ইমেজ সংকটে হাসানাত আবদুল্লাহ, প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের উত্থান

বরিশাল প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৩, ১৯:৪৩

সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ ও জাহিদ ফারুক শামীম। ছবি: সংগৃহীত
বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবার আওয়ামী লীগের নতুন প্রার্থী দেয়ায় নগর রাজনীতিতে নতুন মোড় নিয়েছে। গত প্রায় ৫ বছর সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর সবকিছুই একক নিয়ন্ত্রণে থাকায় অনেক নেতাকর্মী কোণঠাসা ছিলেন বলে অভিযোগ আছে।
যার মধ্যে অন্যতম পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম। তিনি ও তার কর্মীরা দীর্ঘদিন রাজনীতিতে ব্যাপক কোণঠাসা ছিলেন। নগরীতে তেমন কোন পোস্টার ব্যানারও ছিল না তাদের।
তবে খোকন সেরনিয়াবাত প্রার্থী হওয়ার পর দৃশ্যপট বদলে গেছে। শহরের বিভিন্ন স্থানে মেয়রের ছবি ছিঁড়ে ফেলে সাঁটানো হয় জাহিদ ফারুক, তার অনুসরারীসহ নেতাকর্মীদের নতুন ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুন।
তবে দলীয় মনোনয়ন রাজনীতিতে লাভবান হলো কে, তা নিয়ে আলোচনার ঝড় বইছে দলীয় ফোরামে। আর সেই আলোচনায় স্থান পাচ্ছে বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য ও পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীমের নামটি।
দলীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, বরিশালে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কোণঠাসা জাহিদ ফারুক শামীমের একমাত্র প্রতিপক্ষ ছিলেন আবুল হাসানাত আবদুল্লার জ্যেষ্ঠ পুত্র সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। আর তাই সাদিক আবদুল্লাহর বিরোধীতা করতে তার চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতের পক্ষ নেন তিনি। এমনকি তার মনোনয়ন পাওয়ার নেপথ্যে ভূমিকায় ছিলেন তিনি ও জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ প্রভাবশালী অনেক নেতা।
এ কারণে মেয়র সাদিক আবদুল্লার পরাজয়ে বিজয়ের হাসি হেসেছেন প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম। সেই সাথে বরিশালে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তার নিরব উত্থান ঘটেছে। এমনটাই মনে করছেন অনেকে।
এমন মনে করার প্রমাণও মিলেছে গত ২০ এপ্রিল। ওই দিন বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাতের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রীর অভ্যর্থনা গ্রহণ ও নগর উন্নয়ন নিয়ে বক্তব্য রাজনীতিতে তার জেগে ওঠার প্রমাণ দেয়।
জানা গেছে, পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য ছাড়াও বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পদে আছেন। অভিযোগ রয়েছে, দলীয় সংসদ সদস্য এবং প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পরও তাকে রাখা হয়নি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কোন কর্মসূচিতে।
এরপর নিজ দলে কোণঠাসা থেকেও ধীরে ধীরে নিজের অবস্থান তৈরি করেন জাহিদ ফারুক শামীম। সাদিক আবদুল্লাহর প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীদের নিয়ে বলয় তৈরি করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক এই কর্মকর্তা।
নেতারা বলছেন, বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ গত সাড়ে চার বছরে বেশ কয়েকবার আলোচনায় আসেন। এর মধ্যে সাবেক ও বর্তমান দুই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে বিরোধে জড়ানোর ঘটনা দেশব্যাপী সর্বাধিক সমালোচিত।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডে সাদিক আবদুল্লার পক্ষে একমাত্র প্রস্তাবকারী ছিলেন তার বাবা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। প্রধানমন্ত্রী ও মনোনয়ন বোর্ডের সভাপতি শেখ হাসিনাসহ বাকি সবাই ছিলেন বিপক্ষে।
এসময় আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ স্থানীয় রাজনীতিতে তার ইমেজ রক্ষায় সংসদ নির্বাচনে নিজের আসন খোকন সেরনিয়াবাতকে ছেড়ে দিয়ে ছেলে সাদিক আবদুল্লাহকে পুনরায় মনোনয়ন দেয়ার দাবি জানান। কিন্তু বোর্ডের সভাপতি তার এ প্রস্তাব নাকোচ করে দেন এবং আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকনকে বরিশাল সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেন। এ কারণে হতাশায় বোর্ডের সভা চলাকালিন অসুস্থ হয়ে পড়ার খবরও উঠে আসে খবরে।
বরিশাল মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহামুদুল হক খান মামুন বলেন, প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম কোন গ্রুপিংয়ের রাজনীতি করেন না। তারপরেও তাকেসহ আমাদের নেতাকর্মীদের রাজনীতিতে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল। তবে সাদিক আবদুল্লাহর মনোনয়ন না পাওয়ায় বড় ক্ষতি যে তার বাবা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর হয়েছে সেটা সবাই বোঝে। এখানে আমাদের কোন হাত ছিল না। প্রধানমন্ত্রী খোকন সেরনিয়াবাতকে মনোনয়ন দিয়েছে। তিনি মনোনয়ন পাওয়ায় শুধু আমরাই নয়, বরিশালের প্রতিটি মানুষ খুশি হয়েছে। তবে খোকন সেরনিয়াবাত আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর পরিবারের বাইরের নয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে সুসাশনের জন্য নাগরিক (সুজন) বরিশাল জেলার সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম বলেন, এখানে যিনি (সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ) মেয়র ছিলেন তিনি নিজেকে রাজনৈতিক এবং মেয়র হিসেবে পরিপক্কতার পরিচয় দিতে পারেননি। তিনি রাজনীতিতে বিভাজন সৃষ্টি করে একক আধিপত্য গড়ে তোলেন। প্রকৃত রাজনীতিকদের দূরে সরিয়ে রেখে কয়েকজন অরাজনৈতিকদের সুবিধা দিয়েছেন। প্রশাসনের সাথে বিরোধ সৃষ্টি করে রেখেছেন।
তিনি বলেন, তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব ছিল। জনগণের সাথে যোগাযোগ ছিল না। রাত ছাড়া তার সাথে দেখা করা যেত না। একজন সাধারণ নাগরিককে তার সাথে দেখা করতে গেলে জাতীয় পরিচয়পত্র সাথে নিয়ে যেতে হতো। তার এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ ছিল। এ কারণেই প্রধানমন্ত্রী নিজেই তাকে মনোনয়ন দেননি। তার মনোনয়ন না পাওয়ায় ভবিষ্যত রাজনীতিতেও এর প্রভাব পড়বে।
সাদিক আবদুল্লাহর মনোনয়ন না পাওয়ায় তার বাবা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর রাজনীতিতে কোন প্রভাব পড়বে না জানিয়ে সুজনের সাধারণ সম্পাদক বলেন, এখানে তার (আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ) রাজনীতিতে কিছুটা ইমেজ সংকট সৃষ্টি হলেও সেটা একমাত্র তার ছেলের জন্য হয়েছে। তবে তার রাজনৈতিক ইমেজ নির্ভর করবে আসন্ন সিটি নির্বাচন কৌশলের ওপর। বিগত নির্বাচনে অর্থাৎ শওকত হোসেন হিরন এবং মাহাবুব উদ্দিন আহমেদের নির্বাচনের সময় আমরা দেখেছি। তার নির্বাচনী কৌশলের কারণে দলীয় প্রার্থী পরাজিত হয়েছে। এই নির্বাচনেও তার সেই কৌশল প্রয়োগ না করলে তিনি অবশ্যই সমান্নের জায়গায় থাকবেন এবং তার ইমেজ রক্ষা পাবে।