Logo
×

Follow Us

জেলার খবর

সাংবাদিক নাদিম হত্যার নেপথ্যে ‘বিন্দু মাসি’

Icon

জামালপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৩, ১৯:০৭

সাংবাদিক নাদিম হত্যার নেপথ্যে ‘বিন্দু মাসি’

বকশীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীনা বেগম ও চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু। ছবি: জামালপুর প্রতিনিধি

জামালপুরের বকশীগঞ্জে সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম হত্যার যতই দিন যাচ্ছে, ততই নানা রহস্য ঘুরপাক খাচ্ছে।

হত্যার সাথে সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (সদ্য বহিষ্কৃত) মাহমুদুল আলম বাবুর সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকলেও নেপথ্যে বড় কোনো শক্তি রয়েছে কিনা-তা খতিয়ে দেখার দাবি উঠেছে সর্বমহল থেকে।

অভিযোগ উঠেছে, নাদিম হত্যার নেপথ্যে বকশীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীনা বেগমের হাত রয়েছে। যিনি এলাকায় ‘বিন্দু মাসি’ নামে পরিচিত। অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে মামলা তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসতে পারে ‘থলের বেড়াল’।

নিহত সাংবাদিক নাদিমের স্ত্রী মনিরা বেগম বলেন, তিনি একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। তার স্বামী গোলাম রাব্বানী নাদিম সবসময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লেখালেখি করতেন। রাজাকার পরিবার ও অপকর্মের হোতা প্রভাবশালী কিছু লোকের বিরুদ্ধে বেশকিছু সংবাদ করার কারণে স্থানীয়ভাবে তিনি রাজনৈতিক হয়রানির মধ্যে থাকতেন।

জানা গেছে, গোলাম রাব্বানী নাদিম বকশীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীনা বেগমের বিরুদ্ধে একাত্তর টিভিতে সংবাদ পরিবেশন করেন। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর প্রচারিত ওই সংবাদে শাহীনা বেগমের বিরুদ্ধে রাজাকারের সন্তান হয়েও আওয়ামী লীগে পদ-পদবী লাভের অভিযোগ করা হয়। সংবাদটি প্রচারের পর শাহীনার লোকজন সাংবাদিক নাদিমের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ফেসবুকে নানা আপত্তিকর মন্তব্য ও প্রাণনাশের হুমকি দিতে থাকেন। এ প্রেক্ষিতে নাদিম বাদী হয়ে ১১ এপ্রিল থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। ওই অভিযোগে নয়াপাড়া গ্রামের খায়রুল হাসান মিলন মিয়াকে একমাত্র আসামি করা হয়। মিলন মিয়া নাদিমের হত্যা মামলাতেও ১০ নম্বর আসামি। যিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীনা বেগমের লোক।

১১ এপ্রিল মিলনের বিরুদ্ধে দাখিলকৃত নাদিমের অভিযোগটি আমলে নেয়নি বকশীগঞ্জ থানা পুলিশ। পাল্টা ওইদিনই রাত সাড়ে ১০টার দিকে বকশীগঞ্জ মধ্যবাজার এলাকায় সাংবাদিক নাদিমের ওপর হামলা চালিয়ে মারধর করে আওয়ামী লীগ নেত্রী শাহীনা বেগমের লোকজন। পরদিন ১২ এপ্রিল নাদিম ফের আরেকটি লিখিত অভিযোগ দেন থানায়। এতে শাহীনাকে ১ নম্বর (হামলার হুকুমদাতা) আসামি করা হয়। এখানে নামোল্লেখকৃত পাঁচজন আসামির মধ্যে তিনজনই হত্যা মামলাতেও এজাহারভুক্ত আসামি। এদের মধ্যে ১২ এপ্রিলের লিখিত অভিযোগের ৩ নম্বর আসামি ইসমাইল হোসেন স্বপন মণ্ডল হত্যা মামলায় ৮ নম্বর আসামি, অভিযোগের ৪ নম্বর আসামি খন্দকার শামীম হত্যা মামলায় ৯ নম্বর আসামি এবং অভিযোগের ৫ নম্বর আসামি শেখ ফরিদ হত্যা মামলায় ১৩ নম্বর আসামি। হত্যা মামলার ২২ জন এজাহারভুক্ত আসামির মধ্যে চারজনই নাদিমের ইতোপূর্বে দাখিলকৃত ২টি লিখিত অভিযোগেরই আসামি ছিলেন। যারা সরাসরি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীনা বেগমের হয়ে এলাকায় কাজ করেন।

১১ ও ১২ এপ্রিলের দাখিলকৃত অভিযোগ দুটি ওসি আমলে না নেওয়ায় চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন নাদিম। এক ভিডিওবার্তায় তিনি নিজের ও পরিবারের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সুদৃষ্টি কামনা করেন। কিন্তু এরপরও কোনো প্রতিকার পাননি নাদিম।

এরমধ্যে উপজেলার সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (সদ্য বহিষ্কৃত) মাহমুদুল আলম বাবুর বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠে। নির্ভীক সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগলেও কলম ধরেন ভুক্তভোগী নারীর পক্ষে। ক্ষিপ্ত হয়ে বাবু চেয়ারম্যান নাদিমের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেন। গত বুধবার (১৪ জুন) সাইবার ট্রাইব্যুনালে ওই মামলা খারিজ হলে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন বাবু চেয়ারম্যান। মামলা খারিজের চার ঘণ্টার মধ্যে হামলা করা হয় সাংবাদিক নাদিমের ওপর। পরদিন বৃহস্পতিবার (১৫ জুন) পৌনে ৩টার দিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, বকশীগঞ্জে আওয়ামী লীগের মধ্যে বিবাদমান একাধিক গ্রুপ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, নাদিমের হত্যাকারীরা বাবু চেয়ারম্যানের হয়ে কিলিং মিশনে অংশ নিলেও তারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীনা বেগমের গ্রুপেও সক্রিয়। তার ইন্ধনেই আসামিরা এলাকায় পরস্পর রাজনৈতিক দাঙ্গা-হাঙ্গামায় লিপ্ত থাকতেন। অপরদিকে পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেছুর রহমান পান্নার চাচাতো ভাই হওয়ার সুবাদে অনৈতিক আয় এবং প্রশাসনিক সুবিধা ভোগ করতেন বাবু চেয়ারম্যান।

এদিকে মঙ্গলবার (২০ জুন) সকাল থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাবু চেয়ারম্যানের একটি অডিও রেকর্ড ভাইরাল হয়েছে। ২৬ সেকেন্ডের এই রেকর্ডে মাহমুদুল আলম বাবুকে বলতে শোনা যায়, ‘নাদিম সাংবাদিককে... আমি মনে করবো এর জন্য দায়-দায়িত্ব উপজেলা আওয়ামী লীগের। নাদিম সাংবাদিককে ঠিক করতে ১ মিনিটের বিষয়, আমি যামু ওরে শাসন করতে। আবার যদি উপজেলা আওয়ামী লীগ হা হা করে হাসে যে, বাবু বিপদে পড়ছে, পড়ুক’!

নাদিমের সহকর্মী সাংবাদিক ইমদাদুল হক লালন বলেন, ‘ভাইরাল হওয়া অডিওটির কণ্ঠ মাহমুদুল হক বাবুর। নাদিমকে হামলার আগে তিনি আওয়ামী লীগের দলীয় অফিসে কোনো একটি বৈঠকে বসে এ বক্তব্য দিয়েছিলেন।’

বাবু চেয়ারম্যানের নাদিমকে ‘শায়েস্তা’ করার এ বক্তব্য উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীনা বেগমের সামনেই দিয়েছিলেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়।

অপরদিকে প্রথমবার নাদিমের ওপর হামলার ঘটনায় শাহীনা বেগমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করা এবং ফের বাবু চেয়ারম্যানের আক্রমণ- উভয় ঘটনায়ই ওসির ভূমিকা একইরকম এবং রহস্যজনক ছিল। ১৪ জুন নাদিম আহত হওয়ার পর ওসি সোহেল রানা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘নাদিমের তেমন কিছু হয়নি, চোখে সামান্য আঘাত পেয়েছেন’।

অপরদিকে নাদিমের মৃত্যুর পর ওসি মন্তব্য করেন, ‘বাবু চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে স্থানীয় সাংবাদিকরা লিখলেও সবাই একসময় থেমে যায়, কিন্তু নাদিম না থেমে ধারাবাহিক নিউজ করছিল এবং ফেসবুকে শেয়ার দিচ্ছিল। তাই বিষয়টি ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে যায়, সুতরাং সাংবাদিকতার জন্য এ হত্যা হয়নি’।

নাদিম হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে পরস্পর পৃথক ঘটনাগুলো একইসূত্রে গাঁথা কিনা- তা নিয়ে সাংবাদিক ও এলাকাবাসীর মধ্যে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। ওসির ভূমিকা রহস্যজনক হওয়ায় তাকেও মামলায় সম্পৃক্ত করার দাবি জানানো হয়েছে।

সোমবার (১৯ জুন) দুপুরে সাংবাদিক নাদিম স্মরণে শোকসভা ও দোয়া মাহফিলে জামালপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক লুৎফর রহমান অভিযোগ করেন, বকশীগঞ্জ থানার ওসি সোহেল রানার ভূমিকা রহস্যজনক। তাকে প্রত্যাহারসহ হত্যা মামলায় তাকেও আসামি করার দাবি করেন তিনি।

জামালপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি নুরে আলম সিদ্দিকী বলেন, সাংবাদিক নাদিমের হত্যাকারী বাবু চেয়ারম্যানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও চাচাতো ভাই সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেছুর রহমান পান্না এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীনা বেগমের ইন্ধন থাকলে তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।

অভিযোগ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে বকশীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীনা বেগমকে বারবার মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এ ব্যাপারে বকশীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ সোহেল রানা বলেন, নাদিম হত্যা মামলাটি এখন ডিবি তদন্ত করছে। গ্রেপ্তারকৃত ১৩ জন আসামি বিভিন্ন মেয়াদে পুলিশের রিমান্ডে আছে, এর মধ্যে ছয়জনকে চারদিনের রিমান্ড শেষে আজ (বৃহস্পতিবার) আদালতে তোলা হয়েছিল। তাদের মধ্যে আসামি রেজাউল করিম ও মনিরুজ্জামান হত্যাকাণ্ডে নিজেদের জড়িত থাকায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তারা হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সবার কথাই বলেছে, তদন্তের স্বার্থে সবকিছু বলা যাবে না।

এছাড়া মামলা তদন্তে প্রমাণিত হলে, যত বড় শক্তির সম্পৃক্ততাই থাকুক- কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলেও ওসি মন্তব্য করেন।

জামালপুর পুলিশ সুপার নাছির উদ্দিন আহমেদের বক্তব্য জানতে আজ বিকেলে মুঠোফোনে কল করা হলেও রিসিভ করেননি। পরে চেষ্টা করলেও বন্ধ পাওয়া যায়।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫