
সাঁতাও সিনেমার পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত
২৭ জানুয়ারি দেশের ৫টি হলে মুক্তি পেয়েছে গণঅর্থায়নের সিনেমা ‘সাঁতাও’। ২০ জানুয়ারি একবিংশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমাটির বাংলাদেশ প্রিমিয়ারে দর্শকের উপচে পড়া ভিড় দেখা গিয়েছিল। উৎসবে ‘বাংলাদেশ প্যানোরমা’ বিভাগে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে ফিপ্রেসি পুরস্কারও জয় করেছে সিনেমাটি। হলে মুক্তি পাওয়ার পরও দর্শকের বেশ ভালো সাড়া মিলছে।
৮০-এর দশক থেকেই গণঅর্থায়নে সিনেমা তৈরির ধারা শুরু হয়েছিল পৃথিবীজুড়ে। বাংলাদেশে বেশকিছু গণঅর্থায়নের সিনেমা বানানো হলেও ‘সাঁতাও’ এক ভিন্ন মাত্রা তৈরি করেছে সিনেমার গতানুগতিক ধারায়। শুধু নির্মাণেই নয় সিনেমার প্রচারে গণমানুষের সম্পৃক্ততা ছিল চোখে পড়ার মতো।
সিনেমার প্রযোজক, পরিচালক, অভিনয় শিল্পী, কলাকুশলীরা বিভিন্ন স্থানে লিফলেট বিলিয়েছেন, পোস্টার লাগিয়েছেন, জনসংযোগ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রচারণার জন্য ট্রেইলার, গান, ভিডিও কন্টেন্টগুলো ছিল কপিরাইট মুক্ত, যেন সাধারণ মানুষ সেটা ব্যবহার করতে পারে। ফলে অসংখ্য মানুষ নিজে থেকেই প্রচারণা চালিয়েছে সিনেমার।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন যাপন, কৃষকের সংগ্রামী জীবন, নারীর মাতৃত্বের সর্বজনীন রূপ এবং তিস্তাপাড়ের সুরেলা জনগোষ্ঠীর সুখ-দুঃখ, হাসি কান্নার গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘সাঁতাও’। এমন একটি আটপৌরে গল্প, যেখানে চরিত্রগুলো গ্রামের কৃষক এবং সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, সংকট যেখানে গ্রামের মহাজন, এনজিওর ক্ষুদ্রঋণ এবং ভূ-রাজনীতি; সেখানে অর্থ লগ্নিকারক খুঁজে পাওয়া দুরূহ। যদিও বা পাওয়া যায় সেখানেও গল্প লগ্নিকারকের মনমতো উপস্থাপনের চাপ তৈরি হয়।
লগ্নির মুনাফা নিশ্চিত করার জন্য অপ্রয়োজনীয় চাকচিক্য, স্থূল বিনোদন সংযুক্ত করার প্রবণতা তৈরি হয়। গল্পটাকে নিজেদের দেখা বাস্তবতার মতো করে পর্দায় হাজির করার তাগিদেই বেছে নেওয়া হয়েছিল ‘গণঅর্থায়ন’-এর পথ। হাজার মানুষের আর্থিক সহায়তার সঙ্গে অভিনেতা-অভিনেত্রী, কলা-কুশলীদের আন্তরিক সহযোগিতায় নির্মিত হয়েছে ‘সাঁতাও’।
গণমানুষের অর্থে গণমানুষের জীবনের গল্পে চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে এসেছিল যেখানে চলচ্চিত্রটির শুটিং হয়েছে সেই তিস্তা বাজারের সাধারণ মানুষ। কেউ শুটিং সেটের জন্য নিজের বসতভিটা ছেড়ে অন্যত্র কষ্ট করে থেকেছে, পুরো শুটিং ইউনিটের সদস্যদের থাকার জায়গা দিয়েছে, রান্না করে খাইয়েছে। ২০১৮ সালে শরিফ উল আনোয়ার সজ্জন, খন্দকার সুমন এবং মানিক বাহার উদ্যোগ নেন গণঅর্থায়নে ‘সাঁতাও’ চলচ্চিত্র নির্মাণের।

কাঠামোবদ্ধ ও পরিকল্পিতভাবে গণমানুষের নিকট হতে ‘সাঁতাও’ চলচ্চিত্রের অর্থ সংগ্রহ শুরু হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে শুরু হয় প্রচারণা। অর্থ সংগ্রহের জন্য ওয়েব সাইটে যুক্ত করা হয় পেমেন্ট গেটওয়ে। ৬ মাস প্রচারণা শেষে ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় শুটিং, বছরব্যাপী চলে শুটিং পর্ব।
২০২০ সালে নির্মাণ শেষ হলেও কোভিড-১৯-এর কারণে থমকে যায় কাজ। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেন্সর বোর্ডের অনাপত্তিপত্র পায় ‘সাঁতাও’। ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব ইন্ডিয়া’র ৫৩তম আসরে ‘ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার’ হয়েছে ‘সাঁতাও’-এর। ২৪ নভেম্বর ২০২২ ভারতের গোয়া শহরে অনুষ্ঠিত উৎসবের ‘সিনেমা অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ বিভাগে প্রদর্শিত হয়েছে চলচ্চিত্রটি।
‘সাঁতাও’ নির্মাণে অনিশ্চয়তা ছিল, পুরো দলের প্রাণান্তকর পরিশ্রম ছিল, সব সীমাবদ্ধতা অতিক্রমের প্রেরণা ছিল গণমানুষের সমর্থন। গণমানুষই ইতিহাস নির্মাণ করে। পুঁজির দাসত্ব যখন গণমানুষের জীবনকে চলচ্চিত্রের পর্দায় হাজির করতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন গণমানুষের গণঅর্থায়নই পারে সেই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে চলচ্চিত্রের পর্দায় জীবনের গল্পকে হাজির করতে। শরিফ উল আনোয়ার সজ্জনের প্রযোজনা, খন্দকার সুমনের পরিচালনায় ‘সাঁতাও’ সিনেমার মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন আইনুন পুতুল ও ফজলুল হক।