
ছাতা মেরামত করছেন বৃদ্ধ আলতাফ তালুকদার। ছবি: বরিশাল প্রতিনিধি
“রোদ, বৃষ্টি বা শীত” তিনটি সময়েই প্রকৃতির আচরণ থাকে ভিন্ন ভিন্ন। তবে প্রকৃতির আচরণ ভিন্ন হলেও তিনটি সময়ে মানুষের ভরসা একজনই। রোদে ছায়া আর বৃষ্টি ভেজা থেকে রক্ষা এবং শীতে উষ্ণতা ছড়াচ্ছেন মানুষের মাঝে। কখনো কখনো হয়ে উঠেন পথচারীদের বিপদের বন্ধুও। তিনি হলেন, ৭০ ঊর্ধ্ব বৃদ্ধ আলতাফ তালুকদার। যিনি দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে ছাতা মেরামত আর লেপ-তোষকের কারিগর হিসেবে জীবন সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। তবে শেষ বয়সে তার সংসারে দারুণ টানাপোড়ন সৃষ্টি করেছে ঊর্ধ্বমূল্যের বাজার। একমাত্র ছেলে খোঁজ খবর নিচ্ছে না। বৃদ্ধা স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া বাসায় কোনভাবে দিন কাটছে আলতাফ তালুকদারের।
নগরীর নবগ্রাম রোডে ফারুক মাস্টারের বাড়ির ভাড়াটিয়া আলতাফ তালুকদারের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কাছিপাড়ায়। তবে তিনি ইতিপূর্বে বসবাস করতেন শ্বশুর বাড়ি লেবুখালীতে। নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিকাণ্ডেসব হারিয়ে জীবিকার খোঁজে বরিশালে আসেন তিনি।
নগরীর নবগ্রাম রোডে কথা হয় আলতাফ তালুকদারের সাথে। সেখানে সড়কের পাশে গাছের ছায়াতলে কাগজ বিছিয়ে ছাতা মেরামত করছিলেন তিনি। বলেছেন, জীবনের শেষ ইচ্ছার কথা। শান্তিতে মৃত্যুবরণ করাই এখন তার শেষ ইচ্ছা।
আলতাফ তালুকদার বলেন, পটুয়াখালীর হেতালিয়া বাঁধঘাটে একটি দোকান ভাড়া নিয়ে লেপ-তোষক এবং ছাতা মেরামতের কাজ করতাম। এখান থেকে উপার্জন যা হতো তা দিয়ে স্ত্রী, এক ছেলে এবং এক মেয়েসহ চার সদস্যের সংসার ভালই চলছিল। বছর দুই আগে এক রাতে হঠাৎ দোকানে আগুন লেগে সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
তিনি বলেন, দোকানে আগুন লাগার পরে সরকারিভাবে কিছু সহায়তা প্রদান করা হয়েছিল। কিন্তু তা আমি পাইনি। দোকানের যিনি মালিক তিনিই সব নিয়ে গেছে। যেকারণে দীর্ঘ সময় ধার-দেনা করে সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। এরপর বরিশালে আসি এবং পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে রাস্তার পাশে বসে ছাতা মেরামত করে জীবন যাপন করছি।
আলতাফ হোসেন বলেন, বৃষ্টির মৌসুমে একটু কাজ ভালো হয়। তখন দৈনিক ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত উপার্যন করছি। তয় এহন আর ছাতির মেরামতের কাজে আগের মতো পয়সা নাই। এহন দিনে একশত থেকে ৩০০ টাকার পর্যন্ত পাই। খালি ছাতি মেরামত কইরা না, খালি গ্যাসলাইটে গ্যাস ভইরা কিছু টাকা পাই। কিন্তু এই উপার্জনে সংসার চলে না। লেপ-তোষক বানাতে পারি। কিন্তু এখন গরমে তার চাহিদা নাই। বাজারে সবকিছুর দাম বেশি। আমাগো মতো গরিবের পক্ষে এতো দাম দিয়া কিন্না খাইতে কষ্ট অইয়া যায়। মাছ-মাংস তো চাইলেই জোডে না। হ্যার মধ্যে আবার মাস শ্যাষে দেড় হাজার টাকা বাসা ভাড়া দেতে হয়। ‘মোগো সংসার এখন আল্লায় চালায়”।
তিনি বলেন, বর্তমান বাজারে ছাতার দাম বেশি। যে কারণে যারা আমার মতো অর্থাভাবে আছেন তারা পুরানো ছাতা মেরামত করে নেন। একটা ছাড়া মেরামত করে ২০-৫০ টাকা পর্যন্ত পাই। কোন কোন সময় কাজ বেশি হলে একশত টাকাও মজুরি পাই।
আক্ষেপের সুরে আলতাফ তালুকদার বলেন, হুনছি সরকার বয়স্কা মানুষরে বয়স্ক ভাতা দেয়, চাউল দেয়। কিন্তু আমাগো ভাগ্যে হেডাও জোডেনাই। রাস্তার পাশে বইয়া ছাতি সাড়াইয়াই চলছে জানিয়ে আলতাফ তালুকদার বলেন, “নবগ্রাম রোডের ভাড়া বাসায় আমি এবং আমার স্ত্রী আঁখি তারা থাকি। মেয়ে বিয়ে দিছি, সে শ্বশুর বাড়ি থাহে। একমাত্র ছেলেও বরিশালে কাউনিয়া বিসিক এলাকায় শ্বশুর বাড়ি থাকে। হ্যার অটোরিকশা, চায়ের দোকান আছে। কিন্তু আমাগো খোঁজ খবর লয় না। তার পরেও চাই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে হ্যারা ভালো থাকুক। আমাগো তো দিন শ্যাস। এহন শান্তিতে মরতে পারলেই হয়”।
এদিকে, শুধু আলতাফ হোসেন তালুকদারই নন, তার মতো আরও অনেকেই আছেন যারা জীবন যুদ্ধে টিকে আছেন সংগ্রাম করে। তাদের কারণে অনেকে উপকৃত হচ্ছেন, বিপদে পাশে পাচ্ছেন। কিন্তু এসব ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। আবার এসব মানুষের খোঁজ নেয়ার সদিচ্ছাও দেখান না কেউ।