টাঙ্গাইল পৌরসভার লাইসেন্সে চলছে ব্যাটারি চালিত মেট্রোরিকশা

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২৩, ১৯:০৮

লাইসেন্স নিয়ে চলছে কয়েক সহস্রাধিক ব্যাটারি চালিত মেট্রোরিকশা। ছবি: টাঙ্গাইল প্রতিনিধি
টাঙ্গাইল পৌরসভার লাইসেন্স নিয়ে চলছে কয়েক সহস্রাধিক ব্যাটারি চালিত মেট্রোরিকশা (ইজি বাইক)। সারা দেশের ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান বন্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাসহ সড়ক পরিবহন বিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের সভায় নেয়া সিদ্ধান্ত অমান্য করে ব্যাটারি চালিত ওই মেট্রোরিকশার লাইসেন্স দেয়ার অভিযোগ উঠেছে টাঙ্গাইল পৌরসভা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। এর ফলে অপ্রতুল সড়ক ব্যবস্থা আর বিপুল অসংখ্য ব্যাটারি চালিত মেট্রোরিকশা চলাচলে শহরে যেমন বেড়েছে যানজট, তেমনি দেখা দিয়েছে চরম বৈদ্যুতিক সমস্যা। এতে অসহনীয় হয়ে উঠেছে শহরবাসীর জনজীবন।
জানা যায়, ১৮৮৭ সালের ১ জুলাই স্থাপিত হয় টাঙ্গাইল পৌরসভা। বর্তমান আয়তন ২৯.৪৩ বর্গ কিলোমিটার। ১৮টি ওয়ার্ডের প্রথম শ্রেণির এই পৌরসভার মোট সড়ক সংখ্যা ৫৯০টি। ২০১১ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী এ পৌরসভার জনসংখ্যা-১ লাখ ৬৭ হাজার ৪১২জন। এর মধ্যে পুরুষ-৮৪ হাজার ৭৪১ আর মহিলা-৮২ হাজার ৬৭১ জন। মোট ভোটার সংখ্যা-৯৪,৬৪৪ জন, এর মধ্যে পুরুষ ভোটার-৪৬ হাজার ১৩০ জন আর মহিলা ভোটার সংখ্যা-৪৮ হাজার ৫১৪ জন।
টাঙ্গাইল পৌরসভার লাইসেন্স বিভাগ জানায়, টাঙ্গাইল পৌরসভার লাইসেন্সপ্রাপ্ত অটোরিকশার সংখ্যা ৪৫০০ আর রিকশা রয়েছে ৫০০০। অটোরিকশা লাইসেন্স ফি-১০,৫০০ আর পায়ে চালিত রিকশার লাইসেন্স ফি-১০০০টাকা।
সরেজমিন দেখা গেছে, ব্যাটারি চালিত ওই মেট্রোরিকশাগুলোর পিছনে বা চালকের বসার সিটের নিচে সাঁটানো হয়েছে টাঙ্গাইল পৌরসভার লাইসেন্স। টাঙ্গাইল পৌরসভার বর্তমান মেয়র এস.এম সিরাজুল হক আলমগীর স্বাক্ষরিত এক বছর মেয়াদী ওই লাইসেন্স গুলো ২০২১ সালে প্রথম দফায় অনুমোদন হয়েছে। যার ফলে কিছু রিকশার লাইসেন্সের মেয়াদ দেখা গেছে ২০২১ থেকে ৩০ জুন ২০২২। ওই রিকশাগুলোর লাইসেন্সের মেয়াদ ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় স্বাক্ষরিত রিকশার লাইসেন্সের মেয়াদ হয়েছে ২০২২ সাল থেকে ৩০ জুন ২০২৩ পর্যন্ত। এছাড়াও নিয়ম বহির্ভূতভাবে এর আগেও তৎকালীন টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র দেন ৪০০০ হাজার ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার লাইসেন্স। শহর জুড়ে এ সময় লাগামহীন যানজট লেগে থাকায় ওই ৪০০০ অটোরিকশা চলাচলে দুই শিফট পদ্ধতি চালু করা হয়। এরপর থেকে প্রতি শিফটে ২০০০ করে অটোরিকশা চলাচল শুরু করে। এর ফাঁকে সড়কে নামতে শুরু করে ব্যাটারি চালিত মেট্রোরিকশা। বর্তমানে শহর জুড়ে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার পাশাপাশি চলাচল করছে প্রায় ৭০০০ ব্যাটারি চালিত মেট্রোরিকশা। এছাড়াও রয়েছে লাইসেন্স প্রাপ্ত ৫০০০ পায়ে চালিত রিকশা। বর্তমানে অটোরিকশা দুই সিফট পদ্ধতিতে চলাচল করলেও সাত সহস্রাধিকের উপর মেট্রোরিকশা চলছে দিনব্যাপি। এছাড়াও মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট বড় ১২৮টি পরিবহনসহ সরকারি বেসরকারি অফিস, ব্যাংক, বীমা, আদালতের যানবাহন, চিকিৎসক ও ব্যক্তি মালিকাধীন গাড়িসহ গড়ে প্রতিদিন তিন সহস্রাধিক মোটরসাইকেল চলাচল করছে এই শহরে। যার ফলে শহরের প্রধান প্রধান সড়কের বেবীস্ট্যান্ড, শান্তিমুঞ্জ মোড়, মেইন রোড, নিরালা মোড়, পার্কবাজার মোড়, ক্যাপ্সুল মার্কেট, পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, সুপারী বাগান মোড়, কলেজ গেইট আর নতুন বাস টার্মিনাল এলাকায় রীতিমত বেধে থাকছে যানজট। যানজট নিরসনে মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করলেও হিমশিম খাচ্ছেন তারা। এতে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন রোগী, শিশু, বৃদ্ধ, মহিলাসহ নানা বয়সী যাত্রী আর সাধারণ মানুষ।
চালক ও যাত্রীদের অভিযোগ, ইতোপূর্বে পৌরসভা নির্ধারিত ১০,৫০০ টাকা ফি এর ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার লাইসেন্স এক থেকে দেড় লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বর্তমান পৌর প্রশাসন দায়িত্ব নেয়ার পর এক বছর মেয়াদী পায়ে চালিত রিকশার ১০০০ হাজার টাকার লাইসেন্স বিক্রি করেছেন ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায়। মেট্রোরিকশার লাইসেন্সের কথা বলে অতিরিক্ত ওই টাকাগুলো নেওয়া হয়েছে। প্রতারণা মাধ্যমে পৌর প্রশাসনের কর্তারা বিপুল পরিমাণে টাকা উপার্জন করেছেন বলে দাবি করেছেন তারা।
মেট্রোরিকশা চালক মো. পলাশ বলেন, তিন বছর যাবত রিকশা চালাচ্ছেন তিনি। রিকশা ও গদি আটকে রেখে তাদের লাইসেন্স নিতে বাধ্য করা হয়েছে। লাইসেন্স ছাড়া চালানো যাচ্ছিল না বলেই তিনি লাইসেন্সটি নিয়েছেন।
তিনি বলেন, ২০/২৫ হাজার টাকায় পৌরসভা থেকে লাইসেন্স বিক্রি করা হলেও দেড় মাস আগে মুসলিমপাড়ার একজন গ্যারেজ মিস্ত্রির মাধ্যমে ১২ হাজার টাকায় লাইসেন্সটি নিয়েছেন তিনি। সুদের টাকায় রিকশা আর লাইসেন্সটি কিনেছেন বলেও জানান তিনি।
মেট্রোরিকশা চালক মো. হযরত বলেন, ২০ হাজার টাকায় তিনি লাইসেন্সটি পেয়েছেন। তার লাইসেন্স নম্বর ৮২৫। টাকাগুলো নিয়েছেন পৌরসভার লোকজন। পায়ে চালিত রিকশা লাইসেন্স কেন এত টাকা দিয়ে নিলেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, লাইসেন্স বইয়ের মধ্যে ইজিবাইক লেখা আছে বলেই তিনি লাইসেন্সটি নিয়েছেন।
চালক রবিউল ইসলাম বলেন, পৌরসভা থেকে মেট্রোরিকশার লাইসেন্স আর নম্বর প্লেট বিক্রি করার সুযোগে তারা এই ব্যাটারি চালিত রিকশা চালাচ্ছেন। পৌরসভার লোকজন লাইসেন্স ও প্লেট বিক্রি করেছেন। এ কারণে এই রিকশা বন্ধ হচ্ছে না। এরপরও যদি সরকারিভাবে এই রিকশা চলাচল বন্ধ করে, তাহলে অন্য কাজ করে খাবেন বলে জানান তিনি।
৪৯৯৫ নং লাইসেন্সপ্রাপ্ত মেট্রোরিকশার চালক রফিক বলেন, ৪৩ হাজার টাকায় পুরাতন এই রিকশাটি কিনেছি। মাসে ১২০০টাকা ভাড়ায় লাইসেন্সটি নিয়েছি। লাইসেন্সটি পৌরসভা থেকে কিনেছেন আদিটাঙ্গাইল এলাকার রিকশার গ্যারেজ ব্যবসায়ী আকবর।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শিশুদের জন্য ফাউন্ডেশন ও যুবদের জন্য ফাউন্ডেশনের সভাপতি মুঈদ হাসান তড়িৎ বলেন, উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পায়ে চালিত রিকশা লাইসেন্স দিয়ে অবৈধ মেট্রোরিকশার বৈধতা দেয়ার ষড়যন্ত্র চালানো হচ্ছে। দ্রুত অবৈধ ব্যাটারি চালিত রিকশাগুলো বন্ধে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তিনি।
করোনেশন ড্রামাটিক ক্লাবের (সিডিসি) নাট্য সম্পাদক ও শিশুদের জন্য ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা শামসুর রহমান সাম্য বলেন, সড়ক অনুপাতে যানবাহন দ্বিগুণ হওয়ায় শহর জুড়ে বৃদ্ধি পেয়েছে যানজট। যানজটের অন্যতম কারণই ব্যাটারি চালিত ওই রিকশা। পৌর কর্তৃপক্ষ পায়ে চালিত রিকশার লাইসেন্সের নামে আর মোটা টাকার বিনিময়ে দিয়েছেন ব্যাটারি চালিত মেট্রোরিকশার লাইসেন্স। পায়ে চালিত রিকশার লাইসেন্স ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা, সেখানে নিচ্ছেন ২২০০০ থেকে ২৩০০০ হাজার টাকা। গরীবের টাকা অমানবিকভাবে হরিলুট হচ্ছে। এর প্রভাব তীব্র যানজট ভোগ করছেন সাধারণ মানুষ। সরকারের মনোনীত মেয়র এই হরিলুটের অন্যতম বলে দাবি করেছেন তিনি। এর ফলে সরকারের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে। ১২০০ টাকার লাইসেন্স ২২০০০ থেকে ২৩০০০ হাজার টাকায় বিক্রির মত বড় একটি অনিয়ম প্রশাসন, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সংস্কৃতিবিদসহ সকলে জানা সত্ত্বেও এর কোন প্রতিকার নেই বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
রিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুস সবুর বলেন, টাঙ্গাইল পৌরসভা থেকে চলাচলের জন্য ব্যাটারি চালিত মেট্রোরিকশাগুলোকে (ইজিবাইক) পায়ে চালিত রিকশার লাইসেন্স দিয়েছে। লাইসেন্স দেয়ার দায়িত্ব তাদের না। পৌরসভার মেয়র সাহেব পায়ে চালিত রিকশার লাইসেন্স দিয়েছেন মেট্রোরিকশায়। ব্যাটারি চালিত মেট্রোরিকশা (ইজিবাইক) আমাদের সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও এই লাইসেন্স দেয়া নিয়ে আমাদের সাথে কোন মিটিং করেননি পৌর কর্তৃপক্ষ। ইজিবাইক বন্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্যের বিষয়টি মেয়র সাহেবের বলে জানান তিনি।
বক্তব্য নিতে টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র এস.এম. সিরাজুল হক আলমগীরের মুঠোফোন দিলে সেটি রিসিভ করে পিএস সাজ্জাদ বলেন, এ ব্যাপারে সাক্ষাতে কথা বলা হবে।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের (২০ জুন) সড়ক পরিবহন বিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের সভায় সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সারা দেশে ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরবর্তীতে একই বছরের ১৫ ডিসেম্বর সারা দেশে চলা অবৈধ ব্যাটারিচালিত ৪০ লাখ ইজিবাইক বন্ধের নির্দেশসহ আমদানি ও ক্রয়-বিক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা আর অবৈধ ইজিবাইক আমদানি থেকে বিরত থাকতে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, এই মর্মে রুল জারি করেন বিচারপতি মামনুন রহমানের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ।