উদ্ভিদের পাতা খেয়ে পোকা ঢেলে দেয় ‘সোনার টাকা’

রাজশাহী প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২৩, ১৪:০৮

রাজশাহী সিল্ক বিশ্বব্যাপী একটি ঐতিহ্যের নাম হয়ে উঠেছে। ছবি: প্রতিনিধি
ইতিহাস ও সময়ের হাত ধরে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে রাজশাহী সিল্ক বিশ্বব্যাপী একটি ঐতিহ্যের নাম হয়ে উঠেছে। রেশম আবিষ্কারের ইতিহাস বেশ চমকপ্রদ ও কিছুটা রহস্যপূর্ণও বটে। রেশম বা সিল্কের আদিভূমি মূলত চীন দেশে।
তুঁত নামের এক ধরনের সবুজ পাতাবিশিষ্ট গাছ থেকে পাওয়া পলু পোকার গুটি থেকে প্রক্রিয়াকৃত ও আহরিত সূক্ষ্ন সুতায় তৈরি হয় অনিন্দ্যসুন্দর, মসৃণ ও কোমল বস্ত্রসম্ভার নরম মোলায়েম রেশম আঁশ বা সিল্ক।
একমাত্র রাজশাহীতেই উৎপাদিত হয় দেশের সিংহভাগ রেশম পণ্য বা সিল্ক সুতা। বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের সদর দপ্তরও রাজশাহীতে। রাজশাহী রেশম কারখানাটি খুঁড়িয়ে চললেও মূলত বেসরকারি উদ্যোগে বিকশিত হয়ে চলেছে রাজশাহী সিল্ক।
এককালে রেশম সুতা থেকে শুধু শাড়ি তৈরি হলেও এখন পণ্যের বৈচিত্র্য ও ডিজাইনের বিস্তৃতি ঘটেছে। এখন সব বয়সী ও শ্রেণির মানুষের পরিধান উপযোগী নানা ধরনের রেশম বস্ত্র তৈরি হচ্ছে রাজশাহীর বিভিন্ন কারখানায়।
জানা যায়, রেশম আঁশের উপাদানে থাকে তুঁত গাছে রেশম পোকার গুটি দ্বারা তৈরিকৃত প্রোটিনের আবরণ; যা সারসিনা নামে ডাকা হয়। যে পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক রেশম তৈরি হয় তাকে বলা হয় সেরিকালচার। রেশমই এ শিল্পের মূল উপাদান। রেশম পোকা পালনকে স্থানীয় ভাষায় পলুপালন বলা হয়।
তুঁত চাষ ও পলুপালনকে একত্রে রেশম চাষ বলে। বর্তমানে বাংলাদেশে মালবেরি পদ্ধতিতে রেশম চাষ হয়। সাধারণত এখান থেকে তিন ধরনের সিল্ক সুতা যেমন তুঁত সিল্ক, ইরি (অথবা ইন্ডি) সিল্ক এবং তসর সিল্ক বা রেশম আঁশ তৈরি করা হয়ে থাকে।
রেশম বোর্ড ও কারখানা সূত্র অনুযায়ী, ‘উদ্ভিদের পাতা খেয়ে পোকা, ঢেলে দেয় সোনার টাকা’- রেশম নিয়ে প্রচলিত এ প্রবাদের সঙ্গে পরিচিত বাংলার প্রায় সবাই। আমের পাশাপাশি এই রেশম বা সিল্ক উৎপাদনে বিখ্যাত হওয়ার সুবাদে রাজশাহী সারা বিশ্বে সুপরিচিত ‘রেশমনগর’ বা ‘সিল্কসিটি’ নামে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পণ্য হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে।
প্রায় দেড় যুগ পর ২০১৮ সালে এই সিল্কসিটির একমাত্র সরকারি রেশম কারখানাটি ফের চালু হয়। নতুন করে উদ্দীপনা দেখা দেয় চাষি ও শ্রমিকদের মধ্যে। গত বছরের এপ্রিলের দিকে ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন্স) হিসেবে নিবন্ধিত হওয়ার পর রাজশাহী সিল্কের গুরুত্ব আরও বেড়েছে।
রাজশাহী রেশম বোর্ডে নিয়োজিত রেশম পোকা চাষি শফিকুল ইসলাম টিটু বলেন, সুতা বের করতে হলে আধা ঘণ্টা গরম পানিতে গুটি সিদ্ধ করতে হয়। আট থেকে দশটি গুটির মাথা এক করে সুতা তৈরির মেশিনে দিলে একটি সুতা তৈরি হয়। একটি গুটি থেকে অন্তত ৫০০ মিটার সুতা তৈরি হয়। সুতা তৈরির কাজটি মূলত দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নারী শ্রমিকরা করে থাকেন।
রেশম বোর্ডের তাঁতি সানোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশে বছরে চার থেকে পাঁচটি রেশম মৌসুম থাকে গুটি উৎপাদনের জন্য। আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে একটি রেশম মৌসুম ৩০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। রেশম চাষের প্রধান মৌসুম হচ্ছে- চৈত্র, জ্যৈষ্ঠ এবং অগ্রহায়ণ মাস।
রাজশাহী রেশম উন্নয়ন বোর্ডের ম্যানেজার ও উৎপাদন কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, বর্তমানে রাজশাহী রেশম কারখানা মাসে এক টন সুতা উৎপাদন করছে। এতে প্রায় এক হাজার ২০০ গজ কাপড় তৈরি হচ্ছে। কারখানার শো-রুমে শাড়ি মিলছে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকাতে। চাদর ও ওড়না মিলছে দুই হাজার টাকার মধ্যে। পাঞ্জাবি ও শার্টের পিস মিলছে ৮০০ টাকা গজ হিসেবে।
তিনি বলেন, ২০০৫ সালে এক কেজি সুতার দাম ছিল এক হাজার টাকা। বর্তমানে সেই সুতার দাম কেজিপ্রতি সাড়ে ৭ হাজার টাকা। বর্তমানে রেশম উন্নয়ন বোর্ড নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে সাড়ে তিন হাজার টাকা কেজি দরে দেশি রেশম সুতা বিক্রি করছে বেসরকারি কারখানা মালিকদের কাছে।
রাজশাহী সিল্কের ইতিহাস প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের শিক্ষক ড. আমিরুল ইসলাম কনক বলেন, রাজশাহী সিল্কের সঙ্গে রাজশাহী নামটি এমনভাবে মিশে আছে যে এদের একেক থেকে অন্যকে পৃথকভাবে কল্পনা করা যায় না। রেশমের শহর রাজশাহীর প্রাচীন জনপদের নাম মহাকালগড়।
রাজশাহী রেশম উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য ড. এমএ মান্নান বলেন, রেশমের উন্নয়নে সরকারিভাবে দেশে ১৩৫ কোটি টাকার কয়েকটি প্রকল্প চালু রয়েছে। সুতার চাহিদা মেটাতে প্রতিবছরই তুঁতগাছ লাগানো হচ্ছে। কয়েক বছরের মধ্যেই রেশম সুতার উৎপাদন বাড়বে। তখন দেশি সুতাতেই শতভাগ রেশম তৈরি হবে।
জিআই পণ্য রাজশাহী সিল্কের একটি বড় অর্জন হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক (ডিজি) আব্দুল হাকিম।
তিনি বলেন, রেশম বা সিল্ক একটি উৎকর্ষ ও মূল্যবান পণ্য হলেও এটি রাজশাহী তথা বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যও বটে। বাংলার রেশম পণ্যের ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও যার সুনাম বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ছিল। রাজশাহী তথা বাংলাদেশের রেশম বস্ত্র রপ্তানি হতো দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ইউরোপ ও পৃথিবীর অন্য দেশেও।