষ্ট হচ্ছে এবং অপুষ্টি হচ্ছে, তার সবিস্তার বর্ণনা দিলাম। ফল খুব ভালো হয়েছে বলে মনে হলো না। তবে এরপর ডিআইজি প্রিজন প্রতি সপ্তাহে একবার আসত। জেলারকে মনমরা দেখতাম। তাদের শাস্তি হয়েছে, তবে উচিত শাস্তি হয়েছে বলে মনে হলো না। 'পাবনা জেলে খুব বেশিদিন ছিলাম না। ওইখানে ১৯৭০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর আমি যাই। সেখানে আমার পরিবারের সঙ্গে নির্দিষ্ট সময় ব্যবধানে সাক্ষাতের বিধান সদ্ব্যবহার করতে না পেরে অসুবিধা হচ্ছিল। জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খানকে জানালে তিনি আমাকে বললেন, 'হোয়াট হেল্প ক্যান আই ডু ফর ইউ?' আমি বললাম, আমি তো এখানে থাকতে চাই না। কারণ আমার স্ত্রী ঢাকায় থাকে। ঢাকায় থাকতে সে জেলে আমাকে দেখতে আসতে পারত, এখন তো আসতে পারে না। এতদূর ট্রাভেল করে মাসে একবার, হয়তো দুই মাসে একবার আসে। এখানে থাকলে তো আসতে পারবে না। বিশেষ করে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বিশেষ অসুবিধা। '৬৫ সালের শেষের দিকে আমার চারটা বাচ্চাই জন্মগ্রহণ করেছে। তখন তো ৭০ সাল চলছে। সবচেয়ে ছোট বাচ্চাটার পাঁচ বছর বয়স, আমার সঙ্গে দেখা হলে ছোট বাচ্চাটা কোলে বসত, আরগুলো দাঁড়িয়ে থাকত। বললাম, আমি তাদের খুব মিস করি। 'আমার গাড়িটা ছিল মরিস মাইনর, জেলে যাওয়ার পর নিষিদ্ধ পণ্য 'মার্ক্সবাদী' পত্রিকা পরিবহনের অপরাধে বাজেয়াপ্ত হয় সরকার কর্তৃক। পরে যখন নিলামে তোলা হয়, তখন একজন বন্ধুর মাধ্যমে আবার কিনে নেই। ওই মরিস মাইনরটা নিয়ে ফ্যামিলি আমাকে দেখতে ঢাকা থেকে পাবনা আসত। ডিসি সাহেব বললেন, 'এটা তো কোনো ব্যাপারই না। আই অ্যাম দ্য ডিসি, আই শ্যাল টেল দ্য আইজি। আপনার দরখাস্ত দেওয়া আছে?' বললাম অনেকগুলো দরখাস্ত দেওয়া আছে। কোনো কাজই হয়নি। 'ইউ উইল গেট ট্রান্সফারড উইথইন সেভেন ডেইজ', বেশ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বললেন নূরুল কাদের খান। ব্যস, যেই কথা সেই কাজ। সাত দিনের ভেতর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আমার ট্রান্সফার অর্ডার হলো।
মানব চরিত্রের বিচিত্র পরিচয়
'জেলে যাওয়ার পর একটি ঘটনা ঘটল। আমার পরিবার ঢাকায় যে বাসায় থাকতো, সে বাসার বাড়িওয়ালা শ্রদ্ধেয় বুয়েট উপাচার্য ড. রশীদ। তিনি সঙ্গতকারণেই ভয় পেয়ে গেলেন যে, আমি নিয়মিত তাকে ভাড়া দিয়ে যেতে পারব কি না? না পারলে স্নেহাস্পদ ছাত্রের বিপদের সময় চাপও দিতে পারবেন না। সয়ে যেতে হবে তাকে- এটা জানার পর আমি পরিবারকে জানালাম দ্রুত বাড়ি ছেড়ে দিয়ে সস্তায় বাসা খোঁজ করতে। জিগাতলায় ট্যানারি মোড়ে দেড়শ' টাকায় একটা বাসা পাওয়া গেল। ড. রশীদের বাসার ভাড়া ছিল ৭০০ টাকা। ড. রশীদ মানসিক নিষ্কৃতি পাবেন, আমাদেরও সাশ্রয় হয়। অতপর আমার স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে ট্যানারি মোড়ের বাসায় উঠলেন। সেখানে কোনো রানিং ওয়াটার নেই। হাত টিউবওয়েল আছে। টয়লেটও এটাচড নয়। উঠান পার হয়ে টয়লেট। সেটা আমারই বাস্তুকলাবিদের একজন টাইপিস্টের বাড়ি। সেই হিসেবে নিজের পরিচিত লোক, কোনো অসুবিধা হয়নি।
'মানব চরিত্রের সংকীর্ণতা সর্বাধিক প্রকাশ পেল শ্বশুরের কাণ্ডে। তিনি মেয়েকে বললেন, 'তোমার স্বামী গেছে দেশ উদ্ধার করতে, মানুষের মুক্তি আনতে, এখন তুমি ঠেলা সামলাও।' জেলে থাকাকালীন তিনি একবারও আমার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেননি। অপরদিকে, আমার প্রকৌশলী শ্যালিকা খালেদা শাহরিয়ার ডোরা ও তার স্বামী প্রকৌশলী আমিনুর রহমান নিয়মিত জেলে আসতেন খবরাখবর নিতে ও তার বড় বু'র সংসারের প্রতি দৃষ্টি রাখতেন। জেলে ছিলাম ২ বছর ৯ দিন। প্রথম তো এক বছরের জেল হলো। সশ্রম দণ্ড বলে জেলে কাজও করতে হতো। আমরা যারা সেলবন্দি তাদের জন্য উপযুক্ত কাজ ছিল কম্বল থেকে সুতা বের করার কাজ। কম্বলগুলো পরিস্কার করার কথাও ছিল। ময়লা কম্বল কেটে কেটে দেয়া হতো, সেখান থেকে সুতা বের করতাম। ওই কাজটা আমি করে গেছি বিশ্বস্ততার সঙ্গে। কেউ এ কাজ না করলে মেট বা পাহারাদারদের দিয়ে করায়, কোনো বিনিময়ের বিপরীতে। আমি মেট বা পাহারাদারদের দিয়ে করাইনি, নিজেই করেছি। ফলে জেলকোড অনুসারে দুই মাসের একটা রেয়াত পেয়েছি।'
মুক্তিযুদ্ধে দুই সহোদর হত্যার খবর জেলখানায় 'পাবনা জেল থেকে আমাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হলো। পাবনা থেকে ঢাকা আনার কিছুদিনের মধ্যে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর আমাকে পাবনা জেলে নেয়া হয়। সেখানে পাঁচ মাস থেকে ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় আনা হয়। প্রায় ১ মাস পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা। আমি জেলখানা থেকেই খবরাখবর পেতাম। যখন আক্রমণ হলো, তখন এমনও হয়েছে যে, চকবাজারের মসজিদটা কেন্দ্রীয় জেলের সন্নিহিত হওয়ায় শুনতে পাই চকবাজারের মসজিদের ইমাম সাহেব মাইকে বলছেন, পাকিস্তান আর্মি আক্রমণ করছে। সবাই সাবধান হয়ে যান। অনেক লোক মারা যাবে। জেলখানা থেকে ইমাম সাহেবের যে ভাষণ শুনলাম, তাতে বোঝা গেল, তারাও খুব ভয়ে আছে। যে কোনো সময় পাকিস্তান আর্মি তাদের ওপর আক্রমণ করতে পারে। চকবাজারের ব্যবসায়ীদেরও সতর্ক করে দেওয়া হলো।
'৯ মাস ধরে যুদ্ধ হলো। তার সংবাদ জেলে খানিকটা পেতাম, কিন্তু আমাদের কিছু করার ছিল না। জুলাই মাসে শুনলাম, দৌলতপুরে আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে আমার দুই ভাইকে নিয়ে গেছে বাড়ি থেকে ১ মাইল দূরে মহেশ্বরপাশা ক্যান্টনমেন্টে। ঠিক সে সময়ে রাজাকার গঠিত হয়েছে। তাদের পরামর্শে আমার ভাইদের ধরে নিয়ে যায়। খুলনার দৌলতপুরে আমাদের প্রতিবেশী যারা রাজাকার ছিল তারা জানিয়েছে, ওরা বামপন্থী পরিবার। এদের একজন জেলে আছেন। বাড়িতে থাকা ছোট দুই ভাই ছাত্র ইউনিয়ন করে, একজন কলেজে পড়ে আর একজন হাই স্কুলে পড়ে। আমাদের বাড়িতে একজন হিন্দু ছাত্র আশ্রয় নিয়েছিল। রাজাকারদের সহায়তায় দৌলতপুরে আমাদের বাড়ি থেকে দুই ভাই ও আশ্রিত হিন্দু ছেলেসহ তিনজনকে ধরে নিয়ে পাকিস্তানি আর্মি হত্যা করল। স্কুলে পড়া ভাইটি রাজনীতির সঙ্গে অত যুক্ত ছিল না। কিন্তু কলেজে পড়া ভাইটি খুব সক্রিয়ভাবে ছাত্র ইউনিয়ন করত। আমার আব্বা ও মা বাড়িতে ছিলেন না। তারা একটা দাওয়াত খেতে গিয়েছিলেন যশোর জেলার এক জায়গায়। সেখান থেকে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে এসে দেখেন বাড়িতে সব অন্ধকার। জানলেন, তিনজনকে নিয়ে গেছে পাকিস্তান আর্মি। এটা একটু সবিস্তারে বলছি এজন্য যে, আমার পিতা খুব ধার্মিক ছিলেন। ধর্ম নিয়ে তার সঙ্গে আমার অনেক সময় তর্কাতর্কি হয়েছে। তিনি মহেশ্বরপাশা গিয়ে জানলেন ওদের হত্যা করা হয়েছে। দেখলেন, আমার দুই ভাইয়ের লাশ পানিতে ভাসছে। উনি লাশগুলো ফেরত চাইলেন। বললেন লাশগুলো দেন, আমি কবর দেই। কিন্তু তারা লাশ দুটো ফেরত দিল না। অতএব সেই দুটো লাশ পানিতেই ভাসতে থাকলো। এবং এই লাশ কোনোদিন সমাহিত হয়নি, না ধর্মীয় মতে, না সাধারণভাবে মাটি চাপা দিয়ে। এ ঘটনাটা আমার আব্বার চোখ খুলে দিল যে, আসলে এরা (পাকিস্তানি বাহিনী) ধর্মের নামে যে সমস্ত কথা বলে তার সব ভুয়া। আসলে বাংলাদেশকে যেন তাদের অধীনে রাখতে পারে, তাদের স্বার্থের জন্য বাংলাদেশকে শোষণ করতে পারে, তার জন্য তারা ধর্মের কথা বলে। তারা ভালো মুসলমান নয়। পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার্থে তারা ধর্মকে পুঁজি করেছে, মূলত ধর্মের প্রতি তাদের প্রকৃত শ্রদ্ধা নেই। একটা মুসলমানের যে আকাঙ্ক্ষা, মৃত্যুর পরে বাবা তার ছেলেকে জানাজা দিয়ে কবর দেবে, তারা সে সুযোগটুকুও দেয়নি। পাকিস্তানিদের এই বর্বর আচরণের ফলে ধর্মের প্রতি বাবার কিছুটা মোহভঙ্গ হয়ে গেলো। 'এসব জেলখানায় বসে শোনা। পরে যখন মুক্তি পেলাম, তখনও আমার পিতা জীবিত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর জেনারেল অরোরার দস্তখতের মধ্য দিয়ে সব রাজবন্দির মুক্তি দেওয়া হলো। আমি জেলারের কাছে দেখতে চাইলাম, অর্ডারটা জেলার দেখালেন। জেনারেল অরোরা স্বাক্ষরিত অর্ডার। শুধু রাজনীতিবিদরা মুক্তি পেল তা নয়, কার্যত জেল সবার জন্য উন্মুক্ত হয়ে গেল। ভেঙেচুরে জোর করেই জেলের সব বন্দি পালিয়ে গেল। পরে তাদের আংশিক ফেরত আনা গেছে। কিন্তু সবাইকে পায়নি। কিন্তু আমরা সত্যিকারের মুক্ত হয়ে গেলাম। প্রথমেই বাড়ি গেলাম। দেখলাম পিতা-মাতাকে। তারা যে দৃঢ় মনোবল নিয়ে ছিলেন সেটাই আশ্চর্যের বিষয়। মুক্তিযুদ্ধকালে আমার বড় ভাইয়ের মৃত্যু হয় হার্ট অ্যাটাকে। আব্বার মৃত্যু হয়েছে ১৯৭৭ সালে, মায়ের মৃত্যু হয়েছে ১৯৯৪ সালে।'
শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস প্রতিষ্ঠা
'মাজহারুল ইসলাম সাহেব ও আমি 'বাস্তুকলাবিদ' নামের স্থাপত্য প্রকৌশল ফার্ম সুন্দরভাবে চালাতাম। আমাকে যখন পাবনা জেলে নেওয়া হয়, তখন মাজহারুল ইসলাম আমাকে 'বাস্তুকলাবিদ' থেকে কার্যত বহিষ্কার করে দিলেন। সে সময় 'বাস্তুকলাবিদ' একটা বিদেশি আর্কিটেক্ট ফার্মের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করত। তখন একটা নিয়ম ছিল, যদি কোনো বিদেশি আর্কিটেকচারাল ফার্ম কাজ করতে চায়, তাহলে দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠানকে সহযোগী হিসেবে নিতে হবে। সে অনুসারে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের আইডিএর অধীন পঞ্চ পলিটেকনিক প্রজেক্টে বিদেশি ফার্মটা ছিল প্রিন্সিপাল আর 'বাস্তুকলাবিদ' ছিল তার সহযোগী। সেই বিদেশি আর্কিটেকচারাল ফার্মের যিনি মালিক স্টানলি টাইগারম্যান তিনি ঢাকায় এসেছেন। তাকে নিয়ে মাজহারুল ইসলাম সাহেব পাবনা জেলে যান। জেলে গিয়ে একটি দলিল আমার সামনে দিলেন সই করতে, বিনা বাক্য ব্যয়ে সই করলাম ও 'বাস্তুকলাবিদ' থেকে বিযুক্ত হলাম। কারাগারে বন্দি হিসেবে আমি অংশীদার থাকলে আইনগত কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু তার একটা ভয় ছিল, যেহেতু আমি একজন পার্টনার, পার্টনার হিসেবে আমি কাজ করতে পারি আর না পারি আমার প্রফিটের শেয়ার ঠিকই পাব। যদিও নৈতিক অবস্থানে থেকে আমি প্রফিটের অংশ নিতাম না। কিন্তু তিনি সাবধান হতে চাইলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ভারতে যান, তখন ফার্মের স্থপতি প্রকৌশলী ও অন্যান্য কর্মচারী ফার্মের কাজ চালিয়ে যান। মাজহারুল ইসলাম মনে করলেন আমাদের কনট্রিবিউশন ছাড়াই তো নিচের লোকেরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, কিছু প্রফিটও হবে। সেই প্রফিটের অংশ যাতে আমি না নিতে পারি, সে জন্য তিনি এই ব্যবস্থা নিলেন। কারণ পার্টনারশিপ চুক্তিতে কোথাও পার্টনারের লভ্যাংশ তার সময়দান ও পরিশ্রমের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। উনি অবশ্য একটা কাজ করেছিলেন। পাবনা জেলেই বলেছিলেন, আপনাকে একেবারে বঞ্চিত করতে চাই না। আপনার নামে 'শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস' এই নামে একটা ফার্ম করে দিচ্ছি। আমি বললাম তাতে কি হবে? যত ইঞ্জিনিয়ার আছেন আমার, তারা ওই একাউন্টেই বেতন পাবে। তারা কাজ করবে। আমাদের কাজের ইঞ্জিনিয়ারিং অংশ সেটা শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস করবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা চালাবে কে? তখন আমার একজন ভায়রা ভাই ছিলেন, তিনিও একজন ইঞ্জিনিয়ার এবং কনসালট্যান্সি করেন, তিনি চালাবেন। বললাম ঠিক আছে। এভাবেই শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের জন্ম হয়, আমার পাবনা জেলে থাকাকালীন। এ ক্ষেত্রে মাজহারুল ইসলাম সাহেব একটা ভালো ভূমিকা নিয়েছিলেন।
'জেল থেকে বের হয়ে আবার একসঙ্গে কাজ করতে চাইলাম, বললাম 'বাস্তুকলাবিদ' আবার একসঙ্গে করি, তিনি না করে দিলেন। বললেন, আপনি আলাদা করেন। তার হয়ত একটা ধারণা ছিল যে, আর্কিটেক্টদের যে অংশ তাতে খাটনি কম, কিন্তু আয় বেশি। খাটনি বা ব্যয়ের অংশটা ইঞ্জিনিয়ারিং সেকশনে বেশি। বাস্তুকলাবিদে আমার শেয়ার ছিল ৪০%, তার ছিল ৬০%। আমি ছিলাম ওয়ার্ক হর্স। কাজ করতাম আমি সবচেয়ে বেশি। স্থপতি হিসেবে অত্যন্ত উঁচু মানের ছিলেন তিনি। শুধু আর্কিটেকচারে মূল ডিসিশন দেওয়ার পরে আর খুব বেশি টাইম দিতেন না। তিনি রাজনীতিতেও সময় দিতেন। উনি তখন মোজাফফর ন্যাপের সঙ্গে ছিলেন। এভাবেই আমরা আলাদা হলাম। কাজ এ রকম ভাগ করেই হতো। বাস্তুকলাবিদের নামে যত পুরাতন কাজ ছিল, তার আর্কিটেকচার অংশটা উনি করতেন আর আমরা ডাউন স্ট্রিমের ইঞ্জিনিয়ারিং অংশটা এবং অবশিষ্ট অন্য কাজগুলো করতাম। এক বছরের মধ্যে আমি সম্পূর্ণ কাজ অন্যত্র যোগাড় করতে লাগলাম। সেখানে আর্কিটেকচারসহ পুরো কাজ আমি করতাম। আবার উনিও তার নুতন ইঞ্জিনিয়ারিং কাজের অংশগুলোর সবই যে আমাকে দিতেন তাও নয়। 'উনি নিজে পার্টটাইম ইঞ্জিনিয়ার রেখে প্রকৌশল কাজ করতেন। ফলে পরিষ্কারভাবে আলাদা দুটি ফার্ম হয়ে গেল। উনি যেহেতু একা এবং বেশি পরিশ্রমী ছিলেন না, তাই তাঁর কাছে নতুন ক্লায়েন্ট কেউ যেতে চাইত না। কাজ একবার নিয়ে টাইম মতো সার্ভিস ডেলিভারি না দিলে দ্বিতীয়বার আর কেউ আসতে চায় না। ফলে তার একক কর্তৃত্বের ফার্ম 'বাস্তুকলাবিদ' আস্তে আস্তে কর্মহীন হতে লাগল। অবশেষে বাস্তুকলাবিদ অচল হয়ে গেল। আমরা যেহেতু পরিশ্রম করে খাই, আর বিশেষ করে আমি খুব পরিশ্রম করি, ফলে আমাদের শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের কাজ অনেক বেশি আসতে লাগল এবং আমরা উন্নতি করতে থাকলাম। এ কথাটুকু এ জন্যই বললাম যে, উনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে 'বাস্তুকলাবিদ' শুধু টিকে থাকতই নয়, উন্নতিও করতে পারত।'
অন্যভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া প্রকৌশলী শহীদুল্লাহ আনুষ্ঠানিকভাবে কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য না হলেও সবসময় রাজনীতির সঙ্গে থেকেছেন, সমর্থন দিয়েছেন, সহযোগিতা করেছেন। তাঁর ভাষায়- 'আমি কোনো সময় রাজনীতি থেকে বিযুক্ত ছিলাম না, আবার সম্পূর্ণভাবে সম্পৃক্তও হয়ে যাইনি। আমার প্রধান কর্মক্ষেত্রে হচ্ছে আমার প্রফেশনের কাজ। প্রফেশনে কাজ করে বাড়তি যে আয়টা থাকে, বাড়তি যে সময়টা থাকে, সেটা সম্পূর্ণভাবে দেশের যাতে কল্যাণ হয়, তাতে ব্যয় করি। দেশের কল্যাণের জন্য মাদ্রাসা খুলে, এতিমখানা করলে তো হবে না। যে বিরাট পাম্প, পাম্প করে গরিবদের রক্ত শোষণ করে ধনীদের রক্তস্ফীতি ঘটিয়ে বিকারগ্রস্ত করছে, দ্যাট পাম্প হ্যাজ টু বি স্টপড। মানব জাতির কল্যাণের জন্য যে সমাজ-ব্যবস্থা, রাষ্ট্র- ব্যবস্থা দরকার, অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, তা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে বর্তমান শ্রেণি শোষণে নিয়োজিত রাষ্ট্রশক্তিকে উৎখাত করে। এই কাজে যে সব বামপন্থী রাজনৈতিক দল নিবেদিত আছে তাদের বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করা, আর্থিক সাহায্য করাও বড় কাজ। যদিও সিংহভাগ সময় আমি দিয়েছি প্রফেশনে, কিন্তু যেটুকু সময় বাঁচে, যেটুকু অর্থ বাঁচে, সেটা ব্যক্তিগত ভোগের কাজে না লাগিয়ে, আমি সব সময় এটা করেছি।'
সততার অগ্নিপরীক্ষা
কাজ যোগাড় করতে ঘুষ দেওয়া-না দেওয়ার বিরোধে শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস ভেঙে যায়। জন্ম হয় শহীদুল্লাহ অ্যান্ড নিউ অ্যাসোসিয়েটস। অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, 'অনেকে দুর্নীতি করে কাজ জোগাড় করে, সেটা আমি কিছুতেই করব না। কিন্তু তবুও আমি কাজ পাই, তা হয় কি করে? সেটা হচ্ছে মেধার জন্য। মেধা, বিশ্বস্ততা এবং পরিশ্রম- এগুলো আমার মূলধন। ১৯৯৮ সালে আমাদের কোম্পানি দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। কেন? আমার যত এমপ্লয়ি ছিল, তাদের মধ্যে সম্ভাবনাময় লোকদের ডাইরেক্টর করেছি। আমি কোনো আত্মীয়স্বজনকে ডাইরেক্টর করিনি। আমার যারা কর্মচারী ছিল, তাদের প্রমোশন দিয়ে ডাইরেক্টর করেছি, শেয়ারহোল্ডার ডাইরেক্টর। তাদের কোনো
ক্যাপিটালও লাগেনি। ক্রমে ক্রমে আমাদের প্রতিষ্ঠান যখন উন্নতি করেছে, তখন ক্রমান্বয়ে এমপ্লয়ি থেকে শেয়ারহোল্ডার ডাইরেক্টর বানিয়েছি। এই উদারতাই আমার কাল হলো। যাদের কর্মচারী থেকে শেয়ারহোল্ডার করেছি, তারা সৎ সীমাবদ্ধ প্রফিটে সন্তুষ্ট থাকতে চাইলেন না। তারা বললেন, 'আপনার নীতি আমরা মানি না। কাজ জোগাড় করার জন্য কোনো পয়সা দেবেন না, তা চলবে না। পয়সা দিয়ে কাজ নিতে হবে।' আমি বললাম, পয়সা দিয়ে কাজ নেয়ার জন্য আমার জন্ম হয়নি। আমার আব্বা খুবই সৎ লোক ছিলেন, আমি নিজেও সৎ। পয়সা দিয়ে কাজ আমি নেব না। তখন তারা বলেন যে, এভাবে কাজ বেশি পাওয়া যাবে না। আমি বললাম, যা পাওয়া যায় তাতে তো চলছে। আপনাদের সবার ব্যবস্থা তো করছি। তারা তা মানলেন না। 'কিছুদিন চলার পর একটি ফর্মুলাতে সবাই একমত হলাম। ফর্মুলা এরূপ- ঘুষ ছাড়া আমি যে কাজ জোগাড় করব, তার শেয়ার আমরা সবাই পাব। অন্যেরা পয়সা দিয়ে যে কাজ জোগাড় করবেন তার শেয়ার আমি পাব না। এভাবে দ্বৈত একাউন্টিং শুরু হলো। এক বছরের মধ্যে দ্বৈত একাউন্টিং করে দেখা গেল, অসুবিধা হয় কে কোন অংশ কতটুকু কাজ করছে বলা মুশকিল। তখন তারা বলল, 'তাহলে আপনি চলে যান।' আমি বললাম আমি চলে যাব মানে কী? আমি শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস-এ থাকব। তারা বলল, 'না। এ নামটা আমাদের ব্যবহার করতে দিতে হবে। তা না হলে আমরা কাজ পাব না।
'আমি অত্যন্ত উদারতার সঙ্গে বললাম যে, আপনারাই শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসে থাকেন। আমি শহীদুল্লাহ অ্যান্ড নিউ অ্যাসোসিয়েটস গঠন করি। এটা লিটারালি সত্য এবং কোম্পানির নামও সত্য। নিউ অ্যাসোসিয়েটসে একজন পরিচালক হিসাবে আসলেন, তিনি হলেন ড. রশীদ। শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসে সর্বশেষ যোগদানকারী পরিচালক। তিনি ছিলেন রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রিন্সিপাল। ছাত্রদের বেয়াদবিতে চাকরি থেকে রিজাইন দিয়ে ট্রেনে উঠলেন। পরে ছাত্ররা তাকে ট্রেন থেকে নামিয়ে আনার অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু তিনি ছিলেন একগুঁয়ে ধরনের লোক। আর ফিরে যাননি, চলে এলেন। এসে প্রথম তিনি এমপ্লয়ি হিসেবে যোগদান করেন, পরে আমি তাকে ডাইরেক্টর করি। ডাইরেক্টর করার সময় অন্য ডাইরেক্টকরা অবজেকশন দিয়েছিল। আমি বললাম, তিনি আপনাদের চেয়ে বেশি প্রোডাক্টিভ। আমার ডাইরেক্টরদের মধ্যে আর তো কোনো পিএইচডি নেই। তিনিই একমাত্র পিএইচডি হোল্ডার। এবং তিনি রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সাবেক প্রিন্সিপাল। তাকে ডাইরেক্টর করতে অসুবিধা হবে কেন? তাদের মতের বিরুদ্ধে হলেও আমি তাকে ডাইরেক্টর করি। মজার ব্যাপার- একমাত্র আমি এবং ড. রশীদ শহীদুল্লাহ অ্যান্ড নিউ অ্যাসোসিয়েটসে এলাম। আমরা দুইজন ডাইরেক্টর এখন শহীদুল্লাহ অ্যান্ড নিউ অ্যাসোসিয়েটস চালাচ্ছি। শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসে রয়ে গেলেন ছয়জন মূল ডাইরেক্টর। 'মেধা থাকলে পরিশ্রম করলে এবং বিশ্বস্তভাবে সেবাদান করলে সততার সঙ্গে জীবিকা নির্বাহ করা যায়। বর্তমানে আমার কাছে একটিও সরকার প্রদত্ত কাজ নাই। সরকার কাজ দেবে কেন? তারা তো যেখানে টাকা মিলবে, সেখানেই কাজ দেবে। আমাদের প্রতিষ্ঠান ভাঙলোও এই প্রশ্নে। বিশেষ করে সরকারের সিএমএমইউ বলে একটা ইউনিট আছে যাদের বৃহৎ কাজ বিদেশি বিনিয়োগের অর্থে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা খাতে বিল্ডিংয়ের নির্মাণ। দুর্নীতির একদম বড় আখড়া। আমাদের ডিরেক্টররা বললেন, ওখানে পয়সা না দিলে কাজ পাওয়া যাবে না। আমি বললাম কাজ পাওয়া না গেলে না পাব। এত বড় কাজ হাতছাড়া হয়ে যাবে। আমি বললাম, পয়সা দিয়ে কাজ নেবো না। বললাম, আপনারা এত টেনশনে থাকেন কেন? তাঁরা এখন সিএমএমইউ নির্ভর। ভাগ্য অনেক সময় খারাপ হয়। শেষের দিকে বিদেশিরা সাহায্য কমিয়ে দিল। সিএমএমইউর গরম অবস্থা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। যাঁরা সিএমএমইউর কাজের অর্থাৎ দুর্নীতির ওপর নির্ভরশীল ছিলেন তাঁদের ভাগ্য খারাপ হতে লাগল। এই ভাগ্য বিবর্তনে শহীদুল্লাহ অ্যান্ড নিউ অ্যাসোসিয়েটস আনটাচ্ড্। আমাকে তো সিএমএমইউ কোনোদিন কাজ দেবে না।
'আমার প্রধান ক্লায়েন্ট সবই বেসরকারি। আধা সরকারী কিছু আছে। কখন, যখন একেবারে ট্রাবল শুটিংয়ের কাজ হয়। যেখানে সাধারণ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে হবে না। কনসালট্যান্সি করি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে। যখন তারা ফেল করে, তখন আমার কাছে আসে। যখন কোনো বড় সমস্যা হয়, তখন দৌড়ে আসে, বলে- আপনি এ কাজটা করে দেন। ট্রাবল শুটিং ছাড়া বা জটিল সমস্যা ছাড়া সরকারি, আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানের কেউ আমার কাছে সেবা গ্রহণ করে না।
'অতএব, একটা পেশাদারী সংস্থার যদি পেশাগত যোগ্যতা থাকে, তাহলে সরকারি কাজ ছাড়াও বেসরকারি কাজের মাধ্যমে সে বাঁচতে পারে। আমি ১৯৯৮ সাল থেকে আলাদা হয়েছি। বাংলাদেশ অক্সিজেন কোম্পানি বা বিওসির কাজ করেছি। বাংলাদেশ বিমানের কাজ করেছি। বিমানকে কী বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছি, তা তারা নিজ মুখেই বলে। কাজ শেষ হওয়ার পর তারা আমাকে বলেছে, 'বুয়েট এবং কনকর্ড মিলে তাদের কাছে চেয়েছিল এক কোটি দশ লাখ টাকা আর আপনি চাইলেন মাত্র ৩৭ লাখ টাকা। আপনি যদি ৯০ লাখ টাকাও চাইতেন, আমরা তাও দিতাম।' আমি বললাম, আমি সৎভাবে কাজ করতে চাই, যা লাগবে তাইতো চাইব। মানিকগঞ্জে মুন্নু ফ্যাব্রিক্সের পুরো বিল্ডিং কলাপস করতে যাচ্ছিল। মুন্নু সিরামিকসের মালিক হারুনুর রশিদ মুন্নু আমার কাছে পাঁচ লাখ টাকা রেখে বললেন- 'এটা প্রাথমিক ফি, আপনি দয়া করে কাজ শুরু করুন। বাকি যা লাগবে আমি সব দেব।' মানিকগঞ্জের কালীগঙ্গা নদীর কাছে ওই বিল্ডিং। ৪ লাখ বর্গফুটের বিরাট বিল্ডিংয়ের কয়েকটি কলাম কলাপস করতে যাচ্ছিল। তারা প্রথমে গেল বুয়েটে প্রফেসর ড. শামিমুজ্জামান বসুনিয়ার কাছে। ড. শামিমুজ্জামান তৎক্ষণাৎ আমার কাছে পাঠালেন। আমার ব্যবস্থ্য মতে কাজ করায় এই বিরাট বিল্ডিং ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে রক্ষা পেল। এরপর মেঘনাঘাট পাওয়ার স্টেশন ফাউন্ডেশনের কাজ এলো। এটা পিডিবির কাজ কিন্তু তারা পারেনি বলে আমার কাছে এসেছে। ঢাকা রিভার ক্রসিং টাওয়ার ফাউন্ডেশনটা আমাদের করা। ওল্ড শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসে থাকাকালে পিডিবি থেকে আমার কাছে বহু কাজ এসেছিল। সেটার সূত্র ধরে এখনো নতুন ফার্মেও আসে। মূলত সিভিল কনসালট্যান্সির কাজ করি। আবার কনস্ট্রাকশনের কাজও করি। জটিল কনস্ট্রাকশনের কাজও আমরা করি। আবার অনেক কাজ ডিফিকাল্ট, কেউ করতে পারছে না, তখন আমার কাছে নিয়ে আসে। যেমন করেছি ফ্যাশন ফেব্রিক্স আশুলিয়া, সেখানে একটা বিরাট বিপদ ঘটে যাচ্ছিল, সব ভেঙে-চুরে পড়ে যাচ্ছিল। আমাকে নিয়ে গেল, সমাধান করে দিলাম। তারা ইতিপূর্বে বুয়েটের কাছে গিয়েছিল। আসলে কিছু হলে সবাই বুয়েটের কাছে দৌড় দেয়। শুধু একটা সমাধান দিলে তো হবে না। কাজও তো করতে হবে। বুয়েট তাই প্রায় সবক্ষেত্রে এসব কাজ আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়।'
আন্দোলনে নেতৃত্বদান সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ান শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ যেসব আন্দোলনে সংগঠক হিসাবে সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন বা অংশগ্রহণ করেছেন, তার মধ্যে ভিসামুক্ত বিশ্ব আন্দোলন, তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ এবং প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলন উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ রক্ষার আন্দোলনকে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এবং যথেষ্ট সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়েছেন।
ভিসামুক্ত বিশ্ব আন্দোলনের বক্তব্য ছিল: 'পৃথিবী একটাই, মানবজাতি একটাই। যেখানে কাজ আছে সেখানেই মানুষের কাজের অধিকার থাকা উচিত। কিন্তু পৃথিবীর সব মানুষ ভিসার দ্বারা বিভক্ত। যেহেতু পুঁজি বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগ হয় সুতরাং শ্রমিকেরও বিশ্বব্যাপী কাজের সুযোগ থাকা উচিত।' বিশ্বব্যাংকের কাছে তাঁরা যে স্মারক লিপি পাঠিয়েছিল তাঁর ভাষ্য ছিল- 'আমরা মানব জাতি বিশ্ব মোদের বসতি; বিশ্ব মানবতা জিন্দাবাদ, জয় হোক, ক্রেতা আছে যে দেশে পণ্য যায় সে দেশে, জমি আছে যে দেশে শ্রমিক যাবে সে দেশে; ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব চাই- বিশ্বব্যাপী আবাদ চাই; দারিদ্রমুক্ত বিশ্ব চাই- সকল মানুষ বাঁচতে চাই।' শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, 'বিশ্বব্যাংক আমাদের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করলেও তাঁরা বলেছিল, 'আমরা কতগুলো নিয়মনীতির দ্বারা আবদ্ধ, সুতরাং আমাদের এ বিষয়ে কিছু করার নেই। আপনারা এমন আন্দোলন করেন, যাতে নীতি পরিবর্তনে আমরা বাধ্য হই।' এই আন্দোলনে তেমন ফলাফল আসেনি।' তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষার আন্দোলন বাংলাদেশের অর্থনীতি, প্রাণ-প্রকৃতি এক কথায় অস্তিত্বের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই আন্দোলনে শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর অংশগ্রহণ ও ভূমিকা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থ দিয়ে, নেতৃত্ব দিয়ে, সাহসের সঙ্গে আন্দোলনকে সক্রিয় রেখেছেন। এই সংগঠন গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া এবং এর কর্মকাণ্ড নিয়ে শহীদুল্লাহ বলেন- 'সিলেটের বিবিয়ানা কূপ থেকে যখন প্রাকৃতিক গ্যাস ভারতে প্রায় বিনা পয়সায় পাচার হতে যাচ্ছিল, তখন সব বাম রাজনৈতিক দল প্রতিবাদী আন্দোলন শুরু করল যার যার নিজস্ব ব্যানারে। প্রত্যেকে এককভাবে আন্দোলন করে যা ফল হয় সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করলে সিনারজেসটিক ইফেক্ট (Synergestic Effect) এর দরুণ ফল অনেক বেশি বেড়ে যায়। তাই সব দলই ঠিক করল, এক পতাকার তলে আন্দোলন করবে। ১৯৯৮ সালের এপ্রিল মাসে প্রথম সিটিং হয়। আমাকে আহ্বায়ক হিসেবে প্রথম অ্যাপ্রোচ করলেন রাশেদ খান মেনন। আন্দোলনের লক্ষ্যে তিনি সবাইকে নিয়ে একটি কমিটি করার প্রস্তাব করলেন। তখন নাম হলো- জাতীয় স্বার্থে তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটি। ১১ দলের পক্ষ থেকে আমাকে আহ্বায়ক করার প্রস্তাব আসে। আমি সম্মত ও আগ্রহী হই। কোনো নির্দিষ্ট বাম দলের সঙ্গে যেহেতু আমি যুক্ত নই, সদস্যও নই, তাই সব বাম রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমার সমান দূরত্ব বা নৈকট্য। তাছাড়া আমার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার, নিরপেক্ষতার, সততার ব্যাপারেও সুনাম আছে। অতএব আমি ছিলাম আদর্শ চয়েস।
কিন্তু ড. কামাল হোসেনও এই পদের জন্য আগ্রহী ছিলেন। ' উনি দিলেন বাগড়া, উনি হতে চান। আমার মনে আছে, আমাকে রাশেদ খান মেনন বললেন, 'আপনি কাছাকাছি থাকবেন।' প্রেসক্লাবের সামনে সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে একটা বড় মিটিং হয়েছিল, সেখানে বহু লোক ছিলেন। ড. কামাল হোসেন ঐ মিটিংয়ে সভাপতিত্ব করছিলেন। আহমেদুল কবীর তখন বেঁচে ছিলেন। তিনি পাইপ খাচ্ছেন আর দূরে ঘাসের জমিতে পদচারণা করছেন একা, হি ওয়াজ এলোন, তার পুরো অভিজাত্যবোধ নিয়ে। আমার সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব ছিল। তিনি বললেন, 'এই শহীদুল্লাহ, এদিকে এসো। দেখ, তোমাকে আহ্বায়ক করার কথা হচ্ছে। তুমি এর ভেতরে যেয়ো না।' আমি বললাম, আমি অবশ্যই যাবো। তারা যদি আমাকে ডাকেন, আমি অবশ্যই যাব। কেন? কারণ আই ক্যান কনট্রিবিউট। আমি মনে করি, আর কোনো দ্বিতীয় ব্যক্তি নাই, আমার মতো নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবে, আর কারও পক্ষে তা সম্ভব হবে না। অতএব, আমাকে চাইলে আমি তো আপত্তি করব না। এতে উনি বেশ নিরাশ হলেন। 'এ মিটিংয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো না। কারণ, ড. কামাল হোসেনের আগ্রহ সব দলের সমর্থন পেল না। প্রথম মিটিংয়ের কয়েকমাস পরে ডিসেম্বর মাসে আবার বসল। ১১ দল বিহাউন্ড দ্য সিন ড. কামাল হোসেনকে হয়তো বুঝিয়েছে, অন্যলোক হওয়াই ভালো। উনি তো তখন গণফোরাম বলে একটা রাজনৈতিক দলের আহ্বায়ক। অতএব রাজনৈতিক দলের ভেতর থেকে না করে বাইরে থেকে কাউকে এই তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক নেওয়া ভালো। উনি এতে সম্মত হলেন। মিটিং শেষে আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বললেন, আমি আশা করি আপনি ভালই চালাতে পারবেন। এইভাবে জন্ম নিলো জাতীয় স্বার্থে তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটি আর আমাকে করা হলো আহ্বায়ক। সদস্য সচিব করা হলো অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশকে। 'আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ড. কামাল হোসেন এরপর এই
আন্দোলনের প্রতি সামান্যতম উৎসাহ দেখাননি। ১১ দলের প্রত্যেক দলের প্রতিনিধিদের সদস্য করা হলো। ১১ দলের বাইরে বেশ কয়েকটি সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠনবিরোধী গ্রুপ ও ব্যক্তিত্বকে সদস্য করা হলো, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। এম.এম আকাশ সাহেবের বিদেশ গমনের পর সদস্য সচিবের পদ কিছুদিন শূন্য থাকল। পাঁচ মাস সময় লাগল তার জায়গায় ড. মহিউদ্দিনকে স্থলাভিষিক্ত হতে। ড. মহিউদ্দিন অত্যন্ত ভালো লোক, খুবই সিনসিয়ার। তিনি অনেকগুলো কাজ হাতে নিতেন, ফলে সব কাজে সমান মনোনিবেশ করতে পারতেন না। একই সময়ে তিনি অধ্যাপনা করতেন, কোনো ক্লাস ফাঁকি দিতেন না। আবার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনেও বিভিন্ন পদে থাকতেন। সেখানেও যথেষ্ট সময় দিতেন। এতগুলো কাজে সময় দিতে গিয়ে তেল-গ্যাস কমিটির কাজে সময় দিতে পারতেন না। ফলে আমি যখন শুরু করলাম আমাকে সিঙ্গেল হ্যান্ডলি কাজ করতে হয়েছে। ২০০২ সালের ৩ জানুয়ারি ওসমানী উদ্যানে জাতীয়ভিত্তিক একটি বিরাট গণকনভেশন অনুষ্ঠিত হয়। সেই কনভেশনে আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি বিশদভাবে প্রস্তুত করা হয়। ২০০৪ সালে ড. মহিউদ্দিন সাহেবের মৃত্যুর পর অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ২০০৫ সালে সদস্য সচিবের দায়িত্ব নেন। সদস্য সচিব হিসেবে তাঁর অবদান অপরিসীম। জাতীয় কমিটির উদ্যোগে জনগণকে সংগঠিত করে ১১টি লংমার্চ, রোডমার্চ ও জনযাত্রা সংঘটিত করার মাধ্যমে আমাদের আন্দোলনের সাফল্য এসেছে ও জনগণের মাঝে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে।
'এই আন্দোলনের সফলতার দিক হলো- বিবিয়ানা থেকে ভারতে গ্যাস পাচার বন্ধ করা গেছে। এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে এখন দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে সিংহভাগ গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা গেছে। ২০০০ সালের দিকে সরকার চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্গমনের মুখে গভীর সমুদ্রে একটি অখ্যাত মার্কিন কোম্পানি এসএসএ'র (Stevedoring Services of America) কাছে কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণের জন্য ৯৯ বছর করে দুই পর্বে মোট ১৯৮ বছরের জন্য ২১১.৬৪ একর জমি হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং ভবিষ্যতে তারা এই টার্মিনাল সম্প্রসারিত করতে চাইলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমির মালিকানা দেয়ারও শর্ত ছিল ঐ চুক্তিতে। এটা ছিল চট্টগ্রাম বন্দর ধ্বংস প্রকারান্তরে বাংলাদেশের সঙ্গেই শত্রুতামূলক চুক্তি। ওই চুক্তির বিরুদ্ধে মামলা হলে আদালত তা অবৈধ ঘোষণা করে। গণ-আন্দোলনে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ফুলবাড়ী কয়লাখনি বাতিলের মধ্য দিয়ে ফুলবাড়ীসহ পার্শ্ববর্তী ৪টি উপজেলা ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষাসহ প্রাকৃ তিক বিপর্যয় ও মরুকরণ প্রক্রিয়া থেকে রক্ষা করা গেছে। যদিও ফুলবাড়ী কয়লাখনি নিয়ে এখনো রাষ্ট্রীয় ও সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র অব্যহত আছে। বিশ্ব ঐতিহ্য, বাংলাদেশের ফুসফুস ও রক্ষাবর্ম সুন্দরবন ও প্রাণ প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যথেষ্ট আলোচিত। এই আন্দোলন এখনো অব্যহত আছে।' বাংলাদেশে প্রকৃত অর্থে কোনো উন্নয়ন হচ্ছে কিনা সে প্রশ্নের জবাবে জনাব শহীদুল্লাহ বলেন- 'এখানে ধনীদের উন্নয়ন হচ্ছে। যে শ্রেণি ক্ষমতায় থাকে সেই শ্রেণির উন্নয়নকে তারা দেশের উন্নয়ন বলে। শ্রেণি বিভক্ত সমাজে যে শ্রেণি শাসন-শোষণের অধিকারী তাদের উন্নয়ন হয়, সেই অর্থে এখানেও তাদের উন্নয়ন হচ্ছে।' বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা এবং এ থেকে মুক্তির উপায় সম্পর্কে শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মূল্যায়ন হলো- 'এখানে এক কথায় বললে প্রবল দুর্বলের ওপর শোষণ করছে, লুণ্ঠনের এ সুযোগ তারা ছাড়বে না। প্রবল-দুর্বলের লড়াইয়ে প্রবলরা জিতে যাচ্ছে। দুর্বলদের অর্থ নেই, তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল রাজনীতি শক্তিশালী না হলে তারা হেরে যাবে। এর একমাত্র প্রতিকার সচেতনতা ও বিদ্রোহ, দেশব্যাপী আন্দোলনে একতাবদ্ধ হওয়া। দরিদ্র মানুষের এটাই শক্তি। কাজটি বাস্তবায়ন খুবই কঠিন। বাস্তবায়ন যারা করতে গিয়েছিলেন, তারাও অনেক সময় বিতর্কিত হয়েছেন, ভুল লাইন গ্রহণ করেছেন। প্রবলরা অনেক ফন্দি জানে। নীতি আদর্শ বিভ্রান্ত করার জন্য প্রবলপক্ষ আর্থিকসহ যা করা যায়, তা সবই করছে। জনগণের জন্য কল্যাণকর কর্মসূচি প্রবলদের জন্য বিরোধাত্মক। যেখানে দুর্বল বিদ্রোহ করতে পারে না, সেখানে শোষণ-নির্যাতন চলবে। একতাবদ্ধ হয়ে প্রবলের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন, সংগ্রাম, বিদ্রোহ ইত্যাদির দ্বারা ক্ষমতাসীন শ্রেণিকে উচ্ছেদ করে ক্ষমতার পরিবর্তন করেই কেবল দুর্বল তার এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে পারে।'
সহায়ক তথ্য: সাপ্তাহিক ২০০০ এর ঈদ সংখ্যা ২০০৭।